Logo
Logo
×

বাতায়ন

প্রতিবেশীর এ কেমন আচরণ!

Icon

ড. মনজুর আলম

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রতিবেশীর এ কেমন আচরণ!

আমাদের এক বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের তথ্যসন্ত্রাস এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সে দেশের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা, তদুপরি সে দেশ থেকে যখন খাদ্যপণ্য সরবরাহ বন্ধের মাধ্যমে এ দেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষকে ক্ষুধার্থ ও না খাইয়ে মারার হুমকি দেওয়া হয়- তাকে খাটো করে দেখলে চলবে কি?

সে দেশের সরকার যাই বলুক না কেন, এর কোনো শক্ত প্রতিবাদ বা প্রতিকার না করাটাই অনেকের জন্য ভয়ের কারণ। সে ভয় আরও বাড়িয়ে দেয়, যখন দেখি, বেশ কদিন সীমান্তে খাদ্যদ্রব্য পরিবহণ আটক করে রাখা হয়। হাসপাতালগুলোয় রোগীদের চিকিৎসা না দেওয়ার ডঙ্কা বাজানো হয় কিংবা হোটেল থেকে বাংলাদেশিদের বের করে দেওয়া হয়।

অবস্থা দেখে মনে হবে, বাংলাদেশিরা বিনামূল্যে সেখানে চিকিৎসা সুবিধা পান। হোটেলগুলো বিনামূল্যে বাংলাদেশিদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। বাংলাদেশিরা টাকাপয়সা ছাড়াই স্যুটকেসভর্তি করে ওখান থেকে জিনিস নিয়ে আসেন! বিষয়টি হাস্যকর হলেও বিশ্ব রাজনীতিতে আজ যেটি হুমকি, কাল সেটি যে বাস্তবে হবে না, তার কোনো গ্যারান্টি কেউ কি দিতে পারবেন? এ গ্যারান্টি কেউই দিতে পারবে না, যদিও আমাদের প্রত্যাশা-বৃহৎ প্রতিবেশী দেশটি সত্যি সত্যি খাদ্যপণ্য সরবরাহ বন্ধ করে আমাদের দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি করবে না। কিন্তু প্রস্তুতি তো থাকতে হবে, যদি হয়! তাই তথ্যসন্ত্রাস রোধে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ কর্মকাঠামো ও কর্মচারী বিন্যাস ঢেলে সাজানো সময়ের দাবি। নিয়োগ ব্যবস্থাপনা থেকে পদায়ন অবধি যোগ্য পদে সঠিক ব্যক্তি পদায়ন বিশেষ জরুরি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে সব দূতাবাসপ্রধান, সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের (বিগত সরকারের সময় নিয়োগকৃত) পূর্ণ পর্যালোচনাসাপেক্ষে (বিশেষ করে অনেকে যখন তাদের অতীত রং বদলাতে ব্যস্ত) যারা স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা, সাম্য, মানবিক এবং দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠনে বিশ্বাস করেন, তাদের নিয়োগ দিয়ে এক নতুন কর্মোদ্দীপনা সৃষ্টি অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশ যে নতুন প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে এক আত্মবিশ্বাসী, গণতান্ত্রিক ও জনহিতকর উন্নত বাংলাদেশ গড়ার কাজে ধাবমান-সেটা নিজে বুঝে, বিশ্বের সবাইকে বোঝানোর গুরুদায়িত্ব সবার কাঁধে। পাশাপাশি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ করে বিভিন্ন কৃষিপণ্য আমদানি বিষয়ে দেশীয় উৎপাদন, বৈশ্বিক উৎপাদন এবং চাহিদা পূর্বাভাস বিশ্লেষণে সক্ষম এক চৌকশ শাখা গঠন করে আমদানিকারকদের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ জরুরি, যাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং আমদানিকারকরা বিবিধ উৎপাদনকারী দেশের সঙ্গে অগ্রিম চুক্তি করতে পারে। এতে করে একদেশ নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করে একটি বিষয়ে পরিষ্কার হওয়া জরুরি-বাংলাদেশ কি শুধু সে দেশের ওপর পণ্য আমদানি, শিক্ষা, চিকিৎসা ও ভ্রমণ ইত্যাদি খাতে নির্ভরশীল থাকবে? বর্তমান সংকট নিরসন হলেও ভবিষ্যতে এ সংকট যে আরও ঘনীভূত হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা আছে কি? তাই দুদেশের সংকট নিরসনের আন্তরিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত থাকাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

ভারতের সঙ্গে সংকটকালে দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার পঙ্গুত্ব, অব্যবস্থাপনা ও নির্ভরশীলতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার দুরবস্থা। যদিও আমাদের দেশে অনেক যোগ্য ডাক্তার রয়েছেন। বাংলাদেশের অনেক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বিদেশে কর্মরত, যারা সুযোগ পেলে দেশে চিকিৎসা সেবা দিতে প্রস্তুত। দেশে ২০ বছর আগেও উন্নত চিকিৎসা সরঞ্জামাদির যে সংকট ছিল, এখন তা আর নেই। উন্নত চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সহজেই দেশে আনা সম্ভব। তারপরও কিছু সমস্যা রয়েছে; যেমন: ক. ভালো চিকিৎসা কেন্দ্র/হাসপাতালের অভাব; খ. চিকিৎসা কেন্দ্রে কর্মরত ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য কর্মরত ব্যক্তিদের সংবেদনশীল ও ব্যবহারজনিত প্রশিক্ষণ কিংবা প্রয়োগের অভাব, যা রোগীবান্ধব চিকিৎসা কেন্দ্র/হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত (এর ওপরই একটা হাসপাতাল বা চিকিৎসা কেন্দ্রের সুনাম অনেকাংশে নির্ভরশীল); গ. প্রতিযোগিতামূলক/তুলনামূলক চিকিৎসা খরচ এবং চিকিৎসাসংক্রান্ত সব খরচের স্বচ্ছ হিসাব ব্যবস্থার অনুপস্থিতি। সর্বোপরি পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থার অভাব। এ ক্ষেত্রে তিনটি প্রস্তাবনা ভেবে দেখা যেতে পারে-

১. প্রফেসর ড. ইউনূস, যিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষাজীবনের সরাসরি শিক্ষকও (সাবসিডিয়ারি অর্থনীতি বিষয়ে) বটে, সশ্রদ্ধ ও সম্মানের সঙ্গে তার কাছে অনুরোধ-তিনি যেন তার বৈশ্বিক পরিচিতি ও সুনামের সুবাদে নিকট প্রতিবেশী দেশ, যেমন: সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, এমনকি জাপানে অবস্থিত প্রখ্যাত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের শাখা হাসপাতাল বাংলাদেশে স্থাপন করার জন্য সেসব দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করেন। হাসপাতাল সম্পর্কিত চুক্তি সরকারের সঙ্গে সরকার, সরকারের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চুক্তির মাধ্যমে হতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর চিকিৎসাজনিত কারণে কী পরিমাণ রোগী বিদেশে যাচ্ছে, তার সব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং এ খাতে বিনিয়োগ যে লাভজনক, তার বিশ্লেষণাত্মক সচিত্র প্রতিবেদন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জরুরি ভিত্তিতে প্রস্তুত করার নির্দেশ দিতে পারেন। আমার বিশ্বাস, প্রথম দু-তিনটি চুক্তি হলেই অন্যরাও লাভজনক বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন। এতে করে বাংলাদেশের রোগীরা পর-মুখাপেক্ষিতা থেকে রক্ষা পাবে। দেশেই উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং অনেক দক্ষ ও অর্ধদক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। বাংলাদেশও চিকিৎসা খাতে শুধু একদেশ নির্ভরশীলতা থেকে মুক্তি পাবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রদানের অন্যতম কেন্দ্র হিসাবে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

২. দেশের বিভিন্ন শহরে অবস্থিত বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ক্লিনিক বা হাসপাতাল মালিকরা একত্রিত হয়ে এক সমন্বিত আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল নির্মাণ করতে পারেন। এতে তাদের লাভের সম্ভাবনা যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনই দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে সুদূরপ্রসারী লাভজনক পদক্ষেপ হিসাবে এটি বিবেচিত হবে।

৩. বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এ লাভজনক খাতে বিনিয়োগে নিজে উৎসাহী এবং অন্যদেরও উৎসাহিত করে আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণে এগিয়ে আসতে পারেন।

পাশাপাশি বিভিন্ন সেবাদানমূলক প্রতিষ্ঠানও বহুমাত্রিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে। হাসপাতাল উদ্যোগকে লাভজনক ব্যবসা হিসাবে গণ্য করে বিভিন্ন ব্যাংক সরাসরি বিনিয়োগ করতে পারে। বিদেশের উৎসাহী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।

পরিশেষে, এ সংকট একদিকে যেমন দেশকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে, অপরদিকে অনেক সম্ভাবনার দরজাও উন্মোচিত হয়েছে। একদিকে সরকারকে দেশের সব নাগরিকের ধর্ম, কর্ম ও ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি অধিকতর যত্নবান হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, ঠিক তেমনই মিথ্যা অপবাদ থেকে নিজেকে রক্ষা করার, প্রতিবাদ করার, সত্য প্রতিষ্ঠিত করার যুগোপযোগী তথ্য মাধ্যম, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শক্ত কাঠামো তৈরির প্রয়োজনীয়তাও বুঝিয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা, উন্নততর সেবা প্রদান, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে উৎকর্ষ অর্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে জানান দিয়েছে। পৃথিবীর সব প্রান্তে বন্ধুদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বিকাশের গুরুত্ব যেমন মনে করিয়ে দিয়েছে, তেমনই বন্ধু হলেও একদেশনির্ভরতা কতটা ঝুঁকির, সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছে-নির্ভরতা তা সে হোক বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভ্রমণ, এমনকি ডাল-চাল, চিনি, পেঁয়াজ-আলু অবধি।

এ সংকট শিক্ষা দিয়েছে পারস্পরিক সম্পর্ক বিকাশ যেমন অপরিহার্য, তেমনই সম্পর্কের ক্ষেত্রেও অতিনির্ভরতা বিপজ্জনক। স্বনির্ভরতা সর্বোত্তম; কিন্তু নির্ভরতা যেন হয়ে না যায় রাজনৈতিক দুর্বলতার কারণ। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ধরে রাখার স্বার্থেই পরনির্ভরতা পরিহার আবশ্যকীয়। এতেই দেশের মঙ্গল।

ড. মনজুর আলম : সহযোগী অধ্যাপক, হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয়, ফিনল্যান্ড; শাসনতান্ত্রিক সংস্কার বিশেষজ্ঞ, ইইউ উন্নয়ন প্রকল্প

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম