আমার দেখা ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক
ড. আবু এন এম ওয়াহিদ
প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
একেবারে ছোটবেলায় লেখাপড়ায় হাতেখড়ি মায়ের কাছে। রান্নাঘরে মা একদিকে ভাত-তরকারি রাঁধতেন, আরেকদিকে আমি ও আমার ছোট ভাই মেঝেতে মাদুর পেতে বর্ণমালার বই খুলে বসতাম। তারপর ঘরোয়া পরিবেশের বাইরে প্রথম ওস্তাদের সংস্পর্শে আসি, যখন মক্তবে যাই আরবি শিখতে। আরেকটু বড় হলে পাঠশালা, তারপর হাইস্কুল। অবশেষে কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে সাঁতরাতে শুরু করি জ্ঞানের সাগরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত পরিবেশে। এখনো সে সমুদ্র উপকূলের কাছেই হাবুডুবু খাচ্ছি। সাগর পাড়ি দেওয়া তো দূরের কথা, মাঝদরিয়াতেও যেতে পারিনি। তদ্দূর যাওয়ার আগেই কোনো একদিন জীবনতরি যে চিরতরে ডুবে যাবে, তাতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। যে পারিবারিক পরিবেশ ও সংস্কৃতিতে বড় হয়েছি, সেখানে প্রথম শিখেছি মা-বাবা, কিংবা শিক্ষকদের সঙ্গে কখনো বেয়াদবি করতে নেই। তর্ক-বিতর্কের তো প্রশ্নই ওঠে না। ফলে অল্প বয়সে শিক্ষকরা ভুল-শুদ্ধ যাই পড়িয়েছেন, তাই সহি সমঝে সুবোধ বালকের মতো শিখে নিয়েছি। লেখাপড়া কিংবা জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে শিক্ষক বা যে কারও সঙ্গে বিতর্কে জড়ানো যে বেয়াদবি নয়, সেটি তখন জানতাম না। জানলে হয়তো গোড়া থেকে নিজেকে আরও অনেক মজবুত করে গড়ে তোলার সুযোগ পেতাম। তবুও আপন বুদ্ধিবৃত্তিকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে আমি যতটা সুযোগ পেয়েছি, অনেকের ভাগ্যে হয়তো তাও জোটে না। দেশে থাকতে ছাত্রাবস্থায় শিক্ষকদের যেমন সমীহ ও শ্রদ্ধা করেছি, তেমনই নিজে শিক্ষক হয়ে ছাত্রছাত্রীদের থেকে সে সম্মানের পুরোটাই আদায় করে নিয়েছি। অবশ্য এতে আমার যেমন কোনো কৃতিত্ব নেই, তেমনই শিক্ষার্থীদেরও নেই কোনো আনুকূল্যের অবকাশ। এটি নিতান্তই আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ ও সমাজের নিয়মকানুন। উচ্চতর লেখাপড়ার জন্য যখন বিদেশে এলাম, তখন এ মূল্যবোধে বড় ধরনের এক ধাক্কা খেলাম। চর্মচোখে নতুন কিছু দেখতে দেখতে মনের চোখও খুলে গেল। আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম, আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতির যেমন একটা ভালো দিক আছে, তেমনই আছে এর এক মারাত্মক দুর্বল দিকও। আগে যাই ভাবি না কেন, আমার এখনকার বিবেচনায়, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মধ্যে আছে দুটি মাত্রা। প্রথমটি হলো শিক্ষকদের সমীহ করা, সম্মান করা। তাদের সঙ্গে বেয়াদবি না করা। সবসময় তাদের কথা শোনা, ইত্যাদি। এ সম্পর্কে আজকের নিবন্ধে কিছু অনুভূতির কথা বলব। এর মধ্যে কিছু ছাত্র হিসাবে, কিছু শিক্ষক হিসাবে আমার অভিজ্ঞতা।
দেশ থেকে এমএ পাশ করে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রথম যখন কানাডা আসি, তখন বুঝতে পারি, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে মানসম্মানের বিষয়টি এ দেশে ষোলো আনাই অনুপস্থিত। বিষয়টি আমার কাছে প্রথম প্রথম খুবই দৃষ্টিকটু লাগত। পরে গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল। পাঠকের জন্য ঘটনাটা আরেকটু খোলাসা করে বলা প্রয়োজন। কানাডার ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বছর গ্র্যাজুয়েট মাইক্রো ইকোনমিক্সের ক্লাসে একদিন গিয়ে দেখি, এক শ্বেতাঙ্গ কানাডিয়ান সহপাঠী বই-খাতা টেবিলের ওপর রেখে জুতাসহ পা দুখানি টেবিলের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে চিত হয়ে আধা শোয়া, আধা বসা অবস্থায় বিশ্রাম নিচ্ছে। ক্লাসে শিক্ষার্থী ছিলাম দশজনেরও কম। একটি বড় কনফারেন্স টেবিলের তিনদিকে চেয়ার টেনে বসতাম। প্রফেসররা দেওয়ালে লটকানো ব্ল্যাক বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতেন। যে দিনের কথা বলছি, সেদিন স্যার সময়মতো ক্লাসে এসে ঢুকলেন। ছাত্রছাত্রীদের উঠে দাঁড়ানোর কোনো রেওয়াজ নেই। এর প্রশ্নই ওঠে না। আমরা সবাই যার যার চেয়ারে বসা। ওই ছেলেটিও সবার মতো যেভাবে ছিল, সেভাবে ঠায় টেবিলের ওপর পা তুলে বসেই রইল। কিছুই বলতে পারছিলাম না। কিন্তু আমার খুব অস্বস্তি লাগছিল। স্যার ‘গুড ইভিনিং এভরি ওয়ান’ বলে পড়াতে শুরু করে দিলেন। তিন ঘণ্টার ক্লাস, হাফ টাইমের পর ছেলেটি ১৫ মিনিটের ব্রেকের সময় সবার সঙ্গে কফি খেতে বেরিয়ে গেল। তখনই ওইদিনকার মতো আমারও অস্বস্তির অবসান হলো; কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আরও দেখলাম-ছাত্রছাত্রীরা প্রফেসরদের স্যার বলে সম্বোধন করে না। কখনো প্রফেসর অমুক, কখনো বা ড. অমুক, কখনো শুধু নাম ধরেই ডাকে। আমাদের দেশীয় রীতিনীতিতে আদবকায়দা বলতে যা বোঝায়, উত্তর আমেরিকায় এর তেমন কোনো বালাই নেই। এগুলোর কেউ ধার ধারে না। এ নিয়ে কেউ মাথাও ঘামায় না। এসব এ সমাজে নিতান্তই গৌণ ব্যাপার। অথচ আমাদের সমাজে এটাই মুখ্য। এখানে নাম ধরে ডাকার ব্যাপারে আমার আরেকটি ছোট্ট মজার অভিজ্ঞতার কথাও বলা দরকার। ম্যানিটোবাতে একই বছর আমাদের ম্যাক্রো ইকোনমিক্স পড়াতেন এক গ্রিক প্রফেসর। পরে তিনি আমার পিএইচডি থিসিস সুপারভাইজার হয়েছিলেন। তার নাম ছিল ‘কন্স্টেন্টাইন আলেকজান্ডার নিকোলাও’। ডিপার্টমেন্টের অন্য প্রফেসররা অর্থাৎ তার সহকর্মীরা তার কঠিন নামের প্রথম অংশকে (First name) সহজ ও সংক্ষেপ করে ডাকতেন-‘কস্টাস’। আমি জানতাম, এ দেশে তো প্রফেসরদের নাম ধরে ডাকা কোনো বেয়াদবি নয়, তাই একদিন পরীক্ষার গ্রেড জানতে প্রফেসরের বাড়িতে ফোন করে বলেছিলাম, ‘ম্যা আই স্পিক টু কস্টাস’? প্রফেসর নিকোলাও নিজেই ফোন ধরেছিলেন, তিনি আমার ধৃষ্টতায় মোটেও রাগ হননি। ধীরস্থির-ভরাট কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘The name is Nicolao’। প্রফেসর নিকোলাও সেদিন নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন, ওটি আমার অজ্ঞতাবশত ভুল। ইচ্ছাকৃত বেয়াদবি নয়; তখন আমি জানতাম না, ঘনিষ্ঠ জানাশোনা না থাকলে কারও অনুমতি ছাড়া তাকে ‘নামের প্রথম অংশ’ ধরে ডাকা-পশ্চিমা সংস্কৃতির রীতি অনুযায়ী এটা অনুচিত। সেদিন আমি খুব বিব্রতবোধ করেছিলাম। এরপর থেকে অনুমতি ছাড়া কাউকে তার প্রথম নামে ডাকার সাহস দেখাই না।
এবার বলছি শিক্ষক হিসাবে আমার অভিজ্ঞতার কথা। বিদেশে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গিয়ে সম্মানের সম্পর্কটাকে অনেকভাবে অনুভব করেছি। অনেক সময় অকারণে ব্যথাও পেয়েছি। ক্লাসে কোনো একাডেমিক ব্যাপারে কিংবা যেখানে ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থ সরাসরি জড়িত, সেসব ব্যাপারে আমি শিক্ষার্থীদের প্রতি খুবই উদার এবং তাদের প্রতি খুবই সংবেদনশীল। প্রথম দিনই আমি আমার ক্লাসের ছেলেমেয়েদের এ বিষয়ে পূর্ণ অধিকার দিয়ে রাখি। তারা কোনো সময় সে অধিকারের চর্চা করে, অনেক সময় করেও না। প্রথমদিকে শিক্ষার্থীরা ক্লাসের ভেতর বা বাইরে যখন নাম ধরে ডাকত অথবা ক্লাসে মামুলি বিষয়ে বেয়াদবি করত, (অবশ্য আমার দেশীয় মূল্যবোধের বিবেচনায়) তখন খুব খারাপ লাগত। এখন আর তেমন অসুবিধা হয় না। বিষয়টিকে সাধারণভাবে নিতে শিখে গিয়েছি। প্রতিবছর শত শত ছেলেমেয়ে আমার কোর্সে ভর্তি হয়। নিতান্তই হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া কারও নাম মনে রাখা সম্ভব হয় না। যাওবা থাকে, দুই-এক সেমিস্টারের ব্যবধানে তাও ভুলে যাই। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে শুধু মুখেই চিনি। নাম রপ্ত করার আগেই সেমিস্টার সমাপ্ত হয়ে যায়।
বেশ কয়েক বছর আগে একবার এক মেয়ে ক্যাম্পাসের ভেতরে আমাকে দেখে ‘হায়’ বলেছিল। আমি তাকে চিনতে পারিনি। কেন তাকে চিনতে পারলাম না, সেজন্য ছাত্রীটি আমার ওপর ভীষণ রাগ করেছিল। সে আমাকে রীতিমতো অভিযুক্ত করে বসল-তাকে অপমান করার দায়ে। অথচ ছাত্ররা যখন আমাদের চিনতে পারে না, তখন আমাদের পক্ষে রাগ করার কোনো অবকাশই থাকে না। এ দেশে একটা কথা প্রচলিত আছে-‘Students matter most’। অর্থাৎ ‘শিক্ষার্থীদের স্বার্থই সবকিছুর ওপরে।
আরেকটি ভীষণ বিব্রতকর অভিজ্ঞতার কথা বলি-বছর দশেক আগে, আমার পরিসংখ্যান ক্লাসে একটি ইথিওপিয়ান ছাত্রী পেয়েছিলাম। সুদীর্ঘ ৪৩ বছরের শিক্ষকতা জীবনে তার চেয়ে তুখোড় ও তেজি ছাত্র কিংবা ছাত্রীর সাক্ষাৎ আমি কোনো দেশে কোথাও পাইনি। আজ মেয়েটির নামের আদি অংশটাই কেবল মনে আছে-‘হেলেন’। প্রথম দিনই টের পেয়েছিলাম, হেলেনের জন্য প্রতিটি ক্লাসে যথাযথভাবে নিখুঁত প্রস্তুতি নিয়েই আমাকে আসতে হবে। সেভাবেই আমি পুরো সেমিস্টার পারও করেছিলাম। এতে আমার যে অসুবিধা হয়েছিল, এর চেয়ে বড় সমস্যা হয়েছিল ক্লাসের অন্য ছাত্রছাত্রীদের। হেলেন আমাকে প্রায় প্রতিদিন এমন সব প্রশ্নবাণে ব্যস্ত রাখত এবং এমন সব আলোচনার সূত্রপাত ঘটাত-যা কি না শ্রেণিকক্ষে সে এবং আমি ছাড়া আর কেউই বুঝত না। আরও কিছুদিন পর টের পেলাম-তার তেজ ও ক্ষিপ্রতার কাছে আমিও কিছু না। সেদিন সে আমাকে দারুণ বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল। পরীক্ষার ঠিক আগে ‘রিভিউ ক্লাসে’ হাতের নোট দেখে দেখে আমি সাদা বোর্ডে একটি সূত্র লিখে সবাইকে বলেছিলাম-এ ফর্মুলাটা তোমরা মুখস্থ করে নিও, কাজে লাগবে। মুখের কথা শেষ হতে না হতেই, হেলেন বলে বসল, ‘তুমি নিজেই যেটা মুখস্থ করতে পারনি, সেটা আমরা কীভাবে করব?’ সাহসী হেলেনের প্রত্যুৎপন্ন সওয়ালে মুহূর্তের মধ্যে আমি হতভম্ব। কীভাবে সেদিন নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম, এখন মনেও নেই। তবে এ কথা মনে আছে-চোর পালালে যেমন বুদ্ধি বাড়ে, তেমনই সেদিন অফিসে এসে অনেকক্ষণ ভেবে হেলেনের প্রশ্নের একটি উত্তর বের করেছিলাম। কিন্তু কোনোদিন মেয়েটিকে বলা হয়নি। হেলেনের মতো উপস্থিত বুদ্ধি থাকলে তার প্রশ্নের উত্তরে আমি সঙ্গে সঙ্গে বলতে পারতাম, আমি যখন তোমার বয়সে তোমার মতো ছিলাম, তখন এ সূত্রটি আমার মুখস্থই ছিল। আরও বলতে পারতাম, আর কেউ না পারলেও তুমি সহজেই মুখস্থ করতে পারবে।
পাশ্চাত্যের শিশুরা ছোটবেলা থেকেই ছাপার অক্ষরের লেখা দেখলেই বেহুঁশ হয়ে মুখস্থ করে না, বোঝার চেষ্টা করে। এটা কী? ওটা কী? এটা এরকম কেন? ওটা এরকম না হয়ে ওরকম হয় না কেন-এমন হাজারো প্রশ্নবাণে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সবসময় ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। শিক্ষকরাও এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হন না, বিরক্তও হন না। তাদের দায়িত্ব ছাত্রছাত্রীদের মনে একটা প্রশ্নের জবাবের সঙ্গে আরও তিনটা প্রশ্ন করার তাগিদ সৃষ্টি করা। একাডেমিক ব্যাপারে, জ্ঞানের ব্যাপারে ক্লাসের ভেতরে-বাইরে শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীর তর্ক-বিতর্কের কোনো শেষ নেই। অনবরত ও চলমান এ বিতর্কের মধ্যেই ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে প্রকৃত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর এ সম্পর্ক হয় অনেক গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের এটাই গুরুত্বপূর্ণ দিক। পাশ্চাত্য জগতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের এ মাত্রারই অনুশীলন হয়ে থাকে অধিক। আদবকায়দা প্রথম হলে, এটাকে আমি বলছি দ্বিতীয় মাত্রা।
ইউরোপ-আমেরিকায় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে আদবকায়দার (আমাদের দেশের মতো) খুব একটা গুরুত্ব নেই। বাংলাদেশে আছে এবং আমি মনে করি থাকাই উচিত। এটা বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ। মুরুব্বি বা শিক্ষকদের সঙ্গে বেয়াদবি কিংবা তথাকথিত বাহাদুরিতে কোনো কৃতিত্ব নেই। বাংলাদেশে যেভাবে শিক্ষকদের শ্রদ্ধা ও সমীহ করা হয়, সেটা সেভাবেই ধারণ ও লালন করা উচিত। তবে এর সঙ্গে সঙ্গে যাকে আমি ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের দ্বিতীয় মাত্রা বলছি, এর ওপর বেশি না হলেও অন্তত সমান গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক।
ড. আবু এন এম ওয়াহিদ : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
wahid2569@gmail.com