বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ যেভাবে হওয়া উচিত
ড. মো. তৌহিদুল ইসলাম
প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার জন্য সংস্কার প্রয়োজন। অধিকতর যোগ্য প্রার্থীকে শিক্ষকতার পেশায় নিয়োগ প্রদানের জন্য বর্তমানে যে লেকচারার পদটি রয়েছে, সেটিকে আপগ্রেড করে সিনিয়র লেকচারার করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা এখন সময়ের দাবি; এবং অধিকতর যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের জন্য পিএইচডি, পাবলিকেশন, সাইটেশন, এইচ-ইনডেক্স ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব দিয়ে একটি রূপরেখা প্রণয়ন করা উচিত। সরকারি প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা ও পদবি আপগ্রেড করার প্রস্তাবনা রয়েছে বিধায় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা সপ্তম গ্রেড থেকে শুরু হতে পারে।
সিনিয়র লেকচারার পদে আবেদনের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা হবে হতে পিএইচডি ডিগ্রি এবং ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরভুক্ত জার্নালে প্রথম বা কারেসপন্ডিং অথার হিসাবে কমপক্ষে দুটি পাবলিকেশন থাকা প্রয়োজন। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের অগ্রাধিকার প্রদান এবং পূর্ববর্তী ফলাফলের জিপিএ শিথিল করা যেতে পারে। এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় জিপিএ কমপক্ষে ৪-সহ সর্বমোট ৮ দশমিক ৫ এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় জিপিএ কমপক্ষে ৩-সহ সর্বমোট ৬ দশমিক ৫ থাকতে হবে। যদি কোনো কারণে পিএইচডি ডিগ্রিধারী প্রার্থী পাওয়া না যায়, তাহলে মাস্টার্সসহ পাবলিক বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি কলেজ কিংবা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে দুবছরের শিক্ষকতা বা গবেষণার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রার্থীদের বিষয়ে ভাবা যেতে পারে। এ পদের জন্য প্রবেশন পিরিয়ড হবে এক বছর এবং একই সঙ্গে তারা সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। বর্তমানে যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসাবে নিয়োজিত আছেন, তারা দুবছর পূর্তিতে সিনিয়র লেকচারার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হবেন এবং সব লেকচারার পদোন্নতিপ্রাপ্তির পর বর্তমান লেকচারার পদটি অবলুপ্ত করা যেতে পারে।
যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনে নিরপেক্ষতার স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র লেকচারার নিয়োগের জন্য লিখিত বা মৌখিক পরীক্ষার পরিবর্তে প্রার্থীর বিগত দিনের আমলনামার ওপর ১০০ নম্বরের একটি স্কোর বোর্ড তৈরি করা যেতে পারে, যেখানে শিক্ষাগত যোগ্যতা ৫০, পাবলিকেশন ৩০, সাইটেশন ৫, এইচ-ইনডেক্স ৫ এবং অ্যাওয়ার্ডের জন্য ১০ নম্বর বরাদ্দ থাকবে। প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা মূল্যায়নে এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় ৫ নম্বর করে সর্বমোট ১০ নম্বর এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় ১০ নম্বর করে সর্বমোট ২০ নম্বর রাখা যেতে পারে। আমার এ সংস্কার প্রস্তাবনায় পিএইচডির জন্য ২০ নম্বর রাখা হয়েছে, যা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হলে পূর্ণ ২০ নম্বর এবং দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ১৫ নম্বর পাবে। তবে পিএইচডি ডিগ্রিধারী প্রার্থী পাওয়া না গেলে পিএইচডির জন্য বরাদ্দকৃত ২০ নম্বর দুবছরের অভিজ্ঞতার জন্য রাখা যেতে পারে, যা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক বা গবেষক হিসাবে অভিজ্ঞতার জন্য পূর্ণ ২০ নম্বর, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারি ডিগ্রি কলেজের জন্য ১৫ নম্বর এবং বেসরকারি এমপিওভুক্ত ডিগ্রি কলেজে অভিজ্ঞতার জন্য ১০ নম্বর প্রদানের প্রস্তাব করা হলো।
পাবলিকেশনের জন্য বরাদ্দকৃত ৩০ নম্বর, যা ৫ নম্বর করে সর্বোচ্চ ৬টি ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরভুক্ত জার্নালে পাবলিকেশনের জন্য বিবেচিত হতে পারে। প্রতিটি প্রথম বা কারেসপন্ডিং অথারের জন্য ৫ নম্বর এবং কো-অথারের জন্য ৩ নম্বর রাখা যেতে পারে। প্রতি ১০০ সাইটেশন এবং ২ এইচ-ইনডেক্সের প্রতিটির জন্য ১ নম্বর করে বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হলো। প্রার্থী এসএসসি থেকে আবেদনের তারিখ পর্যন্ত যত স্কলারশিপ, ফেলোশিপ বা সম্মামনা পেয়েছেন, তা অ্যাওয়ার্ড হিসাবে বিবেচিত হবে এবং প্রতিটির জন্য ২ নম্বর করে সর্বোচ্চ ৫টি অ্যাওয়ার্ড বিবেচনা করা যেতে পারে। এভাবে মূল্যায়িত প্রথম তিনজন প্রার্থীকে শুধু তাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং সার্টিফিকেট ও পাবলিকেশনগুলো যথাযথ কি না, তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য মৌখিক পরীক্ষায় ডাকা হবে, যেখানে কোনো নম্বর বরাদ্দ থাকবে না। সর্বোচ্চ স্কোরধারীকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ এবং বাকি দুইজনকে অপেক্ষমাণ তালিকায় রাখার প্রস্তাব করা হলো।
নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এভাবে সংস্কার ও স্বচ্ছতা আনা হলে যারা বিদেশে পোস্ট ডক্টোরাল বা পিএইচডি-পরবর্তী গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন, তারা নিজ দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করবে। এতে মেধাবীদের দেশে ফিরিয়ে আনাও সহজ হবে। উল্লেখ্য, সহকারী অধ্যাপক থেকে পরবর্তী ধাপগুলোয় পদোন্নতি বা সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা, পাবলিকেশন, সাইটেশন, এইচ-ইনডেক্স ইত্যাদি আনুপাতিক হারে বেশি হতে হবে। প্রস্তাবিত এ সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হলে শিক্ষকদের পিএইচডিকালীন পূর্ণ বেতনে যে শিক্ষাছুটি প্রদান করা হয়, তা কমে গিয়ে বিশাল অঙ্কের অর্থ সাশ্রয় হবে এবং অধিকতর যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যাবে। তাছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ বেতনে যে পাঁচ বছর শিক্ষাছুটি রয়েছে, তা কমিয়ে তিন বছর করা যাবে, যা মূলত গবেষণা যেমন-পোস্ট ডক্টোরাল, রিসার্চ ফেলো, সেমিনার, ওয়ার্কসপ ইত্যাদির জন্য উন্মুক্ত রাখা যেতে পারে। তবে এ শিক্ষাছুটি নন-পিএইচডি শিক্ষকদের পিএইচডি করার জন্যও উন্মুক্ত রাখা যেতে পারে। কোনো শিক্ষকের পিএইচডির জন্য তিন বছরের অধিক সময় প্রয়োজন হলে বিনা বেতনে বা অর্ধ গড় বেতনে শিক্ষাছুটি প্রদান করা যেতে পারে। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের মডেলটিতে আর্থিক বিষয় বৃদ্ধির সংশ্লিষ্টতা নেই; বরং শিক্ষাছুটি কমিয়ে অর্থ সাশ্রয়ের বিষয় উল্লেখ রয়েছে বিধায় মডেলটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।
ড. মো. তৌহিদুল ইসলাম : সহযোগী অধ্যাপক, কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন স্কুল, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
islamtuhin@yahoo.com