Logo
Logo
×

বাতায়ন

যে কারণে ইংরেজি বিষয়ে ফল বিপর্যয় হয়

Icon

মো. ছলিম উল্লাহ আজাদ

প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

যে কারণে ইংরেজি বিষয়ে ফল বিপর্যয় হয়

২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল সাতটি বিষয়ে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের কারণে বাকি ছয়টি স্থগিত বিষয়ের পরীক্ষার ফলাফল তাদের এসএসসি পরীক্ষার সাবজেক্ট ম্যাপিং করে প্রকাশিত হয়েছে। মূলত ফলাফলে পাশ/ফেল নির্ভর করেছে ইংরেজি বিষয়ের ওপর। ইংরেজি বিষয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পাশের হার ছিল মাত্র ৬৮.৮৯ শতাংশ। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সামগ্রিক পাশের হার ৭০ শতাংশ। দেশের চিত্র কম-বেশি এরকমই।

২০২৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় ইংরেজিতে এ+ এর সংখ্যা বেড়েছে, অপরদিকে ইংরেজিতে অনুত্তীর্ণের সংখ্যাও বেড়েছে। জেলা শহর ও মহানগরীর অনেক স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে দখল অনেক ভালো। শহর থেকে একটু দূরে গেলেই এর সূচক অনেক নিম্নগামী। ভালো স্কুল/কলেজগুলো আরও ভালো করছে, অন্যদিকে দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলো আরও দুর্বল হচ্ছে।

প্রকৃতপক্ষে ইংরেজি বিষয়ের কারণে আগেও বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের ফলাফল বিপর্যয় ঘটেছে। কেন ইংরেজি বিষয়ের কারণে ফলাফল বিপর্যয় হয়? প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত টানা ১২ বছর ইংরেজি পড়ে শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন তো দূরের কথা, পাশও করতে পারছে না। আগের বছর পাশের হার ৭০ শতাংশের উপরে থাকা অনেক কলেজে গত বছর পাশের হার ছিল ৫০ শতাংশের নিচে। তাছাড়া অনেক কলেজের পাশের হার ৪০ শতাংশ নিচে। বছর বছর ফলাফলে এত নাটকীয় পরিবর্তনের কারণ কী? এইচএসসি পরীক্ষায় ইংরেজি বিষয়ে ফলাফল সন্তোষজনক না হওয়ার কয়েকটি কারণ তুলে ধরছি।

১. ইংরেজি বিদেশি ভাষা হওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের কাছে তা রীতিমতো আতঙ্কের। একশ্রেণির শিক্ষার্থীর বদ্ধমূল ধারণা-ইংরেজি পড়ে তারা কোনো অবস্থাতেই তা আয়ত্তে আনতে পারবে না। কলেজের শিক্ষাবর্ষের শুরু থেকেই অনেক দুর্বল ছাত্রছাত্রীর আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। অনেক শিক্ষার্থী মাসের পর মাস কলেজে উপস্থিত হয় না। এসএসসি পাশের পর অনেক অসচ্ছল পরিবারের সন্তানরা চাকরিতে ব্যস্ত হয়ে যায়। সারা বছর পড়াশোনায় সম্পৃক্ত না থেকে পরীক্ষার ভেন্যু/হলের ভাগ্যের ওপর তীর্থের কাকের মতো বসে থাকে।

২. ছাত্রছাত্রীদের বড় একটি অংশ শ্রেণিকক্ষে শেখার চেয়ে কোচিং সেন্টারের পড়াশোনাকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে, শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ এখন কোচিং সেন্টারের হাতে!

৩. ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটি ভুল ধারণা কাজ করে-পরীক্ষার খাতায় কিছু একটা লিখলেই নম্বর পাওয়া যায়। বিভিন্ন সময় প্রশ্নে থাকা প্যাসেজগুলোর মাঝখানে তারা প্যারাগ্রাফ ও কম্পোজিশনের নামটা লিখে দেয়। পরীক্ষার্থীরা এতে নম্বর পাওয়ার দাবি করে এবং পরবর্তীকালে শিক্ষকদের/পরীক্ষকদের দোষারোপ করতে দ্বিধাবোধ করে না। অনেক শিক্ষার্থী মনে করে, তারা একই মানের লিখে পুরো মাধ্যমিক স্তর পার করে আসছে। পরবর্তীকালে তারা অসন্তুষ্টি নিয়ে রি-স্কুটিনির (রি-চেক) আবেদন করে।

৪. একশ্রেণির শিক্ষার্থী কথিত কিছু গাইড ‘Touch and Pass’, ‘Magic English’ এবং ‘একটা শিখলে অনেক শেখার টেকনিক’ টাইপের বই খুঁজে শিক্ষাজীবন পার করে দেয়।

৫. ছাত্রছাত্রীরা মেমোরাইজেশনের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়। পরীক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ প্রশ্নই বোঝে না-বোঝার চেষ্টাও করে না। মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভর করা এসব দুর্বল শিক্ষার্থীর কাছে প্রশ্ন সহজ আর কঠিন একই কথা।

৬. এইচএসসিতে আবশ্যিক বিষয় বাংলা ও আইসিটির তুলনায় ইংরেজি ছাত্রছাত্রীদের কাছে অনেক কঠিন। আইসিটি বিষয়ে প্রথম তিন অধ্যায় (প্রথম বর্ষ ও দ্বিতীয় বর্ষে) পড়লে মোটামুটি কমন পড়ে যায় এবং ৬০-৭০ শতাংশ নম্বর অনায়াসেই পাওয়া যায়। বাংলা বিষয়ের বিগত ২-৩ বছরের বোর্ডের প্রশ্নগুলো আয়ত্ত করে অনধিক ৬০ শতাংশ নম্বর সহজে পাওয়া যায়। পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর ছাত্রছাত্রীদের কাছে প্রশ্ন সহজের চেয়ে কমন পড়া একটা বড় ব্যাপার। তাছাড়া বাংলা ও আইসিটি বিষয়ের প্রশ্নে অপশন দেওয়া থাকে। যেমন-বাংলা দ্বিতীয় পত্রে পাঁচটি রচনার মধ্যে একটি রচনা লিখতে হয় এবং প্রতিটি প্রশ্নের মধ্যে অপশন দেওয়া থাকে। ইংরেজি বিষয়ে কোনো প্রশ্নের মধ্যে অপশন থাকে না। তাছাড়া গত ১০ বছর এ বোর্ডের প্রশ্ন পড়ে যে কোনো কিছু হুবহু কমন আসবে, এর কোনো গ্যারান্টি নেই। প্রকৃতপক্ষে ইংরেজি বিষয়টি বেসিকনির্ভর।

৭. তাছাড়া এইচএসসির ফরম পূরণের সময় শিক্ষা বোর্ডের নিয়মবহির্ভূতভাবে (ঢালাওভাবে) ফরম পূরণও ফলাফল বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

৮. শিক্ষা বোর্ডে নিয়োজিত পরীক্ষকদের মধ্যে নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম মানসিকতা কাজ করে।

৯. জেলা শহর ও মহানগরীর বেশিরভাগ কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে উপচেপড়া ভিড় থাকে। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের কারণে এসব কলেজে পাশের হার অনেক বেশি। কিন্তু মফস্বলের অনেক বড় কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে পর্যাপ্ত ছাত্রছাত্রী নেই। ব্যবসায় শিক্ষা এবং মানবিক বিভাগকেন্দ্রিক এসব কলেজে ইংরেজিতে অকৃতকার্যের হার বেশি থাকে। ২০২৪ সালের (চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের) এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মানবিক বিভাগে পাশের হার ৫৭.১১ শতাংশ, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ৭৩.৫২ শতাংশ এবং বিজ্ঞান বিভাগে ৯১.৩৩ শতাংশ। বিজ্ঞান বিভাগ ভালো ফলাফলের ক্ষেত্রে নিয়ামক শক্তি হিসাবে কাজ করে।

সম্ভাব্য প্রতিকার : ১. ফলাফল উত্তরণ তথা মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে মাউশি এবং শিক্ষাবোর্ডগুলো ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি, শ্রেণি কার্যক্রম মনিটরিং এবং অভিভাবক সমাবেশ ফলপ্রসূ করার ব্যাপারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জোরারোপ করতে পারে। ২. ফরম পূরণের সময় শিক্ষা বোর্ডের বিধিনিষেধ পুরোপুরি মেনে চলা। নির্বাচনি পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীরা যাতে ফরম পূরণের আওতায় না আসে, সেদিকে বোর্ড কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি রাখা। ৩. ইংরেজি বিষয়কে আরও ফ্লেক্সিবল করার জন্য, বিশেষ করে কম্পোজিশন পার্টে অপশনের (২/৩) ব্যবস্থা করা। ৪. যেসব কলেজের ফলাফল ৫০ শতাংশের নিচে, সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে শিক্ষা বোর্ডগুলো শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং ফলাফল উত্তরণ শীর্ষক একটি কর্মশালার আয়োজন করতে পারে। ২০২০ সালের আগে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডসহ কয়েকটি বোর্ডে ফলাফল-পরবর্তী (ইংরেজি ও আইসিটি শিক্ষকদের নিয়ে) এ ধরনের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতো। ৫. শিক্ষা বোর্ডগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের সুষম বিতরণ ব্যবস্থা (লটারির মাধ্যমে) নিশ্চিত করতে পারে। দেখা যায়, অনেক এমপিওভুক্ত কলেজে প্রতি শিক্ষাবর্ষে ১২০০-২৪০০ ছাত্রছাত্রী, অপরদিকে অনেক প্রতিষ্ঠান ছাত্রছাত্রীর অভাবে অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে, যদিও একই মানের শিক্ষকরা পাঠদান করে আসছেন। ছাত্রছাত্রী ভর্তির ক্ষেত্রে যদি সুষম বণ্টন হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে, ছাত্র সংকটে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোও নতুন গতি পাবে। সর্বোপরি, শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের মাধ্যমে এ সমস্যা অনেকাংশেই সমাধান হবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস।

মো. ছলিম উল্লাহ আজাদ : সহকারী অধ্যাপক (ইংরেজি); চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষক, নিরীক্ষক, পুনঃনিরীক্ষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম