চালের বাজার : বেড়েছে সরকারের চ্যালেঞ্জ
হাসান মামুন
প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
আমন মৌসুমে চালের দাম আর বাড়বে না বলে আশা থাকলেও এর বাজার ভিন্ন আচরণ করছে। এক মাসের ব্যবধানেই উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে চালের দাম। মোটা চালের দাম অবশ্য কম হারে বেড়েছে। তবে এর দাম বাড়তে থাকায় মাঝারি মানের চালের ভোক্তারাও মোটা চালের দিকে ঝুঁকলে ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। সরু চালে অভ্যস্তদের বড় অংশটাই অবশ্য চালের কেজিপ্রতি দাম ৮-১০ টাকা বাড়লেও তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। তাদের চাল পরিভোগও কম এবং সে জায়গাটা দখল করছে আটা-ময়দা। আটা-ময়দার দাম বাড়ার খবর নেই, এটা অবশ্য গরিবের জন্য কিছুটা স্বস্তির। তাদের মধ্যেও প্রধানত দামের কারণে আটার পরিভোগ বাড়ছে। সমস্যা হলো, গমের চাহিদার সিংহভাগই মেটাতে হয় আমদানির মাধ্যমে। হালে গম আমদানি অনেক বেড়েছে। গমের তৈরি খাদ্যসামগ্রীর উৎপাদনও বাড়ছে দ্রুত। তবে এ পরিস্থিতিতেও চালের গুরুত্ব কমছে না। চাল একটা গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত পণ্য হিসাবেই রয়ে গেছে। খাদ্য নিরাপত্তায় এর ভূমিকা বিরাট।
প্রত্যাশার বিপরীতে সব ধরনের চালের দাম বাড়তে থাকলে সরকারকে তাই চিন্তিত হতে হয়। অন্তর্বর্তী সরকারকেও দেখা যাচ্ছে চালের দাম বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হতে। সরাসরি চাল আমদানিতে সক্রিয় এখন সরকার। প্রথমে অবশ্য তারা চেষ্টা করেছিলেন কর-শুল্ক প্রায় পুরোটাই প্রত্যাহার করে ব্যবসায়ীদের দিয়ে আমদানি বাড়াতে। তাতে খুব একটা সাফল্য মেলেনি বলে সরকার নিজেই প্রায় ৯ লাখ টন চাল আমদানিতে মনোনিবেশ করেছে। ব্যবসায়ীরা আমদানিতে ঝাঁপিয়ে না পড়ার কারণ আছে। একটা প্রধান কারণ নতুন করে ডলারের দাম বৃদ্ধি। এ অবস্থায় খরচ বেশি পড়ে যাওয়ায় চাল এনে বিক্রি করাটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে তাদের জন্য। দাম কাছাকাছি হলে মানুষ তো দেশি চালটাই কিনতে চায়। অন্যান্য কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রেও এটা সত্য। এ অবস্থায় সরকার যেখান থেকে দ্রুত আনা সম্ভব, সেখান থেকেই চাল আমদানিতে মনোযোগী হয়েছে। নিকট প্রতিবেশী দুই দেশ এক্ষেত্রে সুবিধাজনক উৎস। মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হলেও সেখান থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাল আনছে সরকার। মিয়ানমার নাকি আরও বেশি চাল রপ্তানি করতে চায় বাংলাদেশে। পাকিস্তান থেকেও ৫০ হাজার টন চাল আসছে। সেখান থেকে সরাসরি পণ্যবাহী জাহাজ আসতে শুরু করাটাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। চালের মতো জরুরি পণ্যের বেলায় একটি বা দুটি দেশের ওপর নির্ভরশীলতা তো কাম্য নয়। এর মধ্যে আবার রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে তা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম থেকেও চাল আনা হবে। ভারতসহ বড় চাল রপ্তানিকারক দেশগুলোয় দাম নিম্নগামী বলেও জানা যাচ্ছে। আমাদের যখন চাল আমদানিতে যেতে হচ্ছে, তখন এটা সুখবর বৈকি। আরও ভালো হতো এ সময়টায় ডলারের দাম নতুন করে না বাড়লে। রিজার্ভ পরিস্থিতির অবশ্য অবনতি হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা করছে এটাকে স্বস্তিকর জায়গায় নিয়ে যেতে। সেজন্য রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি না করতে সচেষ্ট গভর্নর। তবে চালের মতো পণ্য আমদানিতে প্রয়োজন হলে ডলার নিশ্চয় দেওয়া হবে সরকারকে। অর্থবছরের বাকি সময়ে ধাপে ধাপে আমদানি করে চালের বাজার শান্ত রাখতে সরকার বরাদ্দও বাড়াচ্ছে। এর মধ্যে বেশকিছু পণ্যে নতুন করে ভ্যাট-শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। এর কারণ যে কেবল সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা প্রদান, তা নয়। খাদ্যপণ্যের জরুরি আমদানি নিশ্চিত করতেও সরকার ব্যয় করবে এভাবে আহরিত অর্থ। এক্ষেত্রে বকেয়া বিল থাকলে সেটাও পরিশোধ করতে হবে। জ্বালানিসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানির বকেয়া মেটাতে অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্যোগী হতে হয়েছে এর মধ্যে। যে অর্থনীতি তারা হাতে পেয়েছেন, সেটা তো স্বস্তিকর নয়। এর ব্যবস্থাপনা কঠিন। চালের একটা মোটামুটি স্বস্তিকর বাজারও তারা পাননি। বিগত সরকারের শেষ মেয়াদে ধারাবাহিকভাবে চালের দাম বাড়ার একটা বাস্তবতা কিন্তু ছিল। এ সময়ে মূল্যস্ফীতি যে ক্রমে বেড়েছে এবং সেটা উচ্চ স্তরেই থেকে গেছে, তাতে বিশেষভাবে ভূমিকা রেখেছে চালের দাম। চালের উৎপাদন খরচও এ সময়ে বেড়েছে অব্যাহতভাবে। সার, ডিজেল ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি এতে ভূমিকা রেখেছে। এ প্রশ্নও বারবার উঠেছে যে, উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও ধান-চাল বিক্রি করে কৃষক লাভবান হচ্ছে কিনা। এ প্রশ্নও জারি আছে-ধানের দাম বাড়লেও চালের দাম অধিকতর হারে বাড়ছে কিনা আর এতে লাভবান হচ্ছে কারা!
এবারও আমন মৌসুমে ধানের দাম গতবারের চেয়ে বেশি বলে চালকল মালিকরা বলছেন। সে কারণেই নাকি তাদের বেশি দামে চাল বিক্রি করতে হচ্ছে। সরকার যে আমন সংগ্রহ অভিযান পরিচালনা করছে, তাতে এ অবস্থায় নির্ধারিত দামে তারা চাল জোগাতে পারবেন কি না, সে প্রশ্নও তুলছেন কেউ কেউ। কেননা সরকার-নির্ধারিত দামের চেয়ে বাজারে ওই মানের চালের দাম বেশি। সেক্ষেত্রে সরকারকে চাল না দিয়ে তারা হয়তো বাজারে ছাড়বেন। প্রাপ্ত খবরে কিন্তু দেখা যাচ্ছে, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধান-চাল সংগ্রহ করতে পারছে না সরকার। এটা অবশ্য প্রায় প্রতিবারের অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতাটি বদলানোর প্রয়াসও পরিলক্ষিত নয়। এমন খবরও মিলছে যে, সরকারের হাতে সন্তোষজনক মজুত নেই। চালের মজুত ১০ লাখ টনেরও কম। আর চার লাখ টনের মতো মজুত রয়েছে গমের। বিপুল জনসংখ্যার দেশে ও বিদ্যমান দারিদ্র্য পরিস্থিতিতে এ মজুত অনেক বেশি রাখা প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তারা এমনও বলেন, ক্ষেত্রবিশেষে চালের বিকল্প বলে বিবেচিত আলুও মজুত করা প্রয়োজন; যাতে সংকটকালে এটা ব্যবহার করা যায়। মাঝে আমরা দেখলাম আলুর দাম কেজিপ্রতি ৮০ টাকাও হয়ে যেতে। এ মুহূর্তে বাজারে আলু অবশ্য সস্তা। ২৫-৩০ টাকা কেজিতে মানসম্মত আলু পাওয়া যাচ্ছে। উৎপাদন পর্যায়ে অবশ্য দাম অনেক কম, যেটা প্রায় সব ক্ষেত্রেই বড় সমস্যা। এ অবস্থায় সরকার কিছু আলু কিনে মজুত করে রাখতে পারত বলে মত রয়েছে। সেক্ষেত্রে সরকারিভাবে আলু সংরক্ষণের ব্যবস্থা অবশ্য গড়ে তুলতে হবে। তবে এ মুহূর্তে দ্রুত চাল আমদানিই জরুরি কর্তব্য।
সরকার অবশ্য ‘সংগ্রহ মূল্য’ বাড়িয়ে দেশের ভেতর থেকে চাল সংগ্রহে মনোযোগী হতে পারে। তাতে যাদের হাতে এ মুহূর্তে ধান রয়েছে, তারা লাভবান হবেন এর দাম আরও বেড়ে যাওয়ায়। চালকল মালিকরাও খুশি হবেন। তবে এতে চালের বাজার নতুন করে অশান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। উৎপাদিত চালের একটা বড় অংশ কৃষক নিজস্ব ভোগের জন্য রেখে দেওয়ার কারণেও কিন্তু আমন মৌসুমে উৎপাদন বেশি হলেও এর খুব একটা প্রভাব পড়তে দেখা যায় না বাজারে। তার ওপর আমনের ফলন এবার মার খেয়েছে কয়েক দফা বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে। এর আগে আউশ ফলনও কিছুটা মার খেয়েছে বলে সরকারিভাবে স্বীকার করা হচ্ছে। বিগত সরকারের অবশ্য নীতি ছিল পরিস্থিতি খারাপ হলেও তা গোপন করা এবং ‘উন্নয়ন’ বাড়িয়ে দেখানো। এ-ই করতে গিয়ে চালের মতো পণ্যের উৎপাদন কোনো কারণে ব্যাহত হলেও সরকারকে দেখা যেত আমদানিতে উদ্যোগী না হতে। এ কারণে বিগত অর্থবছরে চাল আমদানি হয়নি বললেই চলে। এটাকে আবার বর্ণনা করা হচ্ছিল ‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা’ বলে। খাদ্য মানে তো কেবল চাল নয়; আরও অনেক কিছু খাদ্যের অন্তর্ভুক্ত। আর চালেও আমাদের ঘাটতির মুখোমুখি হতে হয় মাঝে মাঝে। দেশের ভেতর থেকে সংগ্রহের ব্যাপারটা জটিল বলে চাল আমদানির আশ্রয়ও নিতে হয় বৈকি। এ কাজে বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করতে কর ছাড়ও দিতে হয়।
এখন তো দেখা যাচ্ছে, ব্যাপক কর ছাড় দিয়েও বেসরকারি খাতে আমদানি তেমন বাড়ানো যায়নি বলে সরকারকেই করতে হচ্ছে আমদানি। মূলত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা ভেবেই সরকারকে ধাপে ধাপে চাল আনতে হবে অর্থবছরের বাকি সময়টায়। তাকে ভর্তুকি দামে বিপুল পরিমাণ চাল জোগাতে হবে দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের মাঝে। এতে বাজারেও পড়বে কিছু সুপ্রভাব। সত্যি বলতে, সব ধরনের খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিতে এ মুহূর্তে যথেষ্ট চাল জোগাতে পারছে না সরকার। যেমন, টিসিবিতে যেভাবে চাল জুগিয়ে যাচ্ছিল, তা আপাতত বন্ধ রয়েছে। টিসিবির স্মার্ট কার্ডে এখন কেবল জোগানো হচ্ছে ভোজ্যতেল, ডাল ও চিনি। এগুলো জুগিয়ে যেতে পারাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেননা বিশেষ করে ভোজ্যতেলের বাজার অস্থিতিশীল। স্মার্ট কার্ডের উল্লেখযোগ্য অংশ বাতিল হওয়ায় এর বিপরীতে আপাতত খাদ্যদ্রব্য দিতে হচ্ছে না, এটাও সত্য। সরকারকে এখন ওই পরিমাণ সঠিক স্মার্ট কার্ড দিয়ে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোয় খাদ্যদ্রব্য জোগাতে হবে। সর্বসাধারণের জন্য ‘ট্রাক সেল’ বন্ধ না করে তা আরও বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তাও রয়ে গেছে। নিম্নমধ্যবিত্তের একাংশকেও হালে এর লাইনে এসে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছিল। খাদ্য উপদেষ্টা বলেছেন, মার্চ থেকে ৫০ লাখ পরিবারকে ১৫ টাকা দরে মাসে ৩০ কেজি চাল জোগানো হবে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে। জরুরি ভিত্তিতে পৌনে দুই লাখ টন চাল সরকারিভাবে আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সম্ভবত এ প্রেক্ষাপটেই।
ততদিনে রমজানও শুরু হয়ে যাবে। অতীতে আমরা দেখেছি, রমজানেও চালের বাজার অশান্ত। এ সময়টায় চালের চাহিদা বাড়ার কথা নয়। তারপরও এর বাজার অশান্ত হওয়ার কারণ নিশ্চয় থাকত। তা কখনো যথাযথভাবে অনুসন্ধান করে দেখা হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে এবার আমরা দেখতে চাইব, রমজানে চালের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য নিত্যপণ্যের বাজারও স্থিতিশীল। সরকার এ লক্ষ্যে আগেভাগেই কর-শুল্কে বড় ছাড় দিয়ে আমদানি স্বাভাবিক রাখার পদক্ষেপ নিয়েছে। তাতে সরকার রাজস্ব হারাবে, সন্দেহ নেই। বিনিময়ে এর সুফল যেন পায় ভোক্তাসাধারণ। মজুত বাড়াতে এবং খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিগুলো জোরদার করতে সরকার যে চাল আমদানিতে উদ্যোগী হয়েছে, তাতে কম অর্থ ব্যয়ও হবে না। এগুলো অবশ্য জনগণেরই অর্থ। তাদের কল্যাণে এটা ব্যয় হলে কারও আপত্তির কারণ নেই।
এ কার্যক্রম দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বরং দেখতে চাইব, বোরো মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উৎপাদন নিশ্চিত করতে সরকার কোনো সহায়তা জোগাতে কার্পণ্য করছে না। আবহাওয়ার দিক দিয়ে অনুকূল এ মৌসুমে উৎপাদন কিন্তু ব্যাহত হতে পারে কৃষকের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকলে; সার ও জ্বালানি সররবাহে জটিলতা সৃষ্টি হলে। তা যাতে কোনোভাবেই না হয় আর এতে করে চাল আমদানির প্রয়োজনীয়তাও যেন কমে আসে, সেটা নিশ্চিত করাকেও চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিতে হবে এখন।
হাসান মামুন : সাংবাদিক, কলামিস্ট