Logo
Logo
×

বাতায়ন

সংস্কারের সীমা-পরিসীমা

Icon

ড. মাহফুজ পারভেজ

প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সংস্কারের সীমা-পরিসীমা

অবক্ষয়, অচলাবস্থা, অব্যবস্থার অবসানের জন্য প্রয়োজন হয় সর্বাত্মক পরিবর্তনের, যা সম্পন্ন হতে পারে বিপ্লব কিংবা সংস্কারের পথে। নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় যখন অধোগতি রোধ কিংবা প্রতিরোধ করা মোটেও সম্ভব হয় না, তখন বিপ্লবাত্মক পরিস্থিতির মাধ্যমে সবকিছু তছনছ করে নতুন স্বপ্নের বুনন করা হয়।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে তেমনই এক ঐতিহাসিক বৈপ্লবিক কালপর্ব, যখন ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের অবসানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসেছে।

জুলাই-আগস্ট (২০২৪) পরিবর্তনের ফলে গঠিত সরকার গতানুগতিক রাজনৈতিক দলের সরকারগুলোর মতো নয়। তারা দলীয় সরকার নয় বলে তাদের সামনে দলীয় মতাদর্শভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডাও থাকার কথা নয়। তাদের সামনে রয়েছে দুটি জাতীয় আকাঙ্ক্ষা, যা আন্দোলনের রাজপথ থেকে উত্থিত ও গৃহীত হয়েছে।

এক. বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা অনুসারে বৈষম্য দূর করে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন করা এবং দুই. অগণতান্ত্রিক ও অবৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে যে স্বৈরাচারী-ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার যতদূর সম্ভব অবসান ঘটানো।

নিঃসন্দেহে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজই হলো জুলাই বিপ্লবের মূল কাণ্ডারি এবং বর্তমান সংস্কারযজ্ঞের নেপথ্য চিন্তাশক্তি ও প্রয়োগের অন্যতম প্রধান নায়ক। তবে এ কাজ শুধু একার বিষয় নয়, যৌথভাবে অনেকেরই অবদান এ সাফল্যের পেছনে রয়েছে।

এ কারণে, বর্তমান রাজনৈতিক শক্তির ক্ষমতার বিন্যাস রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক পরিসরে বিবেচনার দাবি রাখে। সাধারণত ক্ষমতাকাঠামো বা পাওয়ার স্ট্রাকচার নিয়ে যে আলোচনা হয়, তাতে রাষ্ট্র, রাজনীতি ও ক্ষমতার বিন্যাস দৃশ্যমান হয়। এ বিষয়টি মোটেও গোপন কিছু নয়। বিশ্বের সব দেশেই প্রকাশিত বিষয়।

জুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতাকাঠামো সম্পর্কে জানার আগে উল্লেখ করা দরকার, যে কোনো রাষ্ট্রের, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে কোনো সরকারের একটি মূল চালিকাশক্তি থাকে। আর তা হলো ক্ষমতাসীন দল ও সে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। বিশ্বের সব দেশেই এমনটি হয়। সাধারণত রাজনৈতিক সরকারের ক্ষেত্রে এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক।

কিন্তু জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশে যেহেতু বর্তমানে কোনো দলীয় সরকার ক্ষমতায় নেই, সেহেতু বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তির আসনে কোনো রাজনৈতিক দল ও তাদের শীর্ষ নেতৃত্ব আসীন নেই। বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা বর্তমানে তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী নয়, তিনটি অরাজনৈতিক স্তম্ভ পরিবর্তিত বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তি হয়ে কাজ করছে।

বাংলাদেশের তিন চালিকাশক্তির সর্বাগ্রে রয়েছে ছাত্রদের নেতৃত্ব। যে নেতৃত্ব ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করে বৈষম্য মুক্তির পথ রচনা করেছে। বর্তমান বাংলাদেশের আরেক প্রধান চালিকাশক্তি হলেন ড. ইউনূস। যার ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব, দক্ষতা ও ভাবমূর্তির ওপর আস্থা রেখেছে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা। যে আস্থার ছাপ বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদ ও বৈষম্যবিরোধী জনতার মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। একই সঙ্গে ড. ইউনূস পুরো বিশ্বকে তার নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল ও বিশ্বাসী করতে সক্ষম হয়েছেন।

সমগ্র বিশ্ব তার নেতৃত্বকে নিঃসঙ্কোচে মেনে নিয়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং নানা ক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতার দ্বার উন্মোচিত করে দিয়েছে। তৃতীয় যে চালিকাশক্তি বাংলাদেশকে ঐক্যবদ্ধ ও সংহত করেছে, তা হলো দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী। বিশেষত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবের পর দেশ যখন শৃঙ্খলাহীন এক গভীর শূন্যতা ও নৈরাজ্যের দিকে ধাবিত হচ্ছিল, তখন দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী দেশকে সংঘাত ও হানাহানিমুক্ত করেছে, নাগরিকদের জানমালের হেফাজত করেছে এবং দেশের নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করেছে। দেশ ও জাতির স্বার্থে সেনাবাহিনীর অবদান মানুষের আস্থা অর্জন করেছে।

এ রাজনৈতিক বিন্যাসের ধারাবাহিকতায় কাজ করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যারা বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চায়, যাতে ফ্যাসিবাদ আর ফিরে আসতে না পারে। এজন্য রাষ্ট্র ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংস্কারের ক্ষেত্রে সংবিধানের প্রসঙ্গ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেলেও নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশনের সংস্কার, পুলিশ সংস্কার ও স্থানীয় সরকার সংস্কারের গুরুত্ব অপরিসীম।

রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রাজনীতিকরণের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি কলঙ্কিত ও বিতর্কিত করা হয়েছে পুলিশকে। ১৪ জানুয়ারি প্রকাশিত আন্তর্জাতিক ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস প্রজেক্ট (আইটিজেপি) এবং টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের (টিজিআই) প্রতিবেদনে উঠে এসেছে কীভাবে আমাদের পুলিশকে নিষ্ঠুর, অমানবিক ও রক্তপিপাসু বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে। এটি প্রমাণ করে, আমাদের পুলিশ বাহিনীকে জনবিরোধী প্রতিষ্ঠান থেকে সম্পূর্ণরূপে জনবান্ধব প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা কতটা জরুরি এবং এ কাজটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং।

কারণ, পেশাদার, রাজনীতি ও দুর্নীতিমুক্ত পুলিশ বাহিনী প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে, সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। বিশেষ করে, দীর্ঘ অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক হুকুম মান্য করার মাধ্যমে পুলিশের নৈতিক মান ও পেশাগত দক্ষতার বিরাট অবক্ষয় ঘটেছে। সংস্কার কমিশনকে এসব সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা অতিক্রমের পথ দেখাতে হবে।

কমিশনের সুপারিশগুলো অবশ্যই জাতীয় আলোচনার বিষয় হতে হবে, যার ভিত্তিতে এসব বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্যের পথ রচিত হবে। এজন্য সুপারিশগুলোকে উন্মুক্ত ও প্রকাশ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। রাজনৈতিক সংলাপের পাশাপাশি সংস্কারের বিষয়বস্তু ও অন্তর্নিহিত মর্মবস্তু সম্পর্কে ব্যাপক জনআলোচনা হওয়াও জরুরি। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে গঠনমূলক সমালোচনা ও মতামত প্রকাশের পরিসর দিতে হবে এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাইরে অবস্থিত সিভিল সোসাইটির প্রতিটি অংশকেই সুপারিশ সম্পর্কে স্বাধীনভাবে পরিজ্ঞাত হওয়ার এবং মত প্রদানের সুযোগ দিতে হবে।

সংস্কার প্রস্তাব যারা দিয়েছেন, অবশ্যই তারা পণ্ডিত ব্যক্তি। তবে, তাদের বাইরেও দেশে যেসব বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, তাদের পালটা বা ভিন্নমত থাকলে সেগুলোকেও তুলনামূলকভাবে পর্যালোচনা করে দেখার দরকার আছে। এসব চর্চা না করা হলে সংস্কার একরৈখিক হয়ে যেতে পারে এবং সংস্কারের সীমার মধ্যে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে না।

একইভাবে, রাজনৈতিক দল, শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিদের দায়িত্ব নিয়ে এ আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে দৃষ্টান্তমূলক মতামত ব্যক্ত করতে হবে। রাজনৈতিক বিরোধিতা বা নামকাওয়াস্তে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়ের গভীরতাকে ক্ষুণ্ন করা সমীচীন হবে না। সবাইকে সুচিন্তিত সমালোচনা এবং বিবেচনাযোগ্য বিকল্প প্রস্তাব হাজির করার মানসিকতা দেখাতে হবে। এর ফলে সুপারিশগুলো আরও ঋদ্ধ ও লাগসই হবে বলে আশা করা যায়।

বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত সমাজে অন্তত সংস্কারের বিষয়ে সব পক্ষকেই জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। দলীয় বা গোষ্ঠীগত বিবেচনার বাইরে এসে দাঁড়াতে হবে সব পক্ষকে। নিজেদের মধ্যকার ছোট-বড় দ্বন্দ্বকে সংস্কারের ইস্যুর মধ্যে টেনে আনাও মোটেই কাম্য হবে না। ‘ঐকমত্য কমিশন’ যখন সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ চালাবে, তখন সংস্কার, জাতীয় স্বার্থ ও ঐকমত্যই হবে মূল আলোচ্য বিষয়, দলীয় দ্বন্দ্ব-সংঘাত এক্ষেত্রে যেন প্রাধান্য পেতে না পারে।

অতএব, রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে, এ পুরো প্রক্রিয়াটিকে আন্তরিকতা, দায়িত্বশীলতা ও সততার সঙ্গে গ্রহণ করা। তারা যেন যুক্তি ও তথ্য দিয়ে সংস্কার প্রসঙ্গে আলোচনা করে এবং শেষ পর্যন্ত একটি ঐকমত্যে পৌঁছায়, যার ভিত্তিতে তারা নিজেদের মধ্যে এমন একটি চুক্তি ও অঙ্গীকারে উপনীত হবে, জনগণের ভোটের বাইরে কোনো নির্বাচন কেউ মানবে না। সবাই নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে।

নতুন সংসদে প্রস্তাব পাশের মাধ্যমে সংবিধান ও প্রাসঙ্গিক আইন সংশোধন করে এগুলো নিষ্ঠার সঙ্গে পালনের উদ্দেশ্যে আমাদের শাসন কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করবে। তাহলেই সংস্কার ও নির্বাচনের মধ্যে একটি কার্যকর সমন্বয় সাধিত হবে এবং সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে সূচিত ঐকমত্য ভবিষ্যতের বাংলাদেশে বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য ও ঐকমত্যের পথ প্রশস্ত করবে।

সংস্কারের সীমায় ফ্যাসিবাদ ছাড়া বাকি সব রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তিকে আনা হলে এবং সংস্কারের পরিসীমার মধ্যে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে ক্ষমতায় আসা আর সংঘাত, বিতর্ক ও রক্তপাত ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর বা রাজনৈতিক পালাবদলের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা রাখা হলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ মসৃণ করা অবশ্যই সম্ভব হবে।

ড. মাহফুজ পারভেজ : প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম