কীটনাশকের বিবেচনাহীন ব্যবহারের ঝুঁকি
ড. মো. গোলাম ছারোয়ার
প্রকাশ: ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
হৃদয়ে পৃথিবীর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমাদের শুধু বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলো বোঝাই প্রয়োজনীয় নয়, আমাদের বৈশিষ্ট্যসূচক নৈতিক নির্বুদ্ধিতা আর কল্পনাপ্রবণ অদূরদর্শিতাও বোঝা প্রয়োজন। ম্যালেরিয়া ও টাইফয়েডের নিয়ন্ত্রণে জাতিসংঘ, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাসহ পঞ্চাশের দশকে যখন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডিডিটি (dichloro-diphenyl-trichloroethane) ব্যবহারের জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করত, তখন মানুষ বুঝত না ডিডিটি ধরিত্রীর জন্য আশীর্বাদ না অভিশাপ। ১৯৪৮ সালে ডিডিটির আবিষ্কারক পল হ্যারম্যান মুলারকে দেওয়া হয় নোবেল পুরস্কার। মনে করা হতো, এ আবিষ্কার মানুষের জন্য এক আশীর্বাদ। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই যখন এর বিরূপ প্রভাব লক্ষ করা যায়। তবে ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বড় কোম্পানি ডিডিটি ও অন্যান্য কীটনাশক তৈরি ও বিক্রি করে অঢেল অর্থের মালিক বনে যায়। এমনি এক সন্ধিক্ষণে র্যাচেল লুইস কার্সন নামে এক মেরিন বায়োলজিস্ট স্রোতের বিপরীতে গিয়ে ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’য়ের এক চরম বাস্তব গবেষণালব্ধ বই প্রকাশ করে সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এ লেখক ১৯০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক ছোট্ট একটি খামারে বেড়ে ওঠা এ গবেষক জীবনের সূচনালগ্ন থেকেই প্রকৃতি আর জীবজগৎকে আপন করে নিয়েছিলেন। তাই তো চ্যাটহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাছের রেচনতন্ত্রের ওপর মাস্টার্স শেষ করেন। প্রকৃতিপ্রেমী কার্সন নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের মৎস্য ব্যুরোর সম্প্রচারিত ‘রোমান্স আন্ডার দ্য ওয়াটার’ নামক অনুষ্ঠানে পাণ্ডুলিপি লেখার দায়িত্বে নিয়োজিত করেন। এতেই স্পষ্ট হয়, তিনি যুক্তরাষ্ট্রবাসীকে মেরিন বায়োলজি বিষয়ে অত্যন্ত চমৎকারভাবে সম্যক জ্ঞান বিতরণে কতটা তৎপর ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ফায়ার অ্যান্ট ইরাডিকেশন করার জন্য ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচার ডিডিটির সঙ্গে আরও কিছু কীটনাশক ও জীবাশ্মজ্বালানি মিশিয়ে স্প্রে করার কারণে পেনসিলভানিয়ার বাসিন্দারা প্রতিবাদ করেছিল, এমনকি চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির জন্য আইনের আশ্রয়ও নিয়েছিল। একইভাবে ওগাল ওয়েন্স হ্যাকিন্স নামক একজন মহিলার চিঠির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এ দুঃসাধ্য কাজটি করতে তিনি যথেষ্ট উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। যে ভদ্রমহিলা কার্সনকে চিঠি লিখেছিলেন, তার অভিযোগ ছিল তার এলাকায় অপ্রত্যাশিতভাবে পাখি মারা যাচ্ছে। স্প্রিংয়ে আর পাখির কলকাকলি শোনা যায় না।
১৯৫০-এর দশকের শেষে যুক্তরাষ্ট্র সরকার সামরিক সহায়তাপুষ্ট ল্যাবরেটরিগুলোয় রাসায়নিক কীটনাশক দ্রব্যের ব্যাপক শুরু করেছিল। সবচেয়ে জনপ্রিয় কীটনাশকটি ছিল ডাইক্লোরো-ডাইফিনাইল-ট্রাইক্লোরোইথেন (ডিডিটি)। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলোয় ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহনকারী মশা নির্মূল করার জন্য এই পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এর কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করে এটি আবিষ্কারের জন্য রসায়নবিদ পল হেরমান মুলারকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
তবে পরে প্রমাণিত হয়েছিল, ডিডিটি আসলে একটি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন-সুলভ আবিষ্কার। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়েছিল, এটি শুধু ক্ষতিকর মশাই মারছে না, বরং ব্যবহার শুরু হওয়ার বহু মাস পরেও এর প্রভাবে নানা ধরনের কীটপতঙ্গ মারা যায়। অর্থাৎ এর ম্যাক্সিমাম রেসিডিউ লেভেল অনেক হাই। এছাড়া ডিডিটি বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে, নালা, নদী ও নানা জলাশয়ে প্রবেশ করে এর বিষক্রিয়ায় মাছ, শিয়াল, খরগোশ, এমনকি জীবিত প্রায় সব প্রাণী নানা মাত্রায় ক্ষতির শিকার হয়। ডিডিটির অবাধ ব্যবহার বিশ্বের খাদ্য সরবরাহে মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করার শক্তিও ছিল। এ ছাড়া মানুষের শরীরে স্নেহপদার্থ সংগ্রহকারী কোষগুলোয় এটি জমা হয় এবং বায়োএকমোলেশন তৈরি করে, যা পরে ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়। এ বইয়ের কারণে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। যদিও কার্সন প্রতিষ্ঠিত একজন লেখক ছিলেন, তবু বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও খবরের কাগজ তার মতামত বর্জন করতে শুরু করেছিল। যে বিজ্ঞানীরা ডিডিটি আবিষ্কার করতে সহায়তা করেছিলেন, আর যে প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে তারা যুক্ত ছিলেন, তারা ক্ষুব্ধ হয়ে কীটনাশকের ঝুঁকি নিয়ে কার্সনের সাবধানবাণীর বিরুদ্ধে তাদের পালটা যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন। মনসান্টোর মতো কোম্পানিগুলো কার্সনের বইটির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদসহ লেখা প্রকাশ করেছিল এবং একই সঙ্গে কার্সনকে নিয়ে রুচিহীন মন্তব্য করাও অব্যাহত রেখেছিল। কোম্পানির একজন কর্মকর্তার ক্ষুব্ধ মন্তব্য ছিল, ‘যদি সবাই বিশ্বাসের সঙ্গে কার্সনের শিক্ষা অনুসরণ করেন, আমরা তাহলে আবার অন্ধকার যুগে ফিরে যাব এবং পোকামাকড়, অসুখ আর জীবাণুরা আরও একবার পৃথিবী রাজত্ব করবে।’ এজরা টাফট বেনসন, যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের কাছে পাঠানো এক মেমোতে লিখেছিলেন, যেহেতু কার্সন শারীরিকভাবে অনাকর্ষণীয় এবং এখনো অবিবাহিত, তিনি ‘সম্ভবত একজন কমিউনিস্ট’। করপোরেশন আর তাদের রাজনৈতিক মিত্রদের নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও Silent Spring সব দেওয়ালই ভাঙতে পেরেছিল। শক্তিশালী রাসায়নিক করপোরেশনগুলোর পক্ষ থেকে সমালোচনার ভয় বিবেচনায় রেখেই তিনি তার বইটি এমনভাবে প্রস্তুত করেছিলেন, যেন মনে হতো প্রকৃতির পক্ষে এটি একটি আইনি লড়াই। এর সঙ্গে তিনি যুক্ত করেছিলেন ৫৫ পাতার একটি নোট, যেখানে তার যুক্তিগুলোর পক্ষে ছিল অকাট্য সব প্রমাণ। Silent spring শিরোনামটি একটি ভয়ানক ছবি আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছিল, এমন একটি পৃথিবী, যেখানে কোনো গানের পাখি নেই, আসলেই প্রায় কোনো প্রাকৃতিক জীবনই সেখানে নেই। এটি শুরু হয়েছিল একটি নামহীন ছোট আমেরিকান শহরের বর্ণনা দিয়ে, যা পূর্ণ ভোক্তার জন্য সুবিধায়, চোখ ধাঁধানো যন্ত্র আর সস্তা খাদ্যের দোকানে, কিন্তু সেখানে কোনো রবিন বা লেডিবার্ড নেই, লার্ক বা কাঠবিড়ালী নেই। একটি পৃথিবী যা স্পষ্টতই মানুষের সুবিধার্থে পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু পরিণতিতে সেটি আর মানুষের পৃথিবী থাকে না। কার্সন আমাদের তাগিদ দেন প্রকৃতিকে মুক্তি দিতে। এটিকে এর নিজের মতো করে থাকতে দিতে, প্রকৃতি নিজেই এর কীটপতঙ্গের অতি বংশবৃদ্ধি তার নিজের মতো করেই মোকাবিলা করবে। কিন্তু যদি মানুষ সেখানে হস্তক্ষেপ করে, অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো প্রাণীগোষ্ঠী একপর্যায়ে সব বিষের বিরুদ্ধেই তাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলবে এবং তারপর খুব দ্রুত এটি আকারে বৃদ্ধি পাবে। কারণ যে কীটগুলো ক্ষতিকর অন্য কীটগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখে তাদের খাদ্যে পরিণত করে, তারাও কীটনাশকের প্রভাবে অজ্ঞাতসারে মারা গিয়ে ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। ১৯৬২ সালে তার বইটি প্রকাশ হওয়ার ফলে আমেরিকার সিনেটরে তাকে অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছিল। তার সুপারিশগুলোর সত্যতা অনুসন্ধানে রাষ্ট্রপতি বিজ্ঞানবিষক উপদেষ্টাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৯৬৪ তার মৃত্যুর ৮ বছর পর আমেরিকাসহ অন্যান্য রাষ্ট্রে ডিডিটি নিষিদ্ধ হয়েছিল।
আজ আমাদের সময় এসেছে বাংলাদেশে ব্যবহৃত সব কীটনাশকের এমআরএল অর্থাৎ ম্যাক্সিমাম রেসিডিউ লেভেল বা কতদিন পর্যন্ত কোথায় কোথায় কোন কীটনাশকের বিষক্রিয়া বিদ্যমান থাকে, তার তালিকা প্রণয়ন করে সেই মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করার। একই সঙ্গে ফলমূল, শাকসবজি উৎপাদন ও সংরক্ষণে পিএইচআই বা প্রি হারভেস্টিং ইন্টারভেল অর্থাৎ শস্য, ফলমূল, শাকসবজি হারভেস্ট করার ন্যূনতম কত আগ পর্যন্ত কীটনাশক ব্যবহার করা যাবে, তার প্রকৃত গাইডলাইন তৈরি।
মনে রাখতে হবে, প্রকৃতি আমাদের আবাসভূমি। একে কোনো হিংস্রতা, জটিল ও কুটিল চিন্তাভাবনার নিরিখে আপন স্বার্থে ব্যবহার করা যাবে না। শুধুই অর্থনৈতিক লালসার চরিতার্থতায় প্রকৃতির ওপর নির্বিচার আচরণ করা যাবে না। বেশি সৃজনশীল উপায়ে কীভাবে ক্ষতিকর পোকামাকড় থেকে আমরা নিজেদের রক্ষা করতে পারি, এ বিষয়ে চিন্তা করা। যেমন: পোকার নির্বীজন বা তাদের প্রজনন করার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে অথবা ঠিক সেই রাসায়নিক ‘প্রলোভন’ ব্যবহার করে, যা পতঙ্গরা পরস্পরকে ধরার জন্য ব্যবহার করে। অথবা কোনো একটি কম্পাঙ্কের শব্দ ব্যবহার করে, যা লার্ভাদের ধ্বংস করবে। অর্থাৎ ন্যূনতম কীটনাশকের ব্যবহার নিশ্চিত করণে আইপিএম বা সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা এবং আইভিএম বা সমন্বিত বাহক ব্যবস্থাপনার সমন্বয়ে আইপিভিএম বা সমন্বিত বালাই ও বাহক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে FAO ও WHO একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমাদের দেশে কৃষি মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একসঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করবে। প্রকৃতি নিয়ে কোনো কিছু করার আগেই সবসময়ই আমাদের সেটিকে মূল্যায়ন, শ্রদ্ধা আর এর প্রতি সেই বিস্ময় থাকা দরকার।
এবার আসছি মেয়াদোত্তীর্ণ কীটনাশকগুলোর সংগ্রহ, পরিবহণ ও ডিসপোজাল ব্যবস্থাপনা বিষয়ে। এ বিষয়ক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রস্তুতি বড়ই অপ্রতুল এবং যেটুকু আছে তাও নাজুক। এ কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, পরিবেশ ও অন্যান্য প্রাণী অত্যন্ত মারাত্মকভাবে বিষক্রিয়ার শিকার হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিষক্রিয়া সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব, যথাযথ ট্রেনিংয়ের অভাব বিশেষ করে ইমার্জেন্সি রেসপন্স প্লান বা ই আর পি, লিচিং, স্পিলিং, অত্যন্ত কম ফ্লাশ পয়েন্ট সমৃদ্ধ কীটনাশকগুলোর ক্ষেত্রে যথপোযুক্ত তাপমাত্রার ব্যবস্থাপন ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমরা বিশাল ঝুঁকিতে আছি। এসব ক্ষেত্রে আমাদের দেশে রাসায়নিক কীটনাশক রেগুলেটরি অথরিটির ভূমিকা এবং উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর ভূমিকা অবশ্যই মানবতার নিরিখে হওয়া উচিত, অর্থনৈতিক ভাবনার নিরিখে নয়। দেশে এত মানবাধিকার সংগঠন রয়েছে, পরিবেশবাদী সংগঠন রয়েছে, সবার প্রতি আমার আহ্বান থাকবে, আসুন শুধুই স্প্রিং কে নয়, সব ঋতুকেই জীববৈচিত্র্যের মহাসমারোহে ভরিয়ে তুলি। র্যাচেল কার্সনের মতো শত সহস্র বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে নির্মল, সবুজ ও প্রাণবন্ত প্রকৃতি উপভোগ করতে সবার গবেষণা ও কর্মলব্ধ ফলাফল প্রয়োগ করি। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টাতেই দূষণমুক্ত পরিবেশে জীবন গড়া সম্ভব।
ড. মো. গোলাম ছারোয়ার : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)