কিশোর গ্যাং হয়ে ওঠার দায় কি সমাজ এড়াতে পারে?
ড. রাজীব চক্রবর্তী
প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
খবরের কাগজ ও টেলিভিশনে কিশোর গ্যাংয়ের খবর শিরোনাম হচ্ছে অনেকদিন ধরেই। খুব ঠুনকো বিষয় নিয়ে হাতাহাতি, মারামারি এবং কখনো বা কোনো কিশোরের নিথর দেহ নিয়ে মায়ের আর্তনাদ। সমাজে এই যে নতুন এক অবক্ষয়ের সূচনা হয়েছে, ভাববেন না, শুধু কম বয়সে লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়া নিুবিত্ত পরিবারের ছেলেরা এগুলো করছে; উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের উঠতি বয়সি আইনের চোখে নাবালক কিশোররাও বখাটে ছেলের তকমা লাগাচ্ছে। এক পরিসংখ্যান বলছে, গত তিন বছরে অর্ধশতাধিক মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে কিশোর গ্যাংয়ের নাম জড়িয়ে গেছে। সমাজের এ অবক্ষয় কোথায় বা কীভাবে শুরু হলো, কারা এসবে মদদ দিচ্ছে, তা জানার জন্য দরকার একটু পেছনে ফিরে তাকানো।
একটা সময় ছিল যখন স্কুল-কলেজে রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী, পহেলা বৈশাখ উদযাপন হতো। নাম না জানা পাড়ার অসংখ্য সাংস্কৃতিক সংগঠন তাতে অংশগ্রহণ করত। আবার সংগঠনগুলোর আয়ের উৎস ছিল বেশ চমকপ্রদ। স্কুল ও সদ্য কলেজে ওঠা ছেলেমেয়েরা নিজেদের জমানো টাকা থেকে অল্প চাঁদা দিয়ে তাদের সংগঠনের দৈনন্দিন খরচ, রিহার্সেল ও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের খরচ মেটাত। আর বাবা-মাও নিশ্চিন্ত মনে তাদের ছেলেমেয়েদের, বিশেষ করে স্কুলের মেয়েদের বিভিন্ন সংগঠনের বৈকালিক রিহার্সেলে পাঠাতেন।
এক সময় নির্মাণ স্কুল ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ছিল ছেলেদের জন্য বিশাল এক পাওয়া। এমনও রেওয়াজ ছিল যে, এসএসসি পরীক্ষার আগে ক্রীড়া শিক্ষকরা ভালো খেলোয়াড়দের নিজেদের স্কুলে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নিতেন। শহরের সবচেয়ে নামকরা স্কুলে ভর্তি হয়ে তারা বেজায় খুশি হতো। কিন্তু শর্ত একটাই-নির্মাণ স্কুল চ্যাম্পিয়ন হতে হবে। কলেজের শিক্ষকরা, এমনকি প্রিন্সিপাল পর্যন্ত খেলার পাগল। সবচেয়ে বেশি আদর পেত ভালো ক্রিকেট খেলা ক্লাস না করা ছেলেটা। বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোও স্পনসর করত নির্দ্বিধায়। শহর ছাড়িয়ে গ্রামে পর্যন্ত বয়সভিত্তিক অনূর্ধ্ব ১৬, ১৮ বছরের কিশোরদের জন্য বড় বড় টুর্নামেন্টের আয়োজন হতো। আর ছিল পাড়ায় পাড়ায় ছুটির দিনে আবাহনী-মোহামেডান দলে ভাগ হয়ে বিকালবেলা ফুটবল ম্যাচ খেলা। পাড়ার মুরব্বিরাও অতিথি হয়ে আসত খেলা দেখতে। তখন আসলে লোকদেখানো কোনো কিছুর জৌলুস বা চাকচিক্যের বড়াই ছিল না। মনের আনন্দে কিশোর-তরুণ সবাই অবসর সময়ে খেলাধুলা, গানবাজনা, আবৃত্তি করত। কত স্কুল পড়ুয়াকে দেখা যেত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গাড়ির জন্য রাস্তার ওপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে! কী যে জনপ্রিয় ছিল টেলিভিশনে ছোটদের নতুনকুঁড়ি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান! আবার রাত ৯টা বাজলেই ছোট-বড় সবাই বসে যেত সাদা-কালো টিভিতে শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তক, হুমায়ূন আহমেদের অয়োময়, কোথাও কেউ নেই ইত্যাদি নাটক দেখার জন্য। পাড়াগুলোতে বিকাল হলেই কিশোর-কিশোরীদের হারমোনিয়ামের শব্দ, লেনিনের প্রতিবাদী গানের আওয়াজ রাস্তা থেকে শোনা যেত। দেশের ব্যান্ডগুলোর তখন সেরা সময়। কলেজের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, তপন চৌধুরীদের গান হতো। সারা দেশ, বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য শহর থাকত যুবসমাজের পদচারণামুখর। কিশোর থেকে শুরু করে তরুণ সমাজের প্রতিচ্ছবি থাকত সর্বত্র।
সে প্রতিচ্ছবি সরিয়ে এখন সেখানে জায়গা করে নিয়েছে কিশোর গ্যাং। এখন কিশোরদের অবসর সময় কাটে পাবজি খেলে, ইন্টারনেটে চ্যাট করে। আসলে বিনোদনের জন্য তাদের আমরা এখন কীই বা দিতে পারছি? পাড়ার ছোট ছোট খালি জায়গাগুলো সব প্রমোটারের কবলে। বেশির ভাগ পাবলিক মাঠ এখন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যে যার মতো করে ব্যবহার করছে। চট্টগ্রামের কিশোর-তরুণদের প্রিয় আউটার স্টেডিয়াম এখন হয়েছে উচ্চবিত্তের সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র অথবা বিভিন্ন মেলার আদর্শ জায়গা-আগে যেখান খেলেছেন নান্নু, আকরাম খান, তামিমদের মতো ক্রিকেটাররা; দেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন তারা। স্কুলের খেলার মাঠগুলো এখন ছাত্র সংকুলানের নামে নতুন দালানে পরিণত হয়েছে। এখনকার শহরের কিশোররা আর অন্যের বাগানের আম চুরি করতে যায় না। পুকুরে সাঁতারও কাটে না। হয় কিশোরদের সময় নেই, নয়তো শহরে গাছ, পুকুর কোনোটাই আগের মতো নেই। আগে স্কুলে দেরি তো দূরের কথা, অ্যাসেম্বলিতে না থাকলেই খেতে হতো মাস্টারমশাইয়ের বকুনি। আর এখন মাস্টারমশাই ঠিকই আছেন, নেই শুধু শাসন।
দুই দশকেরও কম সময়ের ব্যবধানে বৈশ্বিক পরিবর্তনের ফলে দেশীয় সংস্কৃতিতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা পূরণের কি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? হয়নি। খেলাধুলার মাঠগুলো ইচ্ছামতো বন্ধ করা হয়েছে। এর বিকল্প কোনো ব্যবস্থা কি নেওয়া হয়েছে? হয়নি। তাহলে এ কিশোর-তরুণরা কীভাবে তাদের অবসর সময় কাটাবে?
তখনকার অভিভাবকরা নির্দিষ্ট আয়ের মধ্যে সুন্দর সংসার চালিয়ে নিতে পারতেন। পারিপার্শ্বিকতার কারণে ছেলেমেয়েরা ভালোর সঙ্গে এবং আলোর মধ্যে থাকত। বাবা-মাও সন্তানদের সময় দিতে পারতেন, তারা সরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী-যাই হোন না কেন। মোট কথা, যে যার পেশায় সম্মান পেতেন। ফলে তারা তাদের ছেলেমেয়েদের দিকে নজর দিতে পেরেছেন। তাদের হাতে সময়ও ছিল। এখন তো কর্মজীবী বাবা-মার সময়ই নেই। সারাদিন অফিসে ব্যস্ত অভিভাবকরা অধিক আয়ের আশায় নিজেদেরই সময় দিতে পারেন না, ছেলেমেয়েকে সময় কীভাবে দেবেন? এভাবেই লাগামহীনতার ফলে বিভিন্ন অসৎ সঙ্গে পড়ে অবুঝ কিশোররা ধীরে ধীরে খারাপের দিকে ধাবিত হয়ে শেষে বখাটে নামে পরিচিতি পাচ্ছে।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? উপায় আবশ্যই আছে। ফিরিয়ে দেওয়া হোক কিশোরদের সুস্থভাবে অবসর কাটানোর সুযোগ। কী অসুবিধা বিনোদনের জায়গাগুলো সাধারণ মানুষের কাছে আবার ফিরিয়ে দিতে? বিশেষ করে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর দায়িত্ব এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। বল প্রয়োগ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্য নিয়ে এই অবুঝদের হয়তো সাময়িকভাবে শোধরানো যাবে, কিন্তু সামাজিক অবক্ষয় থেকে মুক্তির জন্য দরকার সম্মিলিত প্রচেষ্টা। শুধু রাষ্ট্রের একার পক্ষে এটা সম্ভব নয়। আমাদের নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে। আগে আমাদের পরিবারিক মূল্যবোধ ছেলেমেয়েদের শেখাতে হবে। তবেই সমাজ পরিবর্তিত হবে, এই অবক্ষয় দূর হলে দেশের কল্যাণ হবে।
ড. রাজীব চক্রবর্তী : গবেষক ও লেখক
email keralamphil@gmail.com