শিক্ষাক্রমের পথিকৃৎ

ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা
প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
-6786d7542f4c4.jpg)
ছবি: সংগৃহীত
কোনো স্তরের শিক্ষার উদ্দেশ্য, সে উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য বিষয়বস্তু, সে বিষয়বস্তু পঠন-পাঠনের কৌশল এবং শিক্ষার্থীরা শিখনের কতটা অর্জন করতে পারল, তা মূল্যায়নের সার্বিক পরিকল্পনাকে বলা হয় শিক্ষাক্রম। স্বাধীন বাংলাদেশে এ পর্যন্ত চারবার ১ম-১২শ শ্রেণির জাতীয় শিক্ষাক্রম তৈরি ও পরিমার্জন করা হয়েছে। সবকটিরই প্রধান দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল জব্বার। তাই তিনি বাংলাদেশ শিক্ষাক্রমের পথিকৃৎ বা গুরু। এমএ জব্বার ১৯৩১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ শহরের সানকিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৪৯ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন; দুটিতেই প্রথম বিভাগে। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, রসায়ন বিভাগের অনার্স কোর্সে; বিএসসি (অনার্স) পাশ করেন ১৯৫২ সালে, এমএসসি ১৯৫৩ সালে।
এমএসসি পাশ করার পর তিনি কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৫৪ সালে যশোর এম এম কলেজের প্রভাষক হিসাবে। কিন্তু শিক্ষাবিজ্ঞানের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ থাকায় তিনি সাধারণ কলেজ ছেড়ে চলে আসেন ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে। এ কলেজের উপাধ্যক্ষ শিক্ষাবিষয়ক বিভিন্ন গবেষণাকর্ম চালাতেন। মুহাম্মদ আবদুল জব্বার তার গবেষণা সহকারী হিসাবে কাজ শুরু করেন ১৯৫৫ সালে। এ শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ থেকেই তিনি ১৯৫৬ সালে বিটি (Bachelor of Teaching) ট্রেনিং কোর্স সাফল্যের সঙ্গে সমাপ্ত করে সেই বছরই তিনি ওই কলেজের প্রভাষক পদে যোগ দেন। এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নর্দার্ন কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা (MA in Education ডিগ্রি) লাভ করেন (১৯৬১)। ১৯৬৩ সালে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের শিক্ষা পরামর্শক পদে নিযুক্ত হন। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষাবিভাগে উপপরামর্শক পদে নিয়োগ পান।
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়নের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন কমিটি (১৯৭৬) গঠিত হলে অধ্যাপক জব্বার এ কমিটির পরিচালক ও সদস্যসচিব পদে নিযুক্ত হন। কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন প্রথমে অধ্যাপক শামসুল হক, পরে ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। কমিটির দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসাবে অধ্যাপক জব্বার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়নকাজের নেতৃত্বে থেকে সাত খণ্ডে প্রকাশিত দেশের প্রথম আবর্তনের শিক্ষাক্রম দলিল প্রস্তুতির মূল দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীন দেশের শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা ও পরিমার্জনের জন্যে National Curriculum Development Centre (NCDC) প্রতিষ্ঠিত হলে (১৯৮১) অধ্যাপক জব্বার এর পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯৮৪ সালে NCDC বাংলাদেশ টেক্সটবুক বোর্ডের সঙ্গে একীভূত হয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (National Curriculum and Textbook Board-NCTB)-এ রূপ লাভ করে। এনসিটিবিতে অধ্যাপক এমএ জব্বার প্রথম সদস্য (শিক্ষাক্রম) নিযুক্ত হন ১৯৮৪ সালেই। তিনি এ পদে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।
এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) হিসাবে দায়িত্ব পালন শেষে অধ্যাপক জব্বার ১৯৮৭ সালে শিক্ষা ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিষ্ঠিত National Institute of Educational Administration, Extension and Research (NIEAER)-এর পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) নিযুক্ত হন। এ পদেই অধ্যাপক জব্বারের সরকারি চাকরি শেষ হয় (১৯৮৮)। ১৯৯২ সালে এ প্রতিষ্ঠানের নাম সংক্ষিপ্ত করে National Academy for Educational Management (NAEM) রাখা হয়।
নায়েমের পরিচালক হিসাবে সক্রিয় কর্মজীবন শেষ হলেও অধ্যাপক জব্বার আজীবন শিক্ষাক্রমের সঙ্গে সংযুক্ত থেকেছেন। বাংলাদেশ শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের দ্বিতীয় আবর্তন প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত চলেছে। শিক্ষাক্রম পুনর্বিন্যাসের (Curriculum Reform) এ পর্যায়ে অধ্যাপক জব্বার শিক্ষাক্রম প্রতিবেদন প্রণয়ন কমিটির সভাপতি হিসাবে শিক্ষাক্রমের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন।
‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণীত হলে এর আলোকে শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের পরিকল্পনাও অধ্যাপক এমএ জব্বারের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নিয়েই গৃহীত হয়। নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে ২০১১-২০১২ সালে দেশের শিক্ষাক্রম তৃতীয়বার পরিমার্জিত হয়; এ পরিমার্জন প্রক্রিয়ায় জাতীয় পরামর্শকের দায়িত্বে ছিলেন আইইআরের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান। শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের এ সবশেষ কার্যকরী ধাপেও অধ্যাপক জব্বার শিক্ষাক্রমের কারিগরি (বিষয়ভিত্তিক) কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন; তিনি অধিকাংশ শিক্ষাক্রম সভায় ঋষির মতো গুরু হিসাবে ড. ছিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে মঞ্চে উপবিষ্ট থেকেছেন।
১৫ জানুয়ারি, ২০১৬ এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায়ের আগের দিন পর্যন্ত অধ্যাপক জব্বার নিজেকে শিক্ষাক্রমের প্রতি নিবেদিত রেখেছেন। ১৪ জানুয়ারি এনসিটিবিতে অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমানের একটি শিক্ষাক্রম সভা ছিল। ওই সভায় অধ্যাপক জব্বার আমন্ত্রিত ছিলেন না; তথাপি শিক্ষাক্রমের এ নিবেদিতপ্রাণ গুরু হৃদয়ের টানে সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। অসুস্থবোধ করলে সভা থেকেই তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয় এবং তিনি আর জীবিত ঘরে ফেরেননি।
অধ্যাপক জব্বারের পরিণত বয়সের কর্মজীবন কেটেছে এনসিটিবি ও নায়েমে। বাংলাদেশ শিক্ষাক্রমের প্রয়াত এ গুরুকে সম্মান জানিয়ে এনসিটিবি বা নায়েমের অন্তত একটির গ্রন্থাগার তার নামে উৎসর্গ করার জন্য আমি কয়েক বছর লেখার মাধ্যমে অনুরোধ করে আসছিলাম। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ সপ্তম তলার গ্রন্থাগারসংলগ্ন অংশকে একটি মিলনায়তনে রূপদান করে এটির নাম দিয়েছে ‘মুহাম্মদ আবদুল জব্বার মিলনায়তন’। দেরিতে হলেও এনসিটিবি দেশের শিক্ষাক্রমের এ পথিকৃৎকে সম্মান জানিয়ে জাতীয় কর্তব্য পালন করেছে। এখন আশা করি, নায়েম (শিক্ষাক্রম গুরুর সবশেষ আনুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্র) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর (যেখানে বসে তিনি স্বাধীন দেশের প্রথম শিক্ষাক্রম দলিলের সাত খণ্ড রচনা ও সম্পাদনা করেছিলেন) শিক্ষাক্রমের এ গুরুকে সম্মান জানিয়ে কিছু করবে।
বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষাক্রমের প্রায় ১৫০০ কপি নিয়ে অধ্যাপক জব্বার এনসিটিবিতে বসে শিক্ষাক্রমের কাজ শুরু করেছিলেন। দুঃখজনক হচ্ছে, শিক্ষাক্রমের এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারে বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি দলিলের শুধু দ্বিতীয় খণ্ড (নিম্নমাধ্যমিক) এবং তৃতীয় খণ্ডের (মাধ্যমিক) একটি করে কপি আছে, বাকি সব উধাও হয়ে গেছে! বাকি কপিগুলো জোগাড় করে কম্পোজ করে বোর্ডের ওয়েবসাইটে আপলোড করা দরকার। এভাবে বোর্ড কর্তৃপক্ষ শিক্ষাক্রম গবেষক ও ব্যবহারবিদদের (Practitioners) জন্য এই দলিলগুলো উন্মুক্ত করতে পারে।
আরও একটি বিষয় এখানে জরুরিভাবে উল্লেখ্য। এনসিটিবি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও পরিমার্জনের জাতীয় প্রতিষ্ঠান। দেশের শিক্ষাক্রম প্রক্রিয়া দেখভাল করার প্রধান দায়িত্ব পালন করেন প্রতিষ্ঠানটির দুজন সদস্য (যথাক্রমে সদস্য, মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম এবং সদস্য, প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) এবং তাদের দুই উইংয়ের কর্মকর্তা। কিন্তু শিক্ষাক্রম জানাবোঝা সদস্য (শিক্ষাক্রম) ছিলেন শুধু অধ্যাপক এম এ জব্বার, অধ্যাপক মুহম্মদ আলী এবং পরে অল্প সময়ের জন্য অধ্যাপক হাসফিয়া বশিরুল্লাহ।
১৯৮৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিগত প্রায় ৪০ বছরের মধ্যে মাত্র আট বছর এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) ছিলেন শিক্ষাক্রম বোদ্ধা মাত্র তিনজন যোগ্য শিক্ষাক্রম জানাবোঝা অধ্যাপক। বাকি প্রায় ৩২ বছর ধরে এনসিটিবির সদস্যের (শিক্ষাক্রম) দায়িত্ব পালন করছেন যে কোনো বিষয়ের একজন কলেজ অধ্যাপক। এদের মধ্যে কারও শিক্ষাক্রম সম্পর্কে খুব উৎসাহ থাকলে কাজটি ভালো হয়, নইলে শুধু ‘দিন চলে যায়’। শিক্ষাক্রম নিয়ে এরকম ‘দিন চলে যাওয়ার ব্যবস্থা’ করা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যই বলতে হয়।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ শিক্ষাক্রম বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে নেবেন বলে আশা করি। আগামী বাজেটে শিক্ষায় জিডিপির অন্তত ৩ শতাংশ বরাদ্দ দেবেন বলেও আশা করি।
বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের জাতীয় শিক্ষাক্রমের এ পর্যন্ত যে চারটি আবর্তন সম্পূর্ণ হয়েছে তার সবকটি আবর্তনের শিক্ষাক্রম তৈরি ও পরিমার্জনে নেতৃত্ব দিয়ে, অবদান রেখে অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল জব্বার এদেশের শিক্ষাক্রমের গুরু হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। আজ বাংলাদেশ শিক্ষাক্রমের এ গুরুর নবম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা : শিক্ষাক্রম গবেষক এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার
asmolla@ymail.com