Logo
Logo
×

বাতায়ন

তবু মাথা নোয়াবার নয়

Icon

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তবু মাথা নোয়াবার নয়

ছবি: সংগৃহীত

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অবিচল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফলে যুগান্তকারী গণ-অভ্যুত্থানের ফসল অন্তর্বর্তী সরকার। নেতৃত্বে রয়েছেন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দায়িত্ব নিয়েই তিনি দেশের জনগণের উদ্দেশে বৈষম্যবিহীন ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারের মাধ্যমে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছেন। যে আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিয়ে গণ-আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, তা ছিল মূলত বিগত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে বহুল কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। ভোটাধিকার ও মানবাধিকার সুরক্ষা, জনজীবনের সামগ্রিক দুর্ভোগ লাঘবসহ অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজের ভিত্তি সুদৃঢ় করাই ছিল এ আন্দোলনের ব্রত। এ ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্র মেরামতের বিষয়টি বিশেষ এজেন্ডা হিসাবে পরিগণিত হয়। দমন-পীড়ন, দুর্নীতি, দুঃশাসন, গুম-খুন ইত্যাদি অপরাজনীতির উপাদানগুলো নস্যাৎ করে আইনের শাসন ও জননিরাপত্তাকে সমধিক প্রাধান্য দেওয়া হয়।

চার মাসের বেশি সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, বর্তমান সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। গণহত্যার জন্য দায়ী প্রকৃত অপরাধীদের স্বচ্ছ বিচারের সংকল্পে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে এবং বিচারিক কার্যক্রম ইতোমধ্যেই কার্যকারিতা পেয়েছে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য সাফল্যের মধ্যে রয়েছে, উন্নত-অনুন্নত বিশ্বের প্রায় সব দেশের সমর্থন ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পাওয়া। রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের উৎসাহে দেশে টাকা পাঠানোর গতি বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের স্থবিরতা কেটে গেছে। গত ১২ ডিসেম্বর গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্রস রিজার্ভ ২ হাজার ৪৭৫ কোটি মার্কিন ডলার বা ২৪ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুসারে রিজার্ভের পরিমাণ ১ হাজার ৯২০ কোটি ডলার বা ১৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। চলতি মাসের শুরুর দিকে ৪ ডিসেম্বর গ্রস রিজার্ভ এবং বিপিএম-৬ ছিল যথাক্রমে ২৪ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন এবং ১৮ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার।

সম্প্রতি বিখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী দি ইকোনমিস্টের বিচারে ২০২৪ সালের সেরা দেশের তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। সংবাদমাধ্যমটির প্রকাশিত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, সবচেয়ে ধনী-সুখী বা নৈতিকভাবে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য নয়, বরং ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে দেড় দশকের স্বৈরাচারের পতন এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন যাত্রার সূচনার কারণে তাদের এ মূল্যায়ন। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আমাদের এবারের বিজয়ী বাংলাদেশ, যারা এক স্বৈরশাসককে উৎখাত করেছে। আগস্টে ছাত্রদের নেতৃত্বে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, যিনি সাড়ে ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশটি ১৫ বছর ধরে শাসন করেছিলেন। দেশের স্বাধীনতার হিরোর এক কন্যা হিসাবে তিনি এক সময় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি দমন শুরু করেন, নির্বাচনে কারচুপি করেন, বিরোধীদের কারাগারে পাঠান এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। তার শাসনামলে বিশাল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।’ উল্লেখ্য, এবারের সেরা দেশ বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত তালিকায় ছিল বাংলাদেশ, সিরিয়া, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও পোল্যান্ড। তালিকায় রানার আপ হয় সিরিয়া।

আইএমএফসহ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা নাজুক বলা হলেও মাননীয় অর্থ উপদেষ্টা চলমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতি প্রায় স্বাভাবিক মনে করছেন। প্রসঙ্গত, গত ১৯ ডিসেম্বর গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে আইএমএফ যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, তা একেবারে অমূলক নয়। তবে বাস্তব চিত্র এতটা নৈরাশ্যজনকও নয়, যতটা আশঙ্কা করা হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতি গ্লোমি নয়, বরং চ্যালেঞ্জিং। আমি মনে করি, সঠিক নীতি ও পদক্ষেপের মাধ্যমে সংকট সামাল দেওয়া সম্ভব। বিশেষত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে অগ্রগতি জরুরি। অর্থনীতি দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো থাকায় দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক ফল আশা করা যায়।’ আইএমএফের ১১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি এবং ৩ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস প্রসঙ্গে তিনি আরও জানান, ‘প্রবৃদ্ধি কমার বিষয়ে আমি আইএমএফের সঙ্গে একমত। তবে আমি আশাবাদী, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। ইয়ার অন ইয়ার ভিত্তিতে ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে।’ তিনি আশা প্রকাশ করেন, আগামী বছরের জুনের মধ্যে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশ এবং গড় মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের মধ্যে থাকবে।

উগ্রবাদী চরিত্রের কিছু বিষয় ছাড়া সার্বিক দিক থেকে দেশ অনেকটা স্থিতিশীল। সংখ্যালঘুদের নির্যাতন-নিপীড়ন ও তাবলিগ জামাতের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ কিছুটা হলেও জনমনে নিরাপত্তার আশঙ্কা তৈরি করেছে। ১৮ ডিসেম্বর রাজধানীর টঙ্গীতে তুরাগ তীরের বিশ্ব ইজতেমা মাঠের দখল নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষে চারজন নিহত ও শতাধিক আহত হন। চলতি মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া তিন শিক্ষার্থী গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। এছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে দুই পক্ষের পালটাপালটি হামলায় স্কুলছাত্রসহ দুজন ছুরিকাঘাতে খুন হয়েছে। ২০ ডিসেম্বর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত পুলিশ বিভাগের তথ্যমতে, গত দুই মাসে দেশে অন্তত ৩৩টি খুনের ঘটনা ঘটেছে এবং খুনের পর লাশগুলো ফেলে দেওয়া হয়েছে ঝোপঝাড়ে। বস্তুত একের পর এক খুন, ছিনতাই, ডাকাতি ও চুরির ঘটনা জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় অস্ত্রধারীদের হামলা কিংবা অস্ত্র হাতে দৌড়াদৌড়ির বেশকিছু ভিডিও ফুটেজ দেখা যায়। বস্তুত দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে মানুষের ভয়-আতঙ্ক কাটছে না।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে সুযোগ সন্ধানীরা বিগত সরকার আমলের মতোই দখল, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, অবৈধ বাণিজ্য এবং ক্ষমতার বলয় বিস্তারে কিশোর গ্যাংদের ব্যবহার করছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তাছাড়া বিদেশি কিছু গণমাধ্যম কথিত ইস্যুগুলোকে অতিরঞ্জিত করে গুজব-সন্ত্রাসে মেতে উঠেছে। দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পে অস্থিরতা বিরাজ করছে। সংবাদমাধ্যমের সূত্রমতে, গত সেপ্টেম্বর থেকে আশুলিয়া, গাজীপুর ও টঙ্গী এলাকায় রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানায় শ্রমিকদের হাজিরা বোনাস বৃদ্ধি, টিফিন বিল বৃদ্ধি, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধসহ নানা দাবিতে বিক্ষোভ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষও হয়েছে। শ্রমিক বিক্ষোভের ফলে উল্লেখিত এলাকার পোশাকশিল্প ছিল কার্যত অচল। খাতসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর শিল্পাঞ্চলগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বের শিকার হচ্ছে পোশাক খাত। আইনশৃঙ্খলার সমন্বয়েও ঘাটতি আছে। তাছাড়া শ্রমিক নেতা, রাজনৈতিক দল, বাইরের ইন্ধনসহ বিভিন্ন বিষয় এর সঙ্গে জড়িত।

অস্থিরতা সৃষ্টিকারী বিভিন্ন ঘটনার তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে যথেষ্ট সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ পুঞ্জীভূত হয়েছে। এর পেছনে সরকারের সংস্কার উদ্যোগগুলোকে ব্যাহত করে দেশকে নির্বাচনমুখী করার প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করার হীন চক্রান্ত রয়েছে কি না, তা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্নের উদ্রেক হচ্ছে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি তথা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে আসছে সরকার। আমদানিনির্ভর পণ্যগুলোর জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে সরবরাহের ক্ষেত্র অনুসন্ধানের বিষয়টি ইতিবাচক। এতৎসত্ত্বেও দেশকে অস্থিতিশীল করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার অপচেষ্টা চলতে পারে। চারদিকে গুজব-গুঞ্জনের ডালপালা এত বেশি বিস্তৃত হচ্ছে, যা দেখে মনে হয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতা নিয়ে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। দেশের অগ্রযাত্রার গতি রোধ করার উদ্দেশ্যে এসব মিথ্যাচার দেশি-বিদেশি চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের অংশ ছাড়া আর কিছু নয়।

সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে এটি ধারণা করা যায় যে, অতীতের মতো বাংলাদেশকে নিয়ে কতিপয় অশুভ শক্তির অনাকাঙ্ক্ষিত তৎপরতা তাদের কর্তৃত্ববাদী চরিত্রই শুধু উন্মোচন করেছে। বিভিন্ন চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে দেশকে অস্থিতিশীল করার সব চেষ্টা ব্যর্থ হবেই। বিশ্বপরিমণ্ডলে বাংলাদেশ যথার্থই প্রমাণ করেছে, এদেশ সব অন্ধকারের শক্তিকে পরাভূত করে নিজেই অনবদ্য দৃষ্টান্তরূপে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পেরেছে। আমাদের প্রত্যাশা, সব ধরনের অপতৎপরতাকে সংহার করে অন্তর্বর্তী সরকার সামনে এগিয়ে যাবে।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম