Logo
Logo
×

বাতায়ন

গ্যাসের দাম আরও বাড়ানোর উদ্যোগ অনাকাঙ্ক্ষিত

Icon

হাসান মামুন

প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গ্যাসের দাম আরও বাড়ানোর উদ্যোগ অনাকাঙ্ক্ষিত

ছবি: সংগৃহীত

শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর পদক্ষেপের পর কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর বাস্তবায়নও শুরু হয়ে গেছে। যেমন, সেলফোন সেবা। কোনো কোনো খাতে কেউ বর্ধিত হারে ভ্যাট আদায় করছে; কেউ এখনো করছে না। যেমন, পোশাকের দোকান ও রেস্তোরাঁ। এ দুই ক্ষেত্রে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে যথাক্রমে দ্বিগুণ ও তিনগুণ। রেস্তোরাঁয় ভ্যাট ১৫ শতাংশ হয়ে যাওয়ায় অনেকে হতবাক। আশঙ্কা, এতে ভোক্তা অনেক কমে যাবে মানসম্পন্ন রেস্তোরাঁয়। বিদ্যমান ব্যবসা ধরে রাখাও কঠিন হবে। ভ্যাটের আওতার বাইরে থাকা ‘স্ট্রিট ফুডের’ ব্যবসা অবশ্য বাড়তে পারে। তবে এক্ষেত্রে চাঁদাবাজির সমস্যা রয়েছে। এর হার বেড়ে গেলে তারাও মুশকিলে পড়বে। নিবন্ধটি লেখার সময় এলপি গ্যাসে ভ্যাট ৫ থেকে ১৫ শতাংশের বদলে সাড়ে ৭ শতাংশ হচ্ছে বলে জানা গেল। তাতে সর্বস্তরের রেস্তোরাঁ মালিকরা হয়তো কিছুটা আশ্বস্ত হবে। গ্রাম পর্যন্ত রান্নাঘরে এলপি গ্যাসের ব্যবহার রয়েছে। হালে শিল্প খাতেও বাড়ছে এলপি গ্যাসনির্ভরতা। লাইনে গ্যাস মিলছে কম; এর চাপেও সমস্যা বেড়েছে। এতে জনজীবন থেকে নিয়ে শিল্পোৎপাদন পর্যন্ত পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে জটিল।

যেসব পণ্য ও সেবায় ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে, তাতে মূল্যস্ফীতি কতটা বাড়বে, প্রশ্ন রয়েছে। এমনিতেই মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি বেশ খারাপ। শীতে কেবল সবজির দাম সহনীয় হয়ে আসাতেই মূল্যস্ফীতি কমবে, এটা আশা করা যায় না। সবচেয়ে বড় কথা, মোটা চালের দামও বাড়ছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর এর অভিঘাত তীব্র। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে মজুরি বৃদ্ধির হারের তুলনায় মূল্যস্ফীতি বেশি। এতে সিংহভাগ মানুষের প্রকৃত আয় অব্যাহতভাবে কমে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে আমরা আছি। আয় কমলে ভোগব্যয় কমে যাওয়ার সমস্যা দেখা দেয় অর্থনীতিতে। এর প্রভাবে শিল্পপণ্যের চাহিদাও যায় কমে। এজন্য মূল্যস্ফীতির অভিঘাতের বাইরে থাকা শিল্পপতিরাও চান এটা সহনীয় থাকুক। মূল্যস্ফীতি, বিশেষত খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে মজুরি বৃদ্ধির দাবিও জোরালো হয়ে ওঠে। সেটা পূরণ করা কঠিন হয়ে ওঠে তখন উদ্যোক্তাদের পক্ষে। বর্তমানে তেমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে এমনকি প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকে। এ খাতে শ্রমিক অসন্তোষ হালে কমে এলেও ইতোমধ্যে এর কম প্রভাব পড়েনি অর্থনীতিতে। এটা ঘিরে অব্যাহত সড়ক অবরোধে ‘সাপ্লাই চেইন’ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মজুরি বাড়ানোর চাপে থাকা উদ্যোক্তাদের অনেকে বকেয়া পরিশোধেও হিমশিম খাচ্ছেন। তাদের একাংশ হয়তো ঋণখেলাপি। বিলখেলাপিও থাকতে পারে। এ গ্রুপের উদ্যোক্তাদের ভেতর থেকে ‘এক্সিট প্ল্যান’ও চাওয়া হচ্ছে। ব্যবসা করতে গিয়ে সবাই সফল হবে না। তবে দেখতে হবে অসাফল্যের হার। খেলাপি ঋণের হার দিয়েই কেবল এটা বোঝা যাবে না। কারণ এর একাংশ ঋণ নিয়েছিল অশুভ যোগাযোগে, যার উদ্দেশ্যই ছিল আত্মসাৎ। আর এর বড় অংশটাই পাচার হয়েছে। এসব অর্থ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা থাকলেও তা বেশ কঠিন। অর্থ পাচার না হয়ে বিনিয়োগে থাকলেও তাতে কর্মসংস্থানসহ কিছু সুফল আমরা পেতাম। যেমন, সরকারও ওইসব উদ্যোগ থেকে পেত রাজস্ব। শতাধিক পণ্যে ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর মানে তো এই যে, সরকার বড় রাজস্ব ঘাটতিতে রয়েছে। এমন পদক্ষেপের ফলে ১২ হাজার কোটি টাকার মতো বাড়তি রাজস্ব আহরণ হবে বলে জানা গেছে। তাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণদান কর্মসূচিতে থাকা আইএমএফও আশ্বস্ত থাকবে। তবে ওই অর্থটা যাবে যাদের পকেট থেকে, তারা খুশি হবে না। ভোক্তা হিসাবে তারা কম সক্রিয় থাকারও চেষ্টা করবে বাজারে। ব্যয় সাশ্রয় করে চলতে চাইবে বিশেষত নিম্ন-আয়ের মানুষ। এ কারণে বর্ধিত দামের পণ্য ও সেবার পরিভোগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাতে কমে যেতে পারে শিল্পপণ্যের বিক্রি। যেমন, ভ্যাট উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ায় বিস্কুটের পরিভোগ কমে গেলে বেকারিশিল্পে এর একটি অভিঘাত আসবে। এ খাত থেকে রপ্তানিও ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। অন্যান্য শিল্পের মতো বেকারিতেও কিন্তু রয়েছে গ্যাসনির্ভরতা।

শীতে বিদ্যুতের সংকট কমে এলেও গ্যাস সরবরাহে সংকট তো বেড়েছে। এর মধ্যে আবার বিশেষ করে নতুন সংযোগে শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনার কথা জানা গেল। বৃদ্ধির হার বিগত সময়ের মতোই বেশি। শিল্পপতিদের তরফ থেকে এরই মধ্যে এ বিষয়ে জানানো হয়েছে আপত্তি। এখন সরকার তার উদ্যোগ থেকে সরে আসবে কি না, কে জানে। তারা তো ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ব্যাপকভিত্তিক পদক্ষেপ থেকেও সরে আসেননি। এর মধ্যে ওষুধের মতো পণ্যের দামও নতুন করে বাড়ার শঙ্কা উপস্থিত। ওষুধ কেনা বাবদ খরচ বাড়ায় অনেকে ‘কম গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ’ খাওয়া বাদ দিচ্ছিলেন। জনস্বাস্থ্যের জন্য এটা কি উদ্বেগজনক নয়? ওষুধশিল্পের জন্যও এটা খারাপ সংকেত। এ শিল্পেও কিন্তু গ্যাসের ব্যবহার রয়েছে। এর আগে ওষুধের দাম বাড়ানো নিয়ে বিতর্ক উপস্থিত হলে উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে গ্যাসের দাম বিপুলভাবে বাড়ানোর প্রভাবের কথা তোলা হয়েছিল। গ্যাস সংযোগে সমস্যা দূর না হওয়ায় যে ওষুধশিল্প-পার্ক গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তার অগ্রগতিও হতাশাজনক।

গ্যাসের চাহিদার যে হিসাব হাতে রয়েছে, সে অনুযায়ীও এর ঘাটতি বিরাট। ৩৮০ কোটি ঘনফুটের মধ্যে ২৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বাসাবাড়িতেও সরবরাহ পরিস্থিতি খারাপ। সরকার বাসাবাড়িতে পাইপে গ্যাস সরবরাহ থেকে নীতিগতভাবে সরে এসে এক্ষেত্রে এলপি গ্যাস ব্যবহারকে উৎসাহিত করছে। কিন্তু এর দামও নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। তাও ভালো, এলপি গ্যাসের ওপর ভ্যাট এখন কম হারে বাড়বে। এর দাম বৃদ্ধির কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রান্নায় লাকড়ির ব্যবহার বাড়ার খবর মিলছে। লাকড়ির দামও কি কম? তবে শিল্প পরিচালনা করতে হলে গ্যাসই লাগবে। এক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহও থাকা চাই। ‘নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের’ কথা বলেই কিন্তু বিগত সরকার শিল্পে ইউনিটপ্রতি গ্যাসের দাম ১২ থেকে ৩০ টাকা করেছিল। বাস্তবে সঠিক চাপে গ্যাস সরবরাহও করতে পারেনি সরকার। টেক্সটাইলসহ বিশেষত ভারী শিল্পে নির্দিষ্ট চাপে গ্যাস সরবরাহ না হলে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন। এ কারণে সিরামিক, রড, সিমেন্টসহ বিভিন্ন শিল্পে পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে জটিল। তৈরি পোশাকের মতো রপ্তানিমুখী খাতেও শুধু গ্যাস সংকটে উৎপাদন হচ্ছে বিঘ্নিত। হালে যেসব উদ্যোক্তা ব্যবসা ছেড়ে দিতে চাইছেন, খোঁজ নিলে দেখা যাবে-গ্যাস সংকট তাদের অনেক ভুগিয়েছে। তারা ঠিকমতো গ্যাস পাননি, আবার এর জন্য অনেক বেশি দাম পরিশোধ করতে হয়েছে। অনেকের ঋণখেলাপি হয়ে পড়ার পেছনেও বড় কারণ হয়তো গ্যাস সংকট। অনেকে হয়তো রপ্তানিপণ্যের ভালো দামও পাননি। এর মধ্যে আবার ঋণের সুদের হার বেড়েছে অনেকখানি। ডলারের দাম অব্যাহতভাবে বাড়ায় আমদানিও ক্রমে ব্যয়বহুল হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও এর দাম বাড়ছে নতুন করে। ব্যাংকে ‘এলসি জটিলতা’ কমলেও তা একেবারে কেটে গেছে বলা যাবে না। এ অবস্থায় শিল্পের মেশিনারিজ ও কাঁচামাল আমদানি কমার ধারাটি অব্যাহত রয়েছে। এটা নতুন বিনিয়োগ না হওয়া এবং কম শিল্পপণ্য উৎপাদনের নির্দেশক। এটা খারাপ কর্মসংস্থান পরিস্থিতিও তুলে ধরে। নতুন কর্মসংস্থান তো হচ্ছেই না; লোকে কর্মচ্যুতও হচ্ছে। হালে বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে সৃষ্ট শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে ছিল এ পরিস্থিতি। পুলিশ তো মনোবলহীন; তাই সেনাদের দিয়ে পরিস্থিতি সামলাতে হচ্ছে। এদিকে অন্যান্য অরক্ষিত এলাকায় আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে ব্যবসার পরিস্থিতি সংকটজনক। পরিস্থিতির উন্নতি হলেও তা স্থায়ী হচ্ছে না। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীদের আস্থা ধরে রাখা কঠিন। এর মধ্যে যদি আবার গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এবং এর দাম আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়, তা শিল্পের জন্য হবে বিপর্যয়কর।

অর্থবছরের মধ্যভাগে এসে শতাধিক পণ্য ও সেবায় যেভাবে কর বাড়ানো হলো, সেটাকে ‘নীতির ধারাবাহিকতা’ থেকে বিচ্যুতি বলেও বর্ণনা করা যায়। এ ধরনের ঘটনাও কিন্তু উদ্যোক্তাদের জন্য হতাশাজনক। এতে শিল্পে উৎপাদন ব্যয় ব্যাপকভাবে না বাড়লেও চাহিদা হ্রাসের কারণে উৎপাদন কমিয়ে দিতে হতে পারে উদ্যোক্তাদের। এতে তাদের বার্ষিক আয় যাবে কমে। গ্যাস সংকটসহ নানা কারণে অনেক উদ্যোক্তা এমনিতেও ‘ক্যাপাসিটির’ অনেকখানি ব্যবহার করতে পারছিল না। এখন চাহিদা হ্রাসের কারণেও তাদের উৎপাদন কমিয়ে দিতে হতে পারে। করতে হতে পারে শ্রমিক ছাঁটাই। এমন মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিতে সেটা শুধু বেদনাদায়ক নয়; বিপর্যয়করও হতে পারে। সরকারের তাই উচিত হবে শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা থেকে সরে এসে বরং এর সরবরাহ ও চাপ বাড়াতে মনোযোগী হওয়া।

সামনেই রমজান মাস। তখন মূলস্ফীতি কতটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে, সে প্রশ্নের পাশাপাশি গ্যাস সংকট একইভাবে থেকে যাওয়ার আশঙ্কাও কিন্তু করা হচ্ছে। তখনো বাসাবাড়িতে গ্যাস সংকট থেকে গেলে মানুষ আরও বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাবে। এ সময়ে কম বিদ্যুৎ লাগলেও শীত শেষ হওয়ার পর বাড়তে থাকবে চাহিদা। বিদ্যুৎ উৎপাদনেও তখন গ্যাস লাগবে বেশি। শিল্পের ভাগে গ্যাস পড়বে আরও কম। তখন প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদন মৌসুম বোরোতেও কম বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে না। সব মিলিয়ে আরও জটিল পরিস্থিতিই সম্ভবত অপেক্ষা করছে। অন্তর্বর্তী সরকার চাইছে ‘জরুরি সংস্কারের’ ভেতর দিয়ে নির্বাচনে যেতে এবং এর মাধ্যমে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ সুগম করতে। তাতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। এ অবস্থায় অর্থনীতি পরিচালনার কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত পরবর্তী সরকারের জন্য রেখে দিয়ে এক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা আনাটা বরং জরুরি। অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা না করে, বিশেষত তাদের মত উপেক্ষা করে কোনো গুরুতর সিদ্ধান্ত না নেওয়াটাও কাম্য।

হাসান মামুন : সাংবাদিক, কলামিস্ট

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম