Logo
Logo
×

বাতায়ন

শিক্ষা খাতে সংস্কার শুরু করার এখনই সময়

Icon

উছমান গনি

প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষা খাতে সংস্কার শুরু করার এখনই সময়

১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান ছিল পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে একটি মোড় পরিবর্তনের ঘটনা। এ সময় সামরিক শাসক আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ আন্দোলনের মূলে ছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবি, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা, শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি এবং অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক শিক্ষা চালু করা।

১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. শামসুজ্জোহা ছাত্রদের রক্ষায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। তার আত্মত্যাগ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে উদ্দীপ্ত করে এবং আন্দোলনের গতি ত্বরান্বিত করে। তার মৃত্যুর সংবাদ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষার্থীরা আরও জোরালোভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। এটি ছাত্রদের আন্দোলনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।

এ আন্দোলনের ফলে আইয়ুব খানের পতন ঘটে। রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। তবে আন্দোলনের মূল দাবিগুলো, বিশেষ করে শিক্ষা খাতে সংস্কারের দিকটি অনেকাংশে উপেক্ষিত থেকে যায়। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু হলেও তা বাস্তবায়ন হতে লেগে যায় ২১ বছর।

২০২৪ সালের জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলন, যা ‘জুলাই বিপ্লব’ নামে পরিচিত, কোটা সংস্কার তথা কর্মসংস্থানের দাবিকে কেন্দ্র করে শুরু হয়। ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদের মৃত্যু এবং ১৮ জুলাই মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের মৃত্যু আন্দোলনকে জাতীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়। শিক্ষার্থীদের এ আত্মত্যাগ শুধু তাদের দাবি আদায়ের সংগ্রাম নয়, বরং তা একটি ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের সূচনা করে।

এ আন্দোলনে শিক্ষকরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা সরাসরি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করেন। শিক্ষকদের বক্তৃতাগুলো আন্দোলনের প্রতি জনগণের সমর্থন বাড়িয়ে তোলে এবং সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি করে। এর ফলে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসে। তবে প্রশ্ন রয়ে যায়, এ পরিবর্তন কি শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মৌলিক সংস্কার আনতে সক্ষম হবে?

১৯৬৯ ও ২০২৪-এর আন্দোলনের মধ্যে যে সাদৃশ্য লক্ষ করা যায় তা হলো-প্রথমত, উভয় আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের সমর্থন ও অংশগ্রহণ আন্দোলনকে অত্যন্ত শক্তিশালী করেছে এবং দুটি আন্দোলনই জনগণের মৌলিক অধিকার ও ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রাম।

অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নতাও রয়েছে। প্রথমত, ১৯৬৯ সালের আন্দোলন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছিল, আর ২০২৪ সালের আন্দোলন ছিল গণতন্ত্র ও কর্মসংস্থানের দাবিকেন্দ্রিক। দ্বিতীয়ত, ২০২৪ সালের আন্দোলনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা ১৯৬৯ সালে অনুপস্থিত ছিল।

১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও জুলাই বিপ্লব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের একাত্মতা শুধু সাময়িক রাজনৈতিক পরিবর্তনেই সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি সমাজের দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োজনের দিকে ইঙ্গিত দেয়। আন্দোলন দুটি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কিছু মৌলিক দুর্বলতাও প্রকাশ করেছে, যা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দক্ষ জনশক্তি হিসাবে গড়ে তুলতে বাধা সৃষ্টি করছে। এ থেকে বোঝা যায়, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের অপেক্ষায়।

দুটি আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট যে, শিক্ষা খাতে মৌলিক সংস্কার ছাড়া দক্ষ জনশক্তি তৈরি এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। আর এর জন্য যা প্রয়োজন, তা হলো-বর্তমান যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাঠক্রম হালনাগাদ করা। শুধু পরীক্ষানির্ভর শিক্ষা নয়, বরং কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকরা কেবল পাঠদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবেন না, তারা শিক্ষার্থীদের আদর্শ ও দক্ষতার মডেল হবেন। শিক্ষার সংস্কার কার্যকর করতে হলে শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। এটি তাদের পেশাগত দক্ষতা বাড়াতে এবং শিক্ষার্থীদের জন্য উন্নত শিক্ষা প্রদান করতে উৎসাহিত করবে। কম বেতন দিয়ে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়; বরং এটি শিক্ষকদের মনোযোগ ও কর্মক্ষমতা হ্রাস করতে পারে। যে কোনো শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। তাই শিক্ষকদের আর্থিক ও পেশাগত উন্নয়নকে শিক্ষা সংস্কারের প্রধান অংশ হিসাবে বিবেচনা করা উচিত।

প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের তথ্যপ্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং প্রোগ্রামিং শেখানোর সুযোগ করে দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী চিন্তা ও গবেষণার জন্য প্রণোদনা প্রদান করতে হবে। সমাজের সর্বস্তরের জন্য সমতাভিত্তিক ও অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। সব স্তরের জন্য সম্ভব না হলে অন্তত একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করতে হবে।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে, যাতে তা একটি দক্ষ ও প্রতিভাবান জনশক্তি তৈরিই শুধু নয়, একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনেও সাহায্য করে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক শিক্ষা চালুর যে দাবিটি ১৯৬৯ সালে উঠেছিল, স্বাধীনতার ৫৩ বছরে সেটুকুও পূরণ করেনি রাজনৈতিক সরকারগুলো।

জুলাই বিপ্লব আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় শিক্ষার্থীরা জাতীয় পরিবর্তনের জন্য কতটা শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। তাদের আদর্শ, আত্মত্যাগ ও দৃঢ়প্রত্যয় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারে অনুপ্রেরণা জোগায়। শিক্ষা খাতে মৌলিক সংস্কারের কার্যকর দৃষ্টান্ত স্থাপন করার এখনই সময়। একটি সুশিক্ষিত জাতি গড়তে আজকের পদক্ষেপ আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়ার ভিত্তি তৈরি করতে পারে।

উছমান গনি : অ্যাম্বাসেডর শিক্ষক

usmgoni@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম