রোডম্যাপ সুস্পষ্ট হওয়াটাই এখন বাকি

হাসান মামুন
প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
-6761ef5a9d32b.jpg)
ছবি: সংগৃহীত
প্রধান উপদেষ্টা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে নির্বাচনের সময়সীমা সম্পর্কে ধারণা দিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন, এটা বলা যাবে না। ইইউ কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি কিন্তু ইঙ্গিত দিয়েছিলেন চলতি মাসের শেষদিকে এ বিষয়ে ধারণা দেওয়ার। সেটা মাসের মধ্যভাগেই দেওয়া হয়ে গেল আর কী! সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে পালিত বিজয় দিবসটাও তিনি অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ করে তুললেন কিছুটা আকস্মিকভাবে জাতির সামনে হাজির হয়ে।
যুগান্তরে প্রকাশিত এর আগের নিবন্ধে নির্বাচনের সময়সীমা তথা সরকারের মেয়াদ বিষয়ে ‘মোটামুটি একটা ধারণা’ দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছিলাম। আরও অনেকেই লিখে ও বলে এর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন নিশ্চয়ই। চায়ের দোকানেও এ বিষয়ে বক্তব্য রাখছে মানুষ। দেশ প্রত্যাশা অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে দেখলে তারা অবশ্য ভিন্ন কথাই বেশি বলতেন। এ মত তখন জনপ্রিয় হতো যে, ইউনূস সরকারই ‘যতদিন ইচ্ছা’ দেশ চালাক! এর আগে একাধিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমরা জনতার এমন সরল মানসিক অবস্থান দেখতে পেয়েছি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার থাকা প্রয়োজন। সেটি আবার আসতে হবে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে। আর নির্বাচন যত ‘অংশগ্রহণমূলক’ হয়, ততই মঙ্গল। সত্যি বলতে, হাসিনা সরকার এ প্রক্রিয়াটাই ধ্বংস করে দিয়েছিল বলে আজ এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে দেশ।
উল্লেখ করা যেতে পারে, ড. ইউনূস ভাষণটি দেওয়ার ঠিক আগের দিন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের এক আলোচনাসভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বলেছিলেন, রাষ্ট্র সংস্কারে কত মাস প্রয়োজন, সেটা জানার অধিকার আছে জনগণের। তিনি সংস্কার ও নির্বাচনের ‘রোডম্যাপ’ দাবি করেই কথাটা বলেছিলেন। তার পরদিনই প্রধান উপদেষ্টা এ সম্পর্কে ধারণা দিয়ে বক্তৃতা করায় অনেকে হয়তো ভাববেন, তারেক রহমানের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি সেটা করেছেন। সেটি ঘটে থাকলেও দোষের কিছু নেই। বিএনপি এ মুহূর্তে মাঠে থাকা সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। তাদের কথায় গুরুত্ব দিয়ে মাঝে ইউনূস সাহেব এক সাক্ষাৎকারে এমনটাও বলেছিলেন যে, দেশের একটি বড় দল বিএনপি কোনো দলকে নিষিদ্ধ দেখতে না চাইলে আমরা তার বিরুদ্ধে যাব না। গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী সরকার হিসাবে তাদের ‘ফেসিলিটেট’ করা অর্থাৎ সহায়তা জোগানোর ভূমিকাটাই তিনি তুলে ধরেছিলেন। এতে অবশ্য কেউ কেউ আপত্তি করেন। তাদের দাবি, অন্তর্বর্তী সরকারও একটা ‘রাজনৈতিক সত্তা’; তাদের আলাদা অবস্থান থাকতে পারে। ড. ইউনূস ও তার সহকর্মীরা অবশ্য শুরু থেকেই বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা থেকে আসা ঐকমত্য ধরেই তারা এগোবেন। সর্বশেষ ভাষণে নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণের প্রক্রিয়া জানাতে গিয়েও এ বিষয়েই জোর দিলেন তিনি।
অচিরেই তার নেতৃত্বে একটি ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ গঠিত হবে, যার কাজ হবে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনের রোডম্যাপ সুস্পষ্ট করা। নির্বাচনি তফশিল নিশ্চয়ই ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন, যেটা এরই মধ্যে গঠিত হয়েছে। এ পদক্ষেপের কথাও প্রধান উপদেষ্টা স্বভাবতই উল্লেখ করেছেন। ত্রুটিমুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়ন, হাসিনা রেজিমে ভোট দিতে না পারা তরুণদের প্রায় শতভাগ ভোটাধিকার প্রয়োগ এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি। এসব বিষয়ে কেউ দ্বিমত করবেন না। বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি রয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। রেমিট্যান্স পাঠানোসহ বিভিন্নভাবে তারা ভূমিকা রাখছেন দেশের অগ্রগতিতে। দেশের ভালো-মন্দে তাদেরও যায় আসে। সুতরাং তাদের ভোটাধিকারের দীর্ঘ অনিষ্পন্ন দাবির নিষ্পত্তি করতে হবে এবার। এর পাশাপাশি সংস্কারের যেসব ক্ষেত্র চিহ্নিত হয়েছে, সেগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে ড. ইউনূস আবারও জানালেন, আর কোনো সংস্কারের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো একমত না হলে তারা কেবল ভোটার তালিকা হালনাগাদ এবং নির্বাচন সংক্রান্ত সংস্কার সেরে নির্বাচনের দিকে চলে যাবেন। সেক্ষেত্রেও ব্যাপারটা আগামী বছরের শেষদিক পর্যন্ত গড়াতে পারে বলে তার ধারণা। আর ‘জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার’ যুক্ত হলে আরও অন্তত ছয় মাস লাগতে পারে বলে তিনি জানিয়েছেন। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, নির্বাচন হতে পারে ২০২৫ সালের শেষদিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে।
ভাষণে একাধিকবার তিনি বলেছেন ‘হতে পারে’, ‘লাগতে পারে’। এ পর্যায়ে সেটা স্বাভাবিক বৈকি। শেষতক কোন কোন ক্ষেত্রে কতখানি সংস্কারে সরকার হাত দেবে, সেটা তো এখনো স্থির হয়নি। শুধু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করে বিদায় নিতে সরকারটি এলে সংস্কারের প্রশ্ন অবশ্য উঠত না। শুধু একটি নির্বাচন আয়োজনের কথা কোনো রাজনৈতিক দল বলছেও না। কোনো কোনো দল ‘অত্যাবশ্যকীয় সংস্কারের’ জন্য সরকারকে এখনো বেশি সময় দিতে রাজি। প্রধান উপদেষ্টার অতিসাম্প্রতিক ভাষণের প্রতিক্রিয়ায়ও এমন অভিমত পাওয়া গেল। সরকারকে সংস্কারের জন্য অধিক সময় দিয়ে তারা দল গোছাতে চান বলে আবার অনেকে মনে করেন। আর যারা শুধু নির্বাচনসংক্রান্ত সংস্কার সেরেই নির্বাচন চাইছেন, তারা গোছানো সংগঠন নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার আশায় আছেন বলে মনে করা হচ্ছে। এখানে আরেকটি পক্ষ আছে। তারা হলো জনগণ। নির্বাচনের প্রধান ‘স্টেকহোল্ডার’ তারা। তারাই তো দেশটির মালিক। নির্বাচন বিষয়ে তাদের সিংহভাগের মনোভাব কী, সেটা অবশ্য নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কিছু জরিপ হলেও তাতে সত্যিকারের মনোভাব কতটা উঠে আসছে, সেটাই বা কে জানে! কেউ কেউ এ বিষয়ে গণভোট অনুষ্ঠানেরও দাবি জানান।
এদেশের মানুষ বরাবরই নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনে বিশ্বাসী। নির্বাচিত সরকার সুশাসনে ব্যর্থ হলেও তারা সবসময় চেয়েছে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার বদলাতে। কোনো সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারকে পুনরায় ক্ষমতায় আসতে এদেশে দেখা যায়নি, এটাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। নির্বাচনের মাধ্যমে ‘সরকারের ধারাবাহিকতা’ বজায় থাকলেও কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু নির্বাচন তো সুষ্ঠু হতে হবে। ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার চেষ্টায় দেশের কী সর্বনাশ হয়েছে, সেটা আমাদের কাউকেই বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। যারা এমন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, ছাত্র-জনতা অকাতরে রক্ত দিয়ে তাদের ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য করেছে। দেশে এখন তারা অনুপস্থিত বলা যায়। এদের সমর্থকগোষ্ঠী অবশ্য রয়েছে। নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণও নিশ্চিত করতে হবে, কেননা তারাও এদেশের নাগরিক। পছন্দমতো কোনো দলকে সমর্থন করাটা তো দোষের নয়। বংশানুক্রমেও লোকে বিশেষ দলকে সমর্থন করে যায়। এ অবস্থায় স্থির করতে হবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কিনা। পারলে কীভাবে। বিভিন্ন গুরুতর অভিযোগে মামলা চলার পাশাপাশি এ বিষয়ের নিষ্পত্তিতেও রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য অনুযায়ী সরকার সিদ্ধান্ত নেবে বলে মনে হচ্ছে। আগামী নির্বাচন যেন কোনোভাবে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি বৈকি। গণতান্ত্রিক বিশ্ব পরিসরেও এটি আদর্শ নির্বাচন বলে বিবেচিত হলে এর মধ্য দিয়ে আসা সরকার পরিপূর্ণ আস্থা নিয়ে দেশ চালাতে পারবে।
গণ-অভ্যুত্থানে সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতারা ব্যাপক ও গভীর সংস্কার চাইছেন, এটাও সবার জানা। ‘অল্পকিছু’ সংস্কার করে নির্বাচনের দিকে যাওয়ার বিকল্পটি তাদের পছন্দ হচ্ছে না। তবে বিএনপিসহ সিংহভাগ দল মনে করছে, প্রয়োজনীয় সব সংস্কারের জন্য দীর্ঘদিন একটি অন্তর্বর্তী সরকার থেকে যাওয়া ঠিক নয়। এমনিতেই দেশে কমপক্ষে এক দশক চেপে বসেছিল ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার। সেটা ছিল আবার চরম স্বেচ্ছাচারী। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও দুর্নীতির সব রেকর্ড তারা ভেঙে দিয়েছিল। এ অবস্থা থেকে দেশকে উত্তরণের দিকে নিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার অবশ্যই প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে তছনছ করাতেও এটা জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু এসবের সংস্কারে তো লাগবে দীর্ঘ সময়। নির্বাচিত সরকারের পুরো একটি মেয়াদও হয়তো এজন্য যথেষ্ট নয়। তাছাড়া সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। জনগণের ইচ্ছায় এটা চালিয়ে যেতে হবে সরকারকে। আর সে সরকার ‘জনপ্রতিনিধিত্বশীল’ হওয়া জরুরি। ইউনূস সরকার গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে এলেও নিজেকে জনপ্রতিনিধিত্বশীল বলে দাবি করতে পারবে না। সেজন্যই প্রধান উপদেষ্টা বারবার বলছেন ‘রাজনৈতিক ঐকমত্যের’ কথা। এর মধ্যে দল গঠনে সক্ষম হলে ছাত্র সমন্বয়করাও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতোই আলোচ্য বিষয়ে মত দিতে পারবেন। আর সরকারকে অনুসরণ করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোর অভিন্ন অবস্থান। এটা সংস্কার ও নির্বাচন উভয় ক্ষেত্রেই। এ দুটিকে পরস্পরের মুখোমুখি করে রাখাও ঠিক হবে না।
প্রধান উপদেষ্টার সর্বশেষ ভাষণে নির্বাচনের সময়সীমার বিষয়ে আসা বক্তব্যে সাধারণভাবে সব রাজনৈতিক দলই কমবেশি আশ্বস্ত বলে মনে হচ্ছে। আওয়ামী লীগ বাদে আর সব প্রধান দলই ইউনূস সরকারকে সমর্থন করে যাচ্ছে, এটাও লক্ষণীয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে মতপার্থক্য দেখা দিলেও সরকারের জন্য বিশেষ অসুবিধাজনক কাজকর্ম কোনো দল করছে বলে মনে হয় না। আর মতপার্থক্য তো থাকবেই। সবাই সব বিষয়ে একমত হয়ে যাওয়াটা বরং অস্বাভাবিক। মতপার্থক্য সুন্দরও বটে। তাতে বরং সম্ভাবনা থাকে ভালো কিছু পাওয়ার। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতারা যেমন বলছেন ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ গড়ে তোলার কথা। নির্বাচিত সরকারও যাতে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে না পারে, সেজন্য তারা সংবিধানের সংস্কারও চাইছেন। আবার বিএনপির মতো বড় দল বলছে, ‘সংবিধান সংস্কার করার আপনারা কে?’ তারা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করে তাকে ‘জনতার কাঠগড়ায়’ দাঁড় করানোরও পক্ষে। এ অবস্থানগুলোয় যুক্তি আছে। এটাও ইতিবাচক যে, হাসিনা রেজিম-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দিক থেকে আলোচনা হচ্ছে দেশকে নতুনভাবে গোছানোর। আর এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার অবস্থান নিয়েছে ‘জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা’র মাধ্যমে এগোনোর। সংস্কার ও নির্বাচন উভয় প্রশ্নেই তারা এর বাইরে যাবেন না।
এর মাধ্যমে উন্নয়ন সহযোগী, বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং বিশেষ করে দেশের বেসরকারি খাতও এক ধরনের নির্দেশনা পেল বলা যায়। নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ তো তাদের জানা। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ সম্পর্কেও একটা ধারণা পাওয়া গেল। বিশেষত বিদেশি ঋণ, চুক্তি ও নতুন বিনিয়োগ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজটি এতে সহজতর হবে। জনপ্রশাসনও পেল একধরনের নির্দেশনা। সর্বোপরি জনগণ আশ্বস্ত হতে পারবে প্রত্যাশিত অবস্থায় উত্তরণের ব্যাপারে।
হাসান মামুন : সাংবাদিক, কলামিস্ট