Logo
Logo
×

বাতায়ন

প্রয়োজন বাজার সংস্কার কমিশন

Icon

ড. আলী রেজা

প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রয়োজন বাজার সংস্কার কমিশন

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক দলগুলো যেমন স্বস্তি পেয়েছে, সাধারণ মানুষও তেমনি স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। তবে সাধারণ মানুষের স্বস্তি প্রকাশের পেছনে অন্যতম যে প্রত্যাশা ছিল তা হলো, নতুন সরকার নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনবে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস ওঠা মানুষ কিছুটা স্বস্তি ফিরে পাবে। কিন্তু বাস্তবে সাধারণ মানুষের সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এ ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকার শুরু থেকেই আগের সরকারের দীর্ঘদিনের নৈরাজ্য, অব্যবস্থাপনা ও বাজার সিন্ডিকেটকে দায়ী করে আসছে। কিন্তু আগের সরকারের নৈরাজ্য, অব্যবস্থাপনা ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য নির্মূল করার জন্যই তো ছাত্র-জনতা বর্তমান সরকারকে দায়িত্ব দিয়েছে। বস্তুত সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন পেয়েও বর্তমান সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে কোনো সফলতা দেখাতে পারছে না। পূর্ববর্তী সরকারের আমলে সাধারণ মানুষ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে যেমন নাকাল ছিল, এখনো প্রায় তেমনই আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। এর কারণ খতিয়ে দেখাও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

কিছুদিন ধরে আলুর দাম নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ চলছে। আলুর এমন মূল্যবৃদ্ধি কেউ কখনো দেখেনি। বাংলাদেশের গরিব মানুষ, দিনমজুর, এমনকি মেসে থাকা ছাত্র-জনতা-যারা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান-তাদের খাদ্যতালিকায় নিত্যদিনই আলুভর্তা-ভাত থাকে। আমি নিজেও কিছুদিন মেস-জীবনযাপন করেছি। তখন বেশিরভাগ দিনই আলুভর্তা ও পাতলা ডাল দিয়ে সকালের নাশতা সারতে হয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, বাংলাদেশে নিম্ন আয়ের মানুষের প্রধান অবলম্বন আলু। আলুর এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের এখন সত্যি সত্যিই ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। চালের চেয়ে আলুর দাম বেড়ে যাওয়ায় আমার এক রাজনীতিক বন্ধু সেদিন ব্যঙ্গ করে বললেন, বেশি বেশি ভাত খাও, আলুর ওপর চাপ কমাও। সত্যিই আলুর এমন মূল্যবৃদ্ধি এর আগে কখনো দেখা যায়নি। বাজারে নতুন আলু উঠলে আলুর দাম যে হারে কমে, এবার সে হারে কমতে দেখা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে সরকারের নির্বিকার থাকার বিষয়টি সাধারণ মানুষকে হতাশ করছে। আলুর দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট দেখা দেয়। এ সংকটের ফলে সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধি পায়। সরকারের তরফ থেকে ৮ শতাংশ দাম বৃদ্ধি করে মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। অবাক করার বিষয় হলো, দাম বৃদ্ধির পর বাজারে আর সয়াবিন তেলের সংকট দেখা যাচ্ছে না। এটি মজুতদারদের একটি কৌশল ছিল বলে মনে হয়। দাম বাড়ানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে একটি চক্র এ ধরনের কৌশল অবলম্বন করেছে। দাম বৃদ্ধির পর বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় প্রমাণিত হয় অসাধু ব্যবসায়ীরা তা মজুত করে রেখেছিল। বাজার সিন্ডিকেটের এ অপতৎপরতা বিগত সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। সে সময় আওয়ামী লীগ সমর্থিত ব্যবসায়ীরাই সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে শোনা যায়। কিন্তু বর্তমান সরকার কারও দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয় বলে বিশ্বাস করে সাধারণ মানুষ। এ সরকার কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দিতে বাধ্য নয়। বিপ্লবী ছাত্র-জনতা এ সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে এবং সব রাজনৈতিক দল সমর্থন দিয়েছে। তাই এ সরকার যে কোনো দলীয় সরকারের চেয়ে শক্তিশালী। বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকারকে সেই শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন সত্ত্বেও যদি এ সরকার ব্যর্থ হয়, তাহলে তা হবে জাতির জন্য একটি দুর্ভাগ্যের বিষয়। বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোও মনে করে, এ সরকার ব্যর্থ হলে ছাত্র-জনতার বিজয় ব্যর্থ হয়ে যাবে।

অন্তর্বর্তী সরকার এ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে ১৩টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এসব কমিশনের কাজ চলমান রয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে এবং এ কমিশন নিয়ে কোনো পক্ষের আপত্তির কথা শোনা যায়নি। তবে অনেক সংস্কার কমিশন গঠন করা হলেও বাজার নিয়ন্ত্রণ ও বাজারব্যবস্থা সংস্কারের জন্য কোনো কমিশন গঠন করা হয়নি। বিদ্যমান ব্যবস্থার আওতায় বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করার কোনো পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়। টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে কয়েকটি পণ্য বিক্রির আওতা বাড়ানো হলেও তার কোনো প্রভাব বাজারে পড়েনি। এক্ষেত্রে আগের অব্যবস্থাপনাই বিদ্যমান থাকতে দেখা গেছে। ছাত্রদের মাধ্যমে সারা দেশে ন্যায্যমূল্যে সবজি বিক্রির একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু সে উদ্যোগ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ‘জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর’ নামে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান আছে। প্রতিষ্ঠানটিকে মাঝেমাঝে নামিদামি কোম্পানিকে জরিমানা করতে দেখা যায়। মাঠপর্যায়ে এ প্রতিষ্ঠানটির তৎপরতা আরও জোরদার করা জরুরি।

অন্তর্বর্তী সরকার উচ্চপর্যায়ের প্রশাসনিক সংস্কারের কাজ দক্ষতার সঙ্গেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। এ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও কোনো ভিন্নমত নেই। সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্ট জমা দেওয়ার সময়সীমা আরও এক মাস বাড়ানো হয়েছে। তাতেও কোনো সমস্যা নেই। একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বার্থে এ সবকিছুই মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু খাদ্য ছাড়া মানুষের একদিনও চলে না। প্রতিদিন বাজার করতে হয়। তিনবেলা না হলেও দুবেলা খেতে হয়। অস্বীকার করার উপায় নেই, দ্রব্যমূল্য যে হারে বেড়েছে, সাধারণ মানুষের আয় সে হারে বাড়েনি। নিম্নআয়ের মানুষ যথেষ্ট কষ্টে আছে। যারা নিম্নবেতনে চাকরি করে তাদের বেতনের টাকায় চলছে না। বাধ্য হয়ে তাদের খাদ্যতালিকা ছোট করতে হচ্ছে। খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হচ্ছে অনেক প্রয়োজনীয় খাবার।

সামনে রমজান মাস। রমজান উপলক্ষ্যে মুসলিম বিশ্বে ভোগ্যপণ্যের দাম কমে যায়। সেসব দেশে ব্যবসায়ীরা রমজান মাসে মুনাফা কম করেন বলে শোনা যায়। দুঃখজনক হলেও বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। রমজান উপলক্ষ্যে এদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে দাম বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবছরই বলা হয়, রমজানে ভোগ্যপণ্যের কোনো সংকট হবে না। পর্যাপ্ত মজুত আছে। তাই দাম বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সরকার পক্ষের এ গৎবাঁধা কথা কেউ বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস করেও কোনো লাভ হয় না। রমজান এলে সাধারণ মানুষকে দাম বৃদ্ধির জাঁতাকলে পিষ্ট হতেই হয়। বর্তমান বাজারে চাল, ডাল, তেল, আলু, পেঁয়াজসহ ভোগ্যপণ্যের যে দাম, রমজান মাস সামনে রেখে সে দাম যদি আরও বৃদ্ধি পায়, তাহলে জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করবে। ইতোমধ্যে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য মহার্ঘভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। এতে সরকারি চাকরিজীবীরা উপকৃত হলেও নিম্নআয়ের মানুষদের দুর্ভোগ বাড়বে। কারণ মহার্ঘভাতার ঘোষণা আসার পরপরই আরেক দফা নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা।

নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য বিদ্যমান বাজারব্যবস্থার সংস্কার করা জরুরি। এজন্য বাজারব্যবস্থা সংস্কার কমিশন গঠনের কথা বলছেন সচেতন মহলের অনেকেই। একটি পণ্য উৎপাদন পর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত সর্বোচ্চ কত শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি হতে পারে এবং কে কত শতাংশ মুনাফা করতে পারবে, তার একটি নীতিমালা তৈরি করা এবং কোন প্রক্রিয়ায় নীতিমালা বাস্তবায়ন করা হবে, সে ব্যাপারে সুপারিশ প্রণয়ন করা বাজার সংস্কার কমিশনের কাজ হতে পারে। দেশের বাজারব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করার জন্য অসাধু সিন্ডিকেট বা মজুতদার চক্রই প্রধানত দায়ী। বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক আনুকূল্য পেয়ে এ ধরনের চক্র গড়ে উঠেছিল। বর্তমান সরকার নির্দলীয় নিরপেক্ষ। এ সরকার কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর কাছে দায়বদ্ধ নয়। তাই এ সরকারের পক্ষে অসাধু সিন্ডিকেট বা চক্রকে নির্মূল করা অসম্ভব নয়। এ ব্যাপারে সরকারের ব্যর্থতা সরকারের সদিচ্ছাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। লক্ষণীয়, শুধু আলু-সয়াবিন তেল নয়, ডিম ও ব্রয়লার মুরগির দামও এখন নিম্নআয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সবজির ভরা মৌসুমেও এর দাম খুব বেশি কমেনি। তাই বলে কৃষক কিন্তু ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। ভোক্তাকে জিম্মি করে মধ্যস্বত্বভোগীরা হাতিয়ে নিচ্ছে অযৌক্তিক মুনাফা। এ অবস্থায় সরকারকে স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষের কথা ভাবতে হবে। মনে রাখতে হবে, নিত্যপণ্য, বিশেষ করে ভোগ্যপণ্যের দাম সহনীয় মাত্রায় স্থিতিশীল রাখতে পারা একটি সরকারের সবচেয়ে বড় সফলতা। অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে সফলতার পরিচয় দিক-সর্বস্তরের মানুষ এমন প্রত্যাশাই করে। জনসমর্থন ও রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন এ সরকারের সবচেয়ে বড় শক্তি হলেও এ শক্তি কিন্তু খুব সহজেই নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। একটি বাস্তব সত্য স্বীকার করতেই হবে যে, নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এ সরকার ক্রমেই জনসমর্থন ও রাজনৈতিক সমর্থন হারাতে থাকবে। সুতরাং উৎপাদন, আমদানি, সরবরাহ, বাজারজাতকরণ-এসব পর্যায়ে কোনো অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা থাকলে তা দ্রুত নিরসনের জন্য বিদ্যমান ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় কোনো সীমাবদ্ধতা থাকলে সেটি দূর করতে হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও সহনীয় পর্যায়ে রাখার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে প্রয়োজনে একটি বাজার সংস্কার কমিশন গঠন করা যেতে পারে।

ড. আলী রেজা : সহকারী অধ্যাপক, শহীদ জিয়া মহিলা কলেজ, ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম