Logo
Logo
×

বাতায়ন

চালের বাজারে অস্থিরতা ও করণীয়

Icon

ড. জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চালের বাজারে অস্থিরতা ও করণীয়

কিছুদিন ধরে চালের বাজার অস্থির। মাঝখানে দাম কিছুটা কমেছিল। বর্তমানে আবারও বাড়ছে চালের দাম। এখন মোটা জাতের স্বর্ণা ও চায়না প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। মাঝারি ব্রিধান ২৯ বিক্রি হচ্ছে ৬১ থেকে ৬৫ টাকা। মিনিকেট নামে পরিচিত সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। সরু নাজিরশাইল বাজারভেদে বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা। কাটারিভোগ ও অন্যান্য সুগন্ধি চালের দাম আরও বেশি। আমন ধানের ভরা মৌসুমে এ মূল্য অস্বাভাবিক।

সাধারণভাবে অনুধাবন করা যায়, ব্যবসায়ীরা অন্যায্য মুনাফা অর্জন করছে ভোক্তার কাছ থেকে। তাতে কষ্ট পাচ্ছে গরিব খেটে খাওয়া মানুষ। এবার চালের উৎপাদন খরচ প্রতি কেজি ৪৬ টাকা। এর সঙ্গে ১৫ শতাংশ বাজারজাতকরণে খরচ ও মুনাফা যোগ করা হলে ভোক্তা পর্যায়ে মোটা চালের দাম হয় প্রতি কেজি ৫৩ টাকা। মানভেদে চালের মূল্য সর্বোচ্চ হওয়ার কথা ৭৫ টাকা। কিন্তু বর্তমানে আমন চালের ভরা মৌসুমে বাজারে যে দামে চাল বেচাকেনা হচ্ছে, তা অযৌক্তিক। অনেকে মনে করেন, এটি ব্যবসায়ীদের কারসাজি।

ইতোমধ্যে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ দপ্তরসহ সরকারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তাতে খুচরা পর্যায়ে তেমন কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে না। চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা ধান মজুত করছে, বাজারে চাল সরবরাহ করছে কম। মিল গেটে দাম বাড়ানো হচ্ছে অন্যায্যভাবে। এতে করপোরেট হাউজগুলোর আধিপত্য সবচেয়ে বেশি। এছাড়া বড় অটোরাইস মিলাররাও তাদের আধিপত্য ধরে রাখছে। এদের সঙ্গে যুক্ত আছে মাঝারি ও ছোট মিল মালিক এবং মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। এদের দৌরাত্ম্য ও কারসাজিতেই বৃদ্ধি পাচ্ছে চালের দাম।

এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন। সেটি হচ্ছে চালের উৎপাদন হ্রাস। সাম্প্রতিক বন্যায় আউশ ধানের উৎপাদন মার খেয়েছে। বিঘ্নিত হয়েছে আমনের উৎপাদনও। আমনের আবাদি এলাকা হ্রাস পেয়েছে। বিলম্বে চারা রোপণের কারণে ক্ষেত্র বিশেষে ফলন কিছুটা কম হয়েছে। ধারণা করা যায়, এবার আউশ ও আমন মিলে ১ কোটি ৮০ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। আমন ও আউশ মিলে মোট উৎপাদনের প্রায় ৪৬ শতাংশ চাল সরবরাহ করা হয়। এ দুই মৌসুমে ধানের উৎপাদন হ্রাস পেলে মোট চাল উৎপাদনে বড় প্রভাব ফেলে। তার আগে গত মে-জুনে কর্তনকৃত বোরো মৌসুমে উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ৬ লাখ টন চাল। তাতে ২০২৪ সালে চালের সম্ভাব্য উৎপাদন দাঁড়ায় ৩ কোটি ৮৬ লাখ টন। তার বিপরীতে আমাদের খাদ্য চাহিদা প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ টন চাল। এর সঙ্গে কৃষক, ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের কাছে ১০ শতাংশ মজুত বিবেচনা করে মোট চালের চাহিদা দাঁড়ায় প্রায় ৪ কোটি ৭ লাখ টন। সে ক্ষেত্রে বাজারজাত উদ্বৃত্ত এখন কম বলে ধারণা করা যায়। বর্তমানে সরকারি গুদামে চালের মজুত খুবই কম, মাত্র ৮ লাখ টন। যে কোনো সময় ন্যূনপক্ষে তা সাড়ে বারো লাখ টন হওয়া উচিত। চালের সম্ভাব্য ঘাটতি বিবেচনায় নিয়ে ইতোমধ্যেই সরকার চাল আমদানির ব্যবস্থা নিয়েছে। শুল্ক হার কমিয়ে আমদানি উৎসাহিত করা হয়েছে। এর বিপরীতে সাড়া পাওয়া গেছে খুবই কম। গত ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত আমদানি হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৪১ হাজার টন। আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বৃদ্ধি এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন চাল আমদানির খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমানে প্রতি টন চাল আমদানি মূল্য কমবেশি ৫০০ ডলার। তাতে প্রতি কেজি চাল আমদানিতে প্রায় ৬১ টাকা ব্যয় হয়। এর সঙ্গে পরিবহণ খরচ ও আমদানিকারকের মুনাফা যোগ করে দেশের অভ্যন্তরে খুচরা পর্যায়ে চালের দাম পড়ে প্রতি কেজি ৬৫ টাকার ওপরে। তাতে পোষাতে পারছে না আমদানিকারকরা। ফলে বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি নিরুৎসাহিত হচ্ছে। অর্থাৎ আমদানির মাধ্যমেও চালের বাজারজাত উদ্বৃত্ত তেমন বাড়ানো যাচ্ছে না। এ সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজার থেকে অযাচিত মুনাফা নেওয়ার চেষ্টা করছে।

এ মুহূর্তে দেশে চালের কোনো সংকট নেই। উৎপাদন মৌসুম কেবলই শেষ হয়েছে। সরকারের চাল সংগ্রহ প্রক্রিয়া এখন চলমান রয়েছে। ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারি পর্যায়ে গমসহ মোট খাদ্যশস্য মজুত আছে ১২.২৫ লাখ টন। আমন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে ২.৬৩ লাখ টন। ধান সংগ্রহ করা হয়েছে ৯ হাজার ৭৪১ টন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সরকার চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ৬.৫ লাখ টন অর্জন করতে পারবে। কিন্তু ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবে না। এর আগেও কখনো ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। এবার ৩.৫ লাখ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার সিকিভাগও পূরণ হবে বলে মনে হয় না। কারণ, ধান তোলার সঙ্গে সঙ্গেই কৃষক ধান বিক্রি করে দিয়েছে চাতালের মালিক ও বড় করপোরেট হাউজের প্রতিনিধিদের কাছে। ৩৩ টাকা কেজি দরে শুকনো ধান সরকারি গুদামে গিয়ে দিয়ে আসার মতো সুযোগ তাদের আর তেমন নেই। এখন বাজারজাত উদ্বৃত্ত ধান সবই বড় ব্যবসায়ী ও চাতালের মালিকদের হাতে কুক্ষিগত। এরাই সরকারকে চাল সরবরাহ করছে; বাজারে চাল পাঠাচ্ছে। এরাই নিয়ন্ত্রণ করছে বাজার। মূল্য নির্ধারণ করছে এরাই। মূল্যবৃদ্ধির কারসাজিও করছে তারাই।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা বেশি দামে ধান কিনেছেন, তাই চালের দাম পড়ছে বেশি। প্রকৃত প্রস্তাবে, বড় মিলাররা ধান কিনে নিয়েছে উৎপাদনের পরপরই। তখন ভেজা ধান প্রতি মন বিক্রি হয় ৯০০ থেকে ১১০০ টাকা দামে। সরকার নির্ধারিত ১৩২০ টাকা দর কখনোই কৃষককে দেয় না ব্যবসায়ীরা। পরে যখন মোকামে ধানের দাম বাড়ে, তখন কৃষকের হাতে বিক্রির মতো উদ্বৃত্ত থাকে না। অল্প করে শুকনো ধান তখন বিক্রি হয় বেশি দামে। ক্ষেত্র বিশেষে সরু ধান ১৩০০-১৪০০ টাকা মন দরেও বিক্রি হতে দেখা যায়। মোট বিক্রি করা ধানের মধ্যে এর হিস্যা খুবই নগণ্য, কিঞ্চিতকর। তাই চালের বেশি দামের সুবিধার ভাগীদার কৃষক হন না। এর ফায়দা লোটে অসাধু ব্যবসায়ীরা। অর্থাৎ লাভের গুড় সবই পিঁপড়ে খায়।

গত নভেম্বরে এ দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৩.৮ শতাংশ। ডিসেম্বরে তা নেমে এসেছে ১২.৯২ শতাংশে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পর্যাপ্ত উৎপাদন না হওয়া, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, মুদ্রামান হ্রাস, বিদেশি মুদ্রা সংকটের কারণে অপ্রতুল আমদানি এবং বৈশ্বিক উচ্চমূল্য আমাদের দেশে উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্বৃত্তায়ন। শুধু চালের ক্ষেত্রেই নয়, পেঁয়াজ, আলু, ভোজ্যতেল ও চিনির ক্ষেত্রেও এ দুর্বৃত্তায়নের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। এতে কলকাঠি নাড়ছে একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা। এখনই তাদের লাগাম টেনে ধরা দরকার। বর্তমানে আন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায়। শক্ত অবস্থানে থেকে জনস্বার্থের কাজগুলো করে নেওয়ার এখনই সময়।

চালের মূল্য স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখার প্রধান উপায় ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি। সামনে বোরো ধানের মৌসুম। এ দেশে ৫৪ শতাংশ চাল সরবরাহ হয় বোরো মৌসুমের উৎপাদন থেকে। বোরো মৌসুম মোটামুটি নিরাপদ। তবে এ ধান সেচনির্ভর। রাসায়নিক সারের প্রতি সংবেদনশীল। এ দুটি উপকরণের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। গ্যাস সংকটে দেশের সার কারখানাগুলোর উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে। সেখানে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করা দরকার। জ্বালানি তেলের দাম এখনো বেশি। পানি সেচের প্রায় ৬৫ শতাংশ নির্ভরতা রয়েছে জ্বালানি তেলের ওপর। এখানে ভর্তুকি দেওয়া দরকার। কৃষককে নগদ সহায়তাও দেওয়া প্রয়োজন।

অনেকে মনে করছেন, চালের উচ্চ মূল্য ঠেকাতে মোটা দাগে আমদানি করা উচিত। গত অর্থবছরের আগের বছর চাল আমদানি হয়েছিল প্রায় সাড়ে ১০ লাখ টন। তার আগের অর্থবছরও ১০ লাখ টন চাল আমদানি করা হয়েছিল। এবারও আমদানি করা প্রয়োজন হতে পারে ন্যূনপক্ষে ১০ লাখ টন। অভ্যন্তরীণ মজুত বৃদ্ধির জন্য তা খুবই দরকার। কমপক্ষে ২৫ লাখ টন মজুত গড়ে তুলতে না পারলে চালের বাজারদর নিয়ন্ত্রণে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। তাছাড়া খোলাবাজারে হস্তক্ষেপ ও গরিববান্ধব চাল বিতরণ কর্মসূচি সম্প্রসারণের জন্য মজুতের পরিমাণ বাড়ানো দরকার। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে চাল সংগ্রহ বাড়ানো হলে এর বাজার আরও চড়ে যেতে পারে। অতএব আমদানি করা নিরাপদ। ২০২৩ সালে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মাত্রা ছিল প্রাক শিল্পযুগের তুলনায় ১.৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। ২০২৪ সালে তা আরও বৃদ্ধি পেয়ে ১.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে। তাতে ব্যাহত হয় খাদ্যশস্যের বৈশ্বিক উৎপাদন। বেড়ে যায় খাদ্যশস্যের আন্তর্জাতিক মূল্য। তেমন পরিস্থিতিতে দেশের খাদ্য মজুত নিরাপদ পর্যায়ে উন্নতি করা উচিত। তাতে সার্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতির ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বিশ্ববাজার থেকে খাদ্য আমদানির ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা বাড়ছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশের মোট খাদ্য চাহিদার ৯.৩ শতাংশ মেটানো হতো আমদানির মাধ্যমে। ২০২২ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১১.২ শতাংশে। এরপর আমদানি কমেছে মূলত বিদেশি মুদ্রার সরবরাহ সংকটের কারণে। ২০২০-২১ থেকে ২০২২-২৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে চালের উৎপাদন কমেছে ০.৪৭ শতাংশ হারে। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পায় ৪.০১ শতাংশ। উৎপাদনের এ অস্থিরতা রোধ করতে হবে। চাল, গম, আলু, পেঁয়াজ, ডাল ও ভোজ্যতেলের মতো প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর টেকসই উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এর জন্য আরও বেশি আর্থিক সহায়তা ও নীতিগত সমর্থন প্রদান করা উচিত।

অনেকে মনে করেন, মুক্তবাজার ব্যবস্থায় চালসহ নিত্যপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ার তেমন সুযোগ নেই। এটি ভ্রান্ত ধারণা। বাজার কারসাজির ক্ষেত্রে পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে দেওয়াই উত্তম পদক্ষেপ। অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণের ভিত্তি হওয়া উচিত উৎপাদন খরচ। এর সঙ্গে বিপণন খরচ ও মুনাফা যোগ করে ভোক্তা পর্যায়ের মূল্য নির্ধারণ করা উচিত। আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে বিবেচনার বিষয় হবে আমদানি মূল্য। অভ্যন্তরীণ খরচ ও ব্যবসায়ীর লাভ যোগ করে ভোক্তা পর্যায়ের মূল্য নির্ধারণ করা উচিত। বিপণন শৃঙ্খলের প্রতিটি স্তরে পণ্যের মূল্য ঘোষণা বাধ্যতামূলক করা দরকার। এতে বাজার মনিটরিং সহজতর হবে। ব্যবসায়ীরা অন্যায্য দাম হাঁকিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না গরিব ভোক্তাদের।

ড. জাহাঙ্গীর আলম : কৃষি অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও শিক্ষক; সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম