Logo
Logo
×

বাতায়ন

রাজনৈতিক ব্যর্থতার দায় ও তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা

Icon

মোহাম্মদ হোসেন

প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাজনৈতিক ব্যর্থতার দায় ও তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা

২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বাতিল হয়। যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিল, তারা তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিল। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা প্রবর্তনকালে কর্মসূত্রে আমি মাঠ পর্যায়ে কাজ করি। ফেব্রুয়ারি ও জুনের নির্বাচন অনেক কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যারা দাবিদার ছিল, তাদের কর্মীদের আচরণ আর তৎকালীন সরকারি দলের কর্মীদের আচরণে তেমন কোনো গুণগত পার্থক্য আমার গোচরীভূত হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো হলো। জুনের নির্বাচনেও যা হওয়ার, ফলাফল তা-ই হলো। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক বাস্তবতায় কোনো দলের পক্ষেই ধারাবাহিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কাজেই মোটামুটি নিরপেক্ষতায় নির্বাচন হলে সরকারি দলের বিপরীত পক্ষ জিতবে, এটিই সত্য।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাপনায় ১৯৯৬তে যারা নির্বাচিত হলো, তাদের কাজকর্মের ফলাফল হিসাবে ২০০১ সালে বিপরীত পক্ষ সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসন লাভ করল। এ ১০ বছরের অভিজ্ঞতায়ও দুটি রাজনৈতিক দল তাদের চরিত্র পালটাতে পারল না। ক্ষমতার দুর্দমনীয় মোহ তাদের অনিবার্য পরিণতির দিকে ডাকতে থাকল।

‘অতি চালাকের গলায় দড়ি’, এ প্রবাদ বাক্যটি রাজনৈতিক দলের লোকরা কোনো সময়ই মনে রাখতে পারেন না। তবে তাদের যাই হোক না কেন, নিরপরাধ জনগণ সবসময়ই এ রাজনৈতিক অরাজকতার শিকার হয়েছে বারবার। ১/১১-এর বেত্রাঘাত খাওয়ার পরও তাদের যেন হুঁশ হলো না। ২০১১ সালে এসে জনগণের বা দলীয় কর্মীদের রক্তে লেখাব্যবস্থাটি আবার বাতিল হলো। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে আবার দেশের জনগণকে মূর্খ বানানো হলো। এর পরের ইতিহাস সবার জানা।

ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হলো ৩৬ জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের পরে। কিছু রাজনৈতিক দল এ ব্যবস্থাটি আবার পুনঃপ্রবর্তন করতে চাচ্ছে। একটি রাজনৈতিক দল সম্ভবত তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা পুনঃপ্রত্যাবর্তন করার জন্য রিট পিটিশনও করেছে। শুনানি জানুয়ারি মাসের কোনো একদিন। ইতোমধ্যে ‘ওভার ট্রাম্প’ করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেলের ওকালতিতে পঞ্চদশ সংশোধনীর কিছু অংশ বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পুনর্বহাল করা হয়েছে। এ অবস্থায় ওই রিট শুনানি আর হবে কিনা, তা আমার জানা নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে স্বাগত জানিয়ে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান অভিমত দিয়েছেন, ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে আসার দ্বার উন্মোচিত হলো।’

তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থার আদর্শটি প্রকৃত অর্থ বোঝার জন্য একটি গল্প বলা যায়। গল্পটি এমন : একটি বড় লোকালয়ে কিছু সাধারণ মানুষ, কিছুসংখ্যক চোর-ডাকাতের দল এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছু উচ্চ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন, প্রচলিত অর্থে সৎ ও নিরপেক্ষ মানুষ বসবাস করে। চোর-ডাকাতরা যেহেতু দলবদ্ধ, তাই তাদের দাবি হলো, প্রয়োজনমতো গ্রামের গৃহস্থ ঘরে চুরি-ডাকাতি করতে দিতে হবে। কিন্তু তারা নিজেরা ঠিক করতে পারে না, এ চুরি-ডাকাতির প্রধান বরকন্দাজ কারা হবে। তাই তারা মারামারি করে একদল আর একদলকে নিঃশেষ করে দিতে চায়। এতে গ্রামে প্রবল অশান্তি বৃদ্ধি পায়। তাই ওই লোকালয়ে তুলনামূলক শান্তি রক্ষার জন্য গ্রামের দৃশ্যমান তথাকথিত সুশীল আর নিরপেক্ষ মানুষজন মিলে একটি বন্দোবস্তের মাধ্যমে গ্রামবাসীকে একটু সুযোগ দেয়, গ্রামবাসী বাছাই করবে আগামী এক বছর তাদের ঘরে কারা চুরি-ডাকাতি করবে! সময় মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর আবার সুশীল-নিরপেক্ষদের মধ্যস্থতায় পরবর্তী মেয়াদের চোর-ডাকাতদের বাছাই করা হবে।

মোদ্দা কথা, আমাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার আদলে তারা নিজেদের ঘরে চুরি-ডাকাতির দল নির্বাচন করত। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য শ্বেতপত্র প্রকাশের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক শাসনকে ‘চোরতন্ত্র’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন, যা প্রমাণ করে, আমাদের রাজনৈতিক দলের শাসন শেষ পর্যন্ত চোরতন্ত্রে পর্যবসিত হয়।

গণতন্ত্র নামক একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর উপরের গল্পটি সাদৃশ্যপূর্ণ বলেই মনে হয়। যারা একটি সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবে না, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জানের শত্রু মনে করবে, সাধারণ সৌজন্য সৌহার্দ রক্ষা করার মতো বিশ্বাস-যোগ্যতা নেই, তারা কি অভিপ্রায়ে রাজনীতি করেন? কেন কিছুদিন পরপর কতিপয় লোক একত্র হয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দায়িত্ব নেবে? তারা যদি নির্বাচনের দায়িত্ব নিতে পারে, তাহলে তারা কেন দীর্ঘমেয়াদে সরকার বা দেশ পরিচালনা করতে পারবে না? যদি রাজনৈতিক কর্মীরা নেতাদের কথা না মানে, তাহলে কেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের নিয়ে দল গঠন করে? দেশে নির্বাচন না করে মাঝে-মধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান নেতারা একত্রে বসে প্রতি ২ বছরের জন্য কিছু ভালো মানুষ খুঁজে বের করে তাদের দেশ/সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দেয় না কেন? রাজনৈতিক নেতারা দূরে থেকে সরকারের খারাপ কাজের সমালোচনা-বিরোধিতা করবে এবং ভালো কাজে নীরব সহযোগিতা করবে। তাহলেই তো দেশ ভালো চলবে! এসব কথা খুবই অবাক শোনাচ্ছে, কিন্তু আপনারা প্রকৃত দেশপ্রেমিক এবং নিঃস্বার্থ-জনদরদি হলে ভেবে দেখুন। আমরা জনগণ গত ৩৪ বছরের গণতান্ত্রিক শাসনে যা দেখেছি, তাহলো রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রক্ষমতা চায় আয়-রোজগার বৃদ্ধি, প্রতিপক্ষের ওপর জুলুম-অত্যাচার করা এবং ক্ষমতার তুলতুলে আসন উপভোগ করার জন্য। বিগত সময়ে যেসব সংস্কার করে জাতীয় উন্নয়ন করা সম্ভব ছিল, তার সব ক্ষেত্রে অবনমন হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক দল/সরকার দাঁড়াতে পারেনি। সরকারে থাকলে এক বয়ান, বিরোধী দলে গেলে তার বিপরীত বয়ান। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো বিপরীত পক্ষের ওপর দায়-দোষ চাপানোর অপার আধ্যাÍিক স্বাধীনতার অধিকারী! এসব দেখে সাধারণ মানুষ আজ ক্লান্ত। রাজনীতিতে তাদের অনাস্থা। ২০ কোটি মানুষের ২০ হাজার কোটি প্রয়োজন (need)। মানুষ তার প্রাপ্য পাচ্ছে না, যা পাচ্ছে তা খুদ-কুঁড়া মাত্র। দই-মাখন সব রাজনৈতিক শক্তি, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আর সরকারি কর্মচারীরা খেয়ে ফেলছে। জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের প্রকৃত উদ্যোগ নেওয়ার জন্য যোগ্য রাজনৈতিক শক্তি এখনো গড়ে ওঠেনি। জনগণও বৈপরীত্যের দ্বারা বিভ্রান্ত। সামগ্রিকভাবে কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, তারা বুঝতে চায় না। জনগণও চায় শুধু তাদের লাভের ভাগ আর ভোগ-উপভোগ করতে; তুচ্ছ কারণে বা অকারণে নিজেদের মধ্যে কলহ করতে। রাজনৈতিক দলগুলো সে সুযোগে নিজের ভাগ বড় করে নেয়। জনগণের মধ্যে আমাদের মতো নির্বোধ সাধারণ মানুষ আশা-আকাঙ্ক্ষার জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হতে থাকি; আমাদের হয় করুণ নিয়তি!

যা হোক, আমার অভিমত বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামোতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাজনীতিকদের জন্য একটি লজ্জাজনক ব্যবস্থা। কাজেই, হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিকল্প ব্যবস্থা রাজনীতিকদের খুঁজে বের করতে হবে অথবা তাদের রাজনীতি বাদ দিয়ে অন্য কিছু করা উচিত। সময় ও স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। কাজেই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে সংস্কার প্রয়োজন। দলীয় কাঠামোর প্রতিটি পর্যায়ে নির্বাচিত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কোনো অজুহাতে ক্ষমতা অর্পণ বা কণ্ঠভোটে নেতা নির্বাচন করা যাবে না। ব্যালট ভোটে নেতা নির্বাচিত হতে হবে। প্রয়োজনে দলনিরপেক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী অন্যদলের লোকদের দিয়ে নির্বাচন পরিচালনা করতে হবে। জাতীয় বা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতিপক্ষের আস্থা অর্জন করতে না পারলে প্রয়োজনে প্রতিবছর একটি নতুন করে নির্বাচন হবে। এভাবে কয়েক বছর গেলে জালিয়াতদের জালিয়াতির স্বাদ এমনি মিটে যাবে।

দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রীয় বা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থার একটি বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে ১০০ জনের একটি অছি পরিষদ (Trustee council) বা অভিভাবক পরিষদ (Guardianship council) গঠন করতে হবে, যা জাতীয় পরিষদের দ্বিতীয় কক্ষের অতিরিক্ত তৃতীয় কক্ষ হিসাবে কাজ করবে। যাদের একটি ভিন্ন নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচিত করা হবে। তাদের জন্য একটি কার্যপরিধি প্রণয়ন করা হবে। তাদের প্রধানতম দায়িত্ব হবে রাজনৈতিক সংকটকালে দলীয় সরকারকে অপসারণ করে পরবর্তী মেয়াদের জন্য সরকার নির্বাচন করা। এ ট্রাস্টি কাউন্সিল যখন সরকারি দায়িত্ব গ্রহণ করবে, তার মেয়াদ কম পক্ষে দুবছরের জন্য হবে।

তৃতীয়ত, যদি রাজনৈতিক দলগুলো অছি পরিষদ গঠনের মতো বুদ্ধিমত্তা প্রদর্শন করতে না চায়, লাজলজ্জার মাথা খেতে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থাই চায়, তাহলে সে সরকার পদ্ধতি সম্পর্কে একটি সর্বসম্মত আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। এ আইনটি বর্তমানে অধ্যাদেশরূপে জারি হতে পারে। পরবর্তী সংসদে তা এরূপভাবে গৃহীত হবে, ৯৯ শতাংশ সংসদ সদস্যের মতৈক্য ছাড়া ওই আইন সংশোধন বা বাতিল করা যাবে না। আইনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ২ বছর নির্ধারণ করতে হবে। প্রথম দেড় বছর তারা বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সংস্কার করবে। দ্বিতীয় বছরের শেষ ছয় মাসে তারা স্থানীয় সরকার এবং জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে এবং পাশাপাশি নির্বাচনি অভিযোগগুলো, বিশেষত যেসব নির্বাচনি কর্মকর্তা এবং প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নির্বাচনি কাজে দুর্নীতি ও অসাধুতার অভিযোগ উত্থাপিত হবে, তার বিচার নিষ্পত্তি করবে। এজন্য নির্বাচিতদের তিন মাস নির্বাচিত হিসাবে অপেক্ষা করতে হবে। অতঃপর তাদের মেয়াদের শেষ তিনদিনে নির্বাচিতদের শপথ এবং সরকার গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য প্রথমে একটি কেয়ারটেকার কাউন্সিল গঠিত হবে, যার সদস্য সংখ্যা হবে ১০১। এরা সিভিল সোসাইটির নির্বাচিত নেতৃত্ব, সংগঠনের অবসরে যাওয়া নির্বাচিত প্রতিনিধি, বিভিন্ন সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে অবসরপ্রাপ্ত পেশাজীবী, আইনজীবী-বিচারপতি, কমিউনিটি বেইজড সংগঠনের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে থেকে বাছাই করা হবে। তার একটি কার্যকর পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে।

সর্বোপরি রাজনীতির যে ব্যর্থতা, তার দায় রাজনীতিকদেরই নিতে হবে। অসহায় জনগণকে জিম্মি না করে যারা নিজেদের রাজনীতিবিদ দাবি করছেন, তাদের দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশিত। আজ জাতি যে দুর্ভোগের শিকার, তার সামষ্টিক দায় কিন্তু রাজনৈতিক ব্যর্থতা থেকেই উৎপন্ন হয়েছে। এ দায়টুকু অন্তত মনে রাখতে হবে। তাহলে হয়তো সঠিক পথ খুঁজে পাওয়া যাবে।

মোহাম্মদ হোসেন : লেখক ও বিশ্লেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম