স্থানীয় সরকার : যথাযথ সংস্কার চাই
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
মোশাররফ হোসেন মুসা
প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![স্থানীয় সরকার : যথাযথ সংস্কার চাই](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2025/01/25/Post-Musa-motif-67941a9a996d4.jpg)
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের নিমন্ত্রণ পেয়ে ৮ জানুয়ারি সকাল ১০টায় আগারগাঁওয়ের জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউট (এনআইএলজি) ভবনে উপস্থিত হয়ে এবং কমিশনের খসড়া রিপোর্ট পড়ে যতটুকু জানতে পেরেছি তা হলো, তারা স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে পুরোপুরি পালটে ফেলতে চান। কমিশন একটি মহাপরিকল্পনা প্রস্তুত করে সরকারের কাছে জমা দিতে যাচ্ছে। সেদিনকার মতবিনিময় সভায় কমিশনপ্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ এবং কমিশনের পাঁচজন সদস্য ছাড়াও পৌরসভার দুজন মেয়র, জেলা পরিষদের একজন সাবেক সদস্য, দুজন ইউপি চেয়ারম্যান, দুজন ইউপি মেম্বার, দুজন ইউপি প্রশাসনিক কর্মকর্তা (সচিব), একজন গ্রামপুলিশ ছাড়াও সাংবাদিক ও এনজিও ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেন। কমিশন গোটা স্থানীয় সরকারব্যবস্থার পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে যে খসড়া প্রস্তাব তৈরি করেছে, এর ওপর পরামর্শ কামনা করেন। অনুরূপ মতবিনিময় সভা দেশের বিভিন্ন স্থানে চলমান রয়েছে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যেই সরকারের কাছে রিপোর্ট জমা দেওয়ার ইচ্ছা রয়েছে কমিশনের। তাদের প্রস্তাবে রয়েছে স্থানীয় সরকারে পার্লামেন্ট পদ্ধতি বাস্তবায়নের কথা, যেহেতু কেন্দ্রে পার্লামেন্ট পদ্ধতি অথচ স্থানীয়তে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি, এক দেশে দুই পদ্ধতি সাংঘর্ষিক। স্থানীয় সরকারব্যবস্থা হবে তিন স্তরবিশিষ্ট। জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ। ইউনিয়ন পরিষদের ভোটাররা তিনটি ভোট দেবেন, প্রথমে নিজেদের মেম্বারদের, তারপর উপজেলা পরিষদের মেম্বারদের, অবশেষে জেলা পরিষদ মেম্বারদের নির্বাচন করবেন। পৌরসভার ভোটাররা তিনটি ভোট দেবেন, প্রথমে নিজেদের কাউন্সিলরদের, এরপর উপজেলা পরিষদের সদস্যদের, তারপর জেলা পরিষদ মেম্বারদের। সিটি করপোরেশন ভোটাররা দুটি ভোট দেবেন। প্রথমে নিজেদের কাউন্সিলরদের, পরে জেলা পরিষদের মেম্বারদের। ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বাররা নিজেদের মধ্যে একজনকে চেয়ারম্যান, পৌরসভা/সিটি করপোরেশন কাউন্সিলররা নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে মেয়র নির্বাচিত করবেন। অনুরূপভাবে জেলা পরিষদে নির্বাচিত মেম্বাররা নিজেদের মধ্যে একজনকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করবেন।
অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, গ্রাম সালিশি ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক থাকায় এটি উপজেলা আদালতের অধীনে নিয়ে আসার চিন্তাভাবনা চলছে। বিষয়টিকে শুধু স্থানীয় সরকার নয়, গোটা সরকারব্যবস্থাকে পালটানোর সঙ্গে তুলনা করা যায়। যেহেতু স্থানীয় সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ভারত ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর প্রথমে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারকে একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসে। সেই সঙ্গে স্বাধীন বিচার বিভাগ ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে ‘পঞ্চায়েত’ ব্যবস্থার ইতিহাস দীর্ঘকালের। ঋগ্বেদে ‘সভা’ শব্দটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যেসব গ্রামে জনসমষ্টি ছিল, সেখানেই পঞ্চায়েত শাসনের ব্যবস্থা ছিল। মোগল শাসকরা পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় তেমন পরিবর্তন আনেনি। ব্রিটিশ আমলে এ ব্যবস্থাটি অবহেলিত হয়। ১৮৫৭ সালের পর পঞ্চায়েতকে ছোটখাটো অপরাধ দমন এবং গ্রামের বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষমতা দিয়ে ব্যবস্থাটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা হয়। ১৮৭০ সালে ভাইসরয় লর্ড মেয়ো চৌকিদারি অ্যাক্ট পাশ করে ব্যবস্থাটিকে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে আনার চেষ্টা করেন। তারপর অবস্থার পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৭ ও ১৯১৯ সালে স্থানীয় সরকারের জন্য বিভিন্ন আইন পাশ করা হয়। ১৯২৫ সালে আটটি প্রদেশে পঞ্চায়েত পদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য আইন পাশ হয়। ভারত ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ রাজশক্তি থেকে মুক্ত হয়ে গণপরিষদের ১১টি অধিবেশনে মিলিত হয় ও ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধান লিপিবদ্ধের কাজ শেষ করে। এর দুইদিন পর তথা ২৬ জানুয়ারি থেকে সংবিধান কার্যকর হয়। সেজন্য ভারতে ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস পালিত হয়। তাদের সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রীয় এবং এতে শুরু থেকেই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা ও স্বাধীন বিচার বিভাগ কার্যকর রয়েছে। ত্রিস্তরীয় সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান; তথা কেন্দ্র, রাজ্য ও স্থানীয়। কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার শুরু থেকেই কার্যকর থাকলেও স্থানীয় সরকার সব রাজ্যে একই পদ্ধতিতে কার্যকর থাকেনি।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বাংলাদেশের লাগোয়া হওয়ায় এ রাজ্যের স্থানীয় সরকারব্যবস্থার উদাহরণ সবাই দিয়ে থাকেন। ১৯৭০ সালে প্রথম সর্ববঙ্গীয় গ্রামীণ চৌকিদারি পঞ্চায়েতের মাধ্যমে আধুনিক পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ১৯৫৭ সালে পশ্চিমবঙ্গীয় চৌকিদারি আইন পাশ হয়। ১৯৫৭ ও ১৯৬৩ সালের আইনানুসারে পশ্চিমবঙ্গে চার স্তরবিশিষ্ট পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হয়। ১৯৭৩ সালে নতুন আইনের মাধ্যমে ত্রিস্তরবিশিষ্ট পঞ্চায়েত ব্যবস্থা; তথা পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ ব্যবস্থা গৃহীত হয়। ১৯৯১ সালে ভারতীয় সংবিধানের ৭৩তম সংশোধনী অনুসারে পঞ্চায়েতিরাজ চৌকিদারি পঞ্চায়েতকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্বীকৃতি ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয়। এরপর ১৯৯২ সালে পশ্চিমবঙ্গে পশ্চিমবঙ্গীয় চৌকিদারি পঞ্চায়েত আইনটিকে পুনঃসংশোধিত করা হয়। সেখানে গ্রামীণ স্থানীয় সরকারগুলো স্বশাসিত এবং পঞ্চায়েত মন্ত্রী দ্বারা পরিচালিত হয়। পশ্চিমবঙ্গে ১১৮টি পৌরসভা ও সাতটি পৌর করপোরেশন রয়েছে। এগুলো জেলার অধীন নয়, বিভাগের অধীন এবং পৌরমন্ত্রী দ্বারা পরিচালিত হয়। কেরালা রাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ১৯৯৪ সালের পঞ্চায়েত রাজ্য আইনানুসারে পরিচালিত হয়। উল্লেখ্য, ভারতে আগে বেশ কয়েকটি রাজ্যে বর্ণভিত্তিক পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ছিল। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসে এ ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটায়। তারা পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় সরকার পদ্ধতিকে মডেল হিসাবে ধরে ধীরে ধীরে সব রাজ্যে পরিবর্তন আনে।
এদেশে এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের এমপিদের কাজই সুনির্দিষ্ট করা সম্ভব হয়নি, সেক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারে পার্লামেন্ট পদ্ধতি কতটুকু সুফল বয়ে আনবে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। চেয়ারম্যান ও মেয়র পদটির একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। এটি রাতারাতি বিলুপ্ত করা ঠিক হবে না। চেয়ারম্যান-মেম্বারদের এবং মেয়র-কাউন্সিলরদের ক্ষমতার ভারসাম্য আনার জন্য বিভিন্ন মেকানিজম রয়েছে। গ্রাম সালিশে পক্ষপাতিত্বের অজুহাত তুলে এটিকে উপজেলা আদালতে আনার চিন্তা করা হচ্ছে। এদেশে গ্রাম সালিশের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এ সালিশে মানুষ সত্য স্বীকারোক্তি দেয়, তাতে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয়। একই অভিযোগ কোর্টে গেলে তার বিপরীত কর্মকাণ্ড ঘটতে দেখা যায়। সেজন্য ক্ষমতার পৃথক্করণ তত্ত্ব অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে পৃথক বিচারকের অধীনে আদালত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাছাড়া স্থানীয় সরকারের স্তরবিন্যাসের কথা সুস্পষ্ট নয়। সিটি করপোরেশনের ভোটাররা জেলা পরিষদের মেম্বারদের ভোট দেবে। সিটি করপোরেশনের মেয়রদের মন্ত্রীর পদমর্যাদা দেওয়া হয়। তাহলে প্রশ্ন এসে যায়, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদমর্যাদা কী হবে? সেজন্য উপজেলার আয়তন থেকে পৌরসভাকে বাদ দিতে হবে এবং জেলাকে গ্রামীণ ও নগরীয় স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ স্তর করতে হবে। জেলাকে প্রদেশের বিকল্প হিসাবে কার্যকর করতে হবে এবং জেলার প্রতিনিধি নিয়ে আইনসভার উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করতে হবে। তবে যে কাজটি ১৯৭২ সালে করা উচিত ছিল, সেটি এখন করতে হচ্ছে। সেজন্য জাতীয় সরকার ও স্থানীয় সরকারের গণতান্ত্রিককরণের কাজ একই সঙ্গে সুসম্পন্ন করতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, দীর্ঘদিন রাজনৈতিক দলগুলো স্থানীয় সরকারকে লাঠিয়াল হিসাবে ব্যবহার করায় এ কাজগুলো এখন অনির্বাচিত সরকারকে করতে হচ্ছে।
মোশাররফ হোসেন মুসা : গণতন্ত্রায়ণ ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক