স্বপ্ন, সম্ভাবনা ও বাস্তবতা

মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ স্বপ্ন ও সম্ভাবনার একটি দেশ। তবে স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে নিতে হবে বাস্তবধর্মী উদ্যোগ। পরিবর্তন আনতে হবে মনমানসিকতা ও আচার-আচরণে, বিশেষ করে রাজনৈতিক বিভাজন থেকে আসতে হবে বেরিয়ে। পরমতসহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধাবোধ ও ঐক্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। কারণ মাথা যেমন সব শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে একটি দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে। রাজনীতিতে সংকট জিইয়ে রেখে কোনো স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সুদূরপরাহত।
দেশের সামনে যেমন সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনই রয়েছে চ্যালেঞ্জও। আগামী দিনগুলোয় চীন, ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ইত্যাদি দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে তুমুল প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে। বিশেষ করে চীন ও ভারতের দিকে বাংলাদেশকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কেননা এ দুটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। দেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে প্রধানত এ দুটি দেশ থেকে পণ্য আমদানি করে। তারা বাংলাদেশের বাজার ধরতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে। বাংলাদেশকেও চেষ্টা করতে হবে কীভাবে এ দুটি দেশে পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করা যায়। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় বাংলাদেশি বিভিন্ন পণ্যের ব্যাপক চাহিদা ও জনপ্রিয়তা রয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় বাংলাদেশকে ব্যবসা করার সুযোগ তৈরি করতে হবে। নজর দিতে হবে চীনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণেও। বাংলাদেশকে চীনের বাজারে প্রবেশ করতে হলে ভারত, ভুটান ও নেপালের সহযোগিতার প্রয়োজন। তাছাড়া মিয়ানমার দিয়েও বাংলাদেশ চীনে প্রবেশ করতে পারে।
দেশের ‘স্ট্যাট্রেজিক’ সুবিধাগুলো এ অঞ্চলের অর্থনীতির গতি পরিবর্তনের নিয়ামক। রাজনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। উপমহাদেশ এবং এ অঞ্চলের মানচিত্রের দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট বোঝা যায় যে সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে পশ্চিম এশিয়ার যোগসূত্র স্থাপন করে রেখেছে বাংলাদেশ তার আপন ভূখণ্ডের বৈচিত্র্য দিয়ে। বাংলাদেশের তিন দিক জুড়ে রয়েছে ভারত। এরপর দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে মিয়ানমার। এর পাশে রয়েছে চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়া। তাছাড়া রয়েছে ভুটান, নেপাল ও ভারত। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে প্রতিটি দেশ খুবই সন্নিকটবর্তী। বাংলাদেশ থেকে নেপালের দূরত্ব মাত্র ১৮ মাইল, ভুটানের ৪৫ মাইল এবং চীনের সীমান্ত ৪০ মাইল। তাছাড়া বাংলাদেশ সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশ, এদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানা শুরু সমুদ্রের জলরাশি দিয়ে। আর এ মহাসমুদ্রই বাড়িয়েছে বাংলাদেশের গুরুত্ব। তাই বাংলাদেশকে বলা হয় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগস্থল। এ জন্যই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এক বিরাট অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা রয়েছে। তাছাড়া চীন ও ভারতের অর্থনৈতিক উত্থান বাংলাদেশের এ ভূমিকাকে আরও জোরালো ও শক্তিশালী করেছে। এসব চিন্তা মাথায় নিয়েই নীতিনির্ধারকদের পথ চলতে হবে এবং তৈরি করতে হবে কর্মকৌশল।
আগামী দিনগুলোয় যে কয়েকটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে উপরের তালিকায় উঠে আসবে, সেগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত। স্ট্র্যাটেজিক দিক থেকে চীন ও ভারতের মধ্যস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি চমৎকার রাজনৈতিক সুযোগ। এজন্য বাংলাদেশকে দেখতে হবে ভিন্ন আঙ্গিক ও ভিন্ন দৃষ্টিতে। চীন, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি দেশসহ দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করার প্রবেশদ্বার বাংলাদেশের মধ্য ও পূর্বাঞ্চল। তাছাড়া ‘সেভেন সিস্টার’ বলে খ্যাত ভারতের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের প্রবেশদ্বারও বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চল। ফলে প্রায় শতকোটি মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রিত হবে বাংলাদেশের মধ্য ও পূর্বাঞ্চলকে কেন্দ্র করে।
বাংলাদেশ ছোট কোনো জনপথ নয়; জনসংখ্যার নিরিখে বিশ্বের অষ্টম রাষ্ট্র। বিশ্বের প্রতি ৫০ জনের মধ্যে একজন বাংলাদেশি। পরিবর্তিত বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান আরও সুসংহত হয়েছে। চীন, ভারত ও পাকিস্তানসহ আরও বড় বড় দেশ বাংলাদেশের ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষ। তৈরি পোশাকশিল্পে বিশ্বে চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। জনশক্তি রপ্তানি ও ওষুধশিল্পে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। কাজেই বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ এখন চতুর্মুখী। উপরে উঠতে হলে বাংলাদেশকে এসব চিন্তা মাথায় রাখতে হবে। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বন্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। সুনিশ্চিত করতে হতে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন এবং গণমাধ্যমরে স্বাধীনতা। তাহলেই কেবল একটি দেশের অর্থনীতির আকার বড় হতে পারে; দেশটি হতে পারে উন্নত, আধুনিক একটি দেশ।
দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার যথেষ্ট যুক্তি ও কারণ আছে। এদেশের অধিকাংশ মানুষ কর্মক্ষম ও গত ২০ বছরে প্রায় ৫ কোটি উদ্যমী, তরুণ ও যুবক যোগ হয়েছে বাংলাদেশের জনশক্তিতে। দেশের কৃষি, শিল্প, জনশক্তি ও বেসকারি খাত একযোগে এগিয়ে যাচ্ছে, যা একটা রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত। দেশের তৈরি পোশাক বিশ্বে একটি সুপরিচিত ব্র্যান্ডের খ্যাতি অর্জন করেছে। পাশাপাশি এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্পের গৌরবের অধিকারী। তাছাড়া চা, চামড়া, ওষুধ ও হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিতেও বাংলাদেশের একটা উল্লেখযোগ্য অবস্থান রয়েছে। এসব কোনো কল্পকাহিনি নয়, বাস্তব সত্য। তাহলে এদেশের উন্নয়নকে আটকে রাখার সাধ্য কার? আমাদের শুধু বাস্তববাদী হতে হবে। দূরের জিনিস দেখতে হবে। জনশক্তিকে পরিকল্পিতভাবে জনসম্পদে পরিণত করতে হবে। নদীগুলোকে খনন করে মাছ চাষ ও সম্পদের উৎসে পরিণত করতে হবে। কৃষকদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। কারিগরি শিক্ষার ওপর অধিক জোর দিতে হবে। গড়ে তুলতে হবে দীর্ঘস্থায়ী ও শক্তিশালী গণপরিবহণব্যবস্থা। রেলকে করতে হবে যুগোপযোগী ও আধুনিক। রাজধানী ঢাকাকে গড়ে তুলতে হবে পরিকল্পিত শহর হিসাবে। সর্বোপরি সংঘাতপূর্ণ, অশান্ত ও হানাহানির রাজনীতি থেকে আসতে হবে বেরিয়ে। রাজনীতিকদের মন বড় করতে হবে এবং দৃষ্টি করতে হবে প্রসারিত। অনৈক্য ও বিভেদ-বিভাজনের রাজনীতি পরিহার করে জাতীয় স্বার্থে এক প্লাটফর্মে থেকে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে এক সুরে কথা বলতে হবে। অহমিকা ত্যাগ করে পরমতসহিষ্ণুতা ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সব সংকটের সমাধান করতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশের সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাবে, স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
belayethossen1@gmail.com