নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিলম্ব করা ঠিক হবে না

এ টি এম মোস্তফা কামাল
প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ছবি
সংস্কারক কে? প্রধান উপদেষ্টা নাকি উপদেষ্টা পরিষদ? যিনি সংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন, তাকে ঠিক করতে হবে কোথায় কোন ধরনের সংস্কার তিনি করতে চাচ্ছেন। কোন সংস্কার তার এখতিয়ারাধীন আর কোন সংস্কার তার এখতিয়ারবহির্ভূত, সেটাও তাকে জানতে হবে। এখতিয়ারবহির্ভূত কোনো সংস্কারে হাত না দেওয়াই সর্বোত্তম পন্থা। এখতিয়ারাধীন বিষয়ের মধ্যে যে কাজগুলো অতিদ্রুত শুরু করে দেওয়া যায়, সে কাজগুলো একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে শুরু করে দিতে হবে। দেশের সেরা যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করতে হবে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে, অতিদ্রুত সেটা নিষ্পত্তি করতে হবে। সরকারের দলনিরপেক্ষ ভূমিকা অক্ষুণ্ন রাখতে হবে, সব নিয়োগ-পদায়নে তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। শক্তিশালী সরকার এবং সরকারের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সেনাবাহিনীকে মাঠে রেখে (সেনা কর্মকর্তাদের মেজিস্টেরিয়াল ক্ষমতাসহ) শান্তিশৃঙ্খলার উন্নয়ন সাধন করা না গেলে কখন কীভাবে সেটা করা যাবে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারলে এতদিনে ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ডের শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব হতো। ঢাকা শহরসহ সমগ্র দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে সমগ্র জাতি হতাশাগ্রস্ত। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দীর্ঘদিন ঢাকায় আত্মগোপনে থেকে নিরাপদে দেশত্যাগের পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যে বক্তব্য দিয়েছেন, জাতি সেটাকে অভিনন্দিত করতে পারেনি। সচিবালয়ের ৭নং ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সমগ্র জাতি স্তম্ভিত। সচিবালয়ের ইতিহাসে এই প্রথম এরূপ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল।
দুর্নীতি ও চাঁদাবাজিকে নির্মূল করার সর্বাত্মক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। সেটা করতে না পারলে দেশের কোনো উন্নয়ন সম্ভব হবে না। চাঁদাবাজির অপরাধকে দণ্ডবিধির অন্তর্ভুক্ত করে জেল-জরিমানার বিধান রেখে মোবাইল কোর্টের আওতায় বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
১৯৭২ সালের Land Holding Limitation Order অনুযায়ী পরিবারপিছু ১০০ বিঘা সিলিং এবং ১৯৮৪ সালের ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ-২০২৩ সালের ভূমি সংস্কার আইন অনুযায়ী পরিবারপিছু ৬০ বিঘা সিলিং অদ্যাবধি মাঠপর্যায়ে কার্যকর করা হয়নি। অতীতের কোনো সরকার সেটা করেনি। সে কাজ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে শুরু করে দিতে তো কোনো আইনি জটিলতা নেই। সেটা কেন শুরু করা হচ্ছে না? সেটা শুরু করে দিতে পারলে সমগ্র দেশে ব্যাপক সাড়া পড়ে যেত। সরকারের জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে যেত।
প্রজাতন্ত্রের সব সম্পত্তি তথা খাল-বিল-নদী-নালা-বন বিভাগের মালিকানাধীন সম্পত্তি, পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়-পর্বত অবৈধ দখলদারের দখল থেকে মুক্ত করে সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ কাজ শুরু করে দিতে বাধা কোথায়? ভূমি মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয় কেন অদ্যাবধি সে কাজটা শুরু করেনি? আমাদের দেশে প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তি যেভাবে অবৈধ দখলকারীরা গিলে খাচ্ছে, ভারতসহ পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে সেরূপ নজির নেই।
পরিবেশদূষণ রোধকল্পে পলিথিন ও প্লাস্টিক বোতলের উৎপাদন এবং বিপণন এখনো কেন শতভাগ নিষিদ্ধ করা যায়নি। নদীদূষণ রোধে কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নেই কেন? সুন্দরবন সুরক্ষার ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে, সেসব দূর করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর কি নিষ্ক্রিয়ই রয়ে যাবে?
বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ, নিজস্ব অর্থায়নে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, সরকারের বিপুলসংখ্যক কর্মচারীর বেতন-ভাতা পরিশোধ এবং সরকারের অন্য ব্যয় মেটানোর জন্য রাজস্ব খাতে আয় বাড়ানো অত্যাবশ্যক। বড় বড় এনজিও, বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রাপ্য আয়কর রাজস্ব আয় বাড়ানোর বিশাল উৎস। যারাই ব্যবসা করবে, আয় করবে, তাদের অবশ্যই আয়কর দিতে হবে। তাদের কাউকে কোনো রূপ আয়কর ছাড় দেওয়া সঠিক হবে না। তাদের প্রদত্ত আয়কর অব্যাহতির সুবিধা প্রত্যাহার করা হলে বাংলাদেশের রাজস্ব আয় ২-৩ গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। তাদের লাখো কোটি টাকার আয়কর অব্যাহতি দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আয়কর আদায় করার নীতি চরম বৈষম্যমূলক এবং পক্ষপাতদোষে দুষ্ট। প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে ট্যারিফ সুবিধা দিয়ে যে ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি করা হয়েছে, সেটা রিভিউ করে আন্তর্জাতিক মানের ট্যারিফ ধার্য করা অত্যাবশ্যক। সেটা করার আগে ওই চুক্তির কার্যকারিতা স্থগিত করা যেতে পারে।
দেশের স্বাস্থ্য খাতের প্রায় ৮০ শতাংশ অকার্যকর। ঢাকা শহরের বাইরে প্রায় সব হাসপাতাল বহুলাংশে অকার্যকর। আর ঢাকা শহরের সরকারি হাসপাতালগুলোয় রয়েছে রোগীদের মাত্রাতিরিক্ত চাপ। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, একই ডাক্তার দিয়ে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল একই সঙ্গে চলতে পারে না। বেসরকারি হাসপাতালকে তার নিজস্ব জনবল দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। সরকারি কোনো ডাক্তারকে বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করতে দেওয়া যাবে না। তবে সরকারি ডাক্তাররা অফিস সময়ের পর তাদের কর্মস্থলে সরকারি হাসপাতালে বসে প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করতে পারবেন। রেজিমেন্টাল ফোর্সের মতো ডাক্তার এবং সাপোর্টিং স্টাফদের কর্মস্থলে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। এটা করা গেলে স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থা বহুলাংশে দূরীভূত হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অবিলম্বে সে কাজটি করতে হবে। বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ১০ থেকে ১৫ লাখ রোগী ভারতে যাচ্ছে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য-কত বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা এর পেছনে ব্যয় হচ্ছে! ইন্ডিয়া থেকে তো কোনো রোগী চিকিৎসা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশে আসছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরদিন থেকে এ কাজগুলো শুরু করে দিতে পারত। তা না করে তারা শুধু অপেক্ষা আর সময়ক্ষেপণ করছেন। জনগণ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে এরূপ আচরণ প্রত্যাশা করেনি।
সরকার অনেক সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। কোনো কোনো সংস্কার কমিশনের বক্তব্য নিয়ে জনমনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। জনপ্রশাসন সুদীর্ঘকাল ধরে চলে আসা একটা সুপ্রতিষ্ঠিত সেট-আপ। ৯০-পরবর্তী সময়ে দলীয়করণের ফলে এবং অনুমোদিত পদের চেয়ে অধিকসংখ্যক পদে পদোন্নতি প্রদান করায়, রাজনৈতিক আমলাদের দুর্নীতিতে সহায়তা করতে বাধ্য করায় জনপ্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতের জনপ্রশাসন ব্রিটিশ আমলের ধারাবাহিকতা অটুট রেখে সম্মুখ পানে এগিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক দলই যেন প্রশাসনকে দলীয়করণ করতে না পারে, অনুমোদিত পদের অতিরিক্ত কোনো পদে যেন পদোন্নতি দিতে না পারে, ইকোনমিক-সচিবালয় ক্যাডারের পুনঃপ্রবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে কমিশন সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করতে পারে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ কাজগুলো নিজ থেকেই করতে পারে। উল্লেখ্য, সচিবালয়ের পুরোনো ভবনগুলোর সংস্কারকাজ প্রায় ক্ষেত্রেই সম্পন্ন করা হয়েছে। স্ট্রাকচারাল ডিজাইন ক্ষতি হতে পারে, এমন কোনো সংস্কারকাজ কিন্তু করা হয়নি। জনপ্রশাসনের স্ট্রাকচারাল ডিজাইনকে ক্ষতিগ্রস্ত করার মতো কোনো সুপারিশ প্রদান করা কমিশনের উচিত হবে না।
শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের প্রধান উদ্দেশ্য হবে ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ড অর্জন করে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে গ্লোবাল সিটিজেন হিসাবে গড়ে তোলা। সেজন্য যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়া, এ চারটি দেশের যে কোনো একটি দেশ বেছে নিয়ে সেদেশের শিক্ষাব্যবস্থার আদলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো যায়। সেটা কোনো কঠিন কাজ নয়। ভারতীয় তরুণদের দিকে তাকিয়ে দেখুন, তারা কী করে সারা বিশ্বে তাদের শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের ক্ষেত্রে সংসদীয় আসনের মোট ভোটারের ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পেলে কোনো প্রার্থীকে জয়ী বলে ঘোষণা করা যাবে না। মনোনয়ন বাণিজ্যের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা যাতে সংসদে অধিক সংখ্যায় আসতে না পারে, সেজন্য ব্যবসায়ীদের পেশাভিত্তিক কোটা নির্ধারণ করে দেওয়া যায়। সে কোটা যদি হয় ৫ শতাংশ, ব্যবসায়ীরা সেটা অতিক্রম করতে পারবে না। সংসদ-সদস্যদের অধিক্ষেত্র হবে সংসদ ভবন, ১৯৯০ সাল পর্যন্ত যা কার্যকর ছিল। ইভিএম নয়, ব্যালট মাধ্যমে ভোট হবে। নির্বাচনব্যবস্থায় এটুকু সংস্কারই যথেষ্ট। (সরকারের সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আমার লেখা ‘রাজনীতি, সুশাসন ও উন্নয়ন’ বইটি হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ)।
ধরুন, বাংলাদেশ সেনা কর্তৃপক্ষ আর্মি স্টেডিয়ামে জমকালো কনসার্ট আয়োজনের কথা প্রচার করে বিপুলসংখ্যক দর্শক সমাবেশ ঘটাতে সক্ষম হলো। রাত ৮ ঘটিকায় সেটা শুরু হওয়ার কথা। দর্শকদের মাতিয়ে রাখতে না পারলে দর্শকরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে আসন ছেড়ে চলে যেতে পারে, এ আশঙ্কায় একটু বিলম্ব করে ৯ ঘটিকায় সেটা শুরু করা হলো। কিন্তু কনসার্টের টিম ভালো গান বাদ্য পরিবেশন করে দর্শকদের মাতিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলে রাত ১২ ঘটিকার দিকে স্টেডিয়াম দর্শকশূন্য হয়ে পড়বে। ঠিক তেমনিভাবে অন্তর্বর্তী সরকার যদি উপযুক্ত উপদেষ্টামণ্ডলী দিয়ে সঠিক কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করে সংস্কার কাজ শুরু করে দিতে পারত, তাহলে জনগণ নির্বাচনের কথা ভুলে যেত, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দিয়ে যেত এবং অন্তর্বর্তী সরকারের স্থায়িত্ব জনপ্রিয়তার ওপর নির্ভর করে ৫ বছর পর্যন্ত গড়াতে পারত। কর্মক্ষেত্রে একই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা সে রকমই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সংস্কার কার্যক্রম শুরু করার জন্য আরও ৬ মাস থেকে ১ বছর সময় দিতে জনগণ সম্মত হবে না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তাই আগামী জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা করাটাই হবে সর্বোত্তম পন্থা।
এ টি এম মোস্তফা কামাল : অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব