আসাদবিহীন সিরিয়ার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল
ঘাসান ইবরাহিম
প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আজ আমরা আসাদ সরকারবিহীন এক নতুন সিরিয়ার উত্থান প্রত্যক্ষ করছি। এ ঘটনা হাফেজ আল আসাদ থেকে তার ছেলে বাশার পর্যন্ত পাঁচ দশকেরও বেশি সময়ের শাসনের অবসান ঘটানোর সাক্ষ্য বহন করছে। এটি শুধু সিরিয়ার জনগণের জন্য নয়, সমগ্র অঞ্চলের জন্যই একটি পরিবর্তনের প্রতিনিধিত্ব করে।
যে বাইরের হস্তক্ষেপের ঘটনাগুলো দীর্ঘকাল ধরে এ অঞ্চলকে সমস্যায় ফেলেছে, তা থেকে মুক্ত একটি নতুন মধ্যপ্রাচ্যের সূচনা দেখতে পাচ্ছি আমরা। গত কয়েকদিন ধরে আমরা লক্ষ্য করেছি, সিরিয়ার সরকারবিরোধী বাহিনীগুলো উত্তরে অগ্রসর হচ্ছে এবং ধ্বংস বা রক্তপাত ছাড়াই ধীরে ধীরে শহরগুলোতে প্রবেশ করছে, যা একটি নতুন পর্যায়ের রূপান্তরের ইঙ্গিত দেয়। এটি পূর্ববর্তী সরকারের কারণে সৃষ্ট সিরীয় জনগণের দুঃখ-দুর্দশার পুরোনো অভিযোগ নতুন করে উত্থাপনের বিষয় নয়, অথবা গৃহযুদ্ধকে উসকে দেওয়াও এর লক্ষ্য নয়। এই অনুভূতিটি শুধু সরকারবিরোধীরাই প্রকাশ করেনি, অনেক সাবেক কর্মকর্তাও বাশার আল আসাদের শাসনের পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন।
সিরিয়ার জনগণ, যারা ব্যাপক ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাদের আকাঙ্ক্ষাকে মূর্ত করবে এমন একটি নতুন শাসন কাঠামোতে একটি মসৃণ রূপান্তর নিশ্চিত করার বিষয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সহযোগিতা ও সমন্বয় রয়েছে। আমি সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে আশাবাদী এবং আসাদ ও তার পরিবারের পলায়নের বিষয়ে রিপোর্ট করা প্রথম ব্যক্তিদের মধ্যে থাকতে পেরে আমি গর্বিত।
সিরিয়ায় নতুন একটি পর্যায়ের শুধুই শুরু এটি। সাম্প্রতিক সামরিক ও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে আমার পর্যবেক্ষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে, জনগণের মাঝে দেশের সেবা করার সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। জনগণ এমন একটি সিরিয়া চায়, যা তার নাগরিকদের দ্বারা শাসিত হবে; এমন একটি পরিবার দ্বারা নয়, যেটি দীর্ঘদিন ধরে দেশটির ওপর তাদের নিজস্ব সংকীর্ণ স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। জনগণের লক্ষ্য হলো এমন একটি সামরিক বাহিনী গঠন করা, যা সব সিরীয় নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব করবে; বিশেষ শক্তির পেছনে না ছুটে জনগণের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করবে।
আমরা একটি ক্রান্তিকালীন পর্যায় কল্পনা করি, যেখানে থাকবে ন্যায়বিচার; হবে ধ্বংস ও প্রতিশোধ থেকে মুক্ত। এমন একটি সময়কাল, যা অতীতমুখী চিন্তার পরিবর্তে ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনার জন্য নিবেদিত। ভবিষ্যৎ আলোচনায় নতুন সরকারের কাঠামোর ওপর আলোকপাত করা উচিত, আগের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। এই রূপান্তরটি সিরিয়ার জনগণের বৈচিত্র্যময় পরিচয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি বেসামরিক, ধর্মনিরপেক্ষ বা উদার রাষ্ট্রকে পৃষ্ঠপোষকতা করে, ব্যক্তি-ক্ষমতার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে।
কী অর্জন করা যেতে পারে, সিরিয়ার নাগরিক হিসাবে আমরা এর সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক দৃষ্টিভঙ্গি চিত্রিত করার চেষ্টা করি। তবে আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, এই পথে চ্যালেঞ্জ আসতে পারে। তবুও আমি বিশ্বাস করি, দেশটি (সিরিয়া) স্থিতিশীলতার দিকে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথে রয়েছে, যা আমাদের এমন একটি ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করবে, যেখানে সিরিয়া এ অঞ্চলের মধ্যপন্থি অক্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠবে।
সিরিয়ার উচিত পূর্ব ও পশ্চিম উভয়ের সঙ্গেই সম্পর্ক গড়ে তোলা, পুনর্গঠনের দিকে মনোনিবেশ করা-শুধু অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ নয়, বরং গোটা রাষ্ট্রকে পুনর্গঠন করা। শিক্ষাক্রম থেকে শুরু করে সরকারি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম পর্যন্ত বিভিন্ন সেক্টরে ব্যাপক পরিবর্তন আনা একান্ত প্রয়োজন।
পরিষেবা প্রদানের জন্য সিরিয়ায় একটি নতুন পদ্ধতি গড়ে তোলা প্রয়োজন, যেখানে বিজ্ঞচিত ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেওয়া হবে, যা কর্মক্ষমতার উন্নতি করবে এবং দেশের সর্বব্যাপী দুর্নীতি মোকাবিলা করবে।
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে আমরা যেসব ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি, তা অগণিত সিরীয় নাগরিকের একটি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছে। আমি নিশ্চিত, এই রূপান্তর সিরিয়া এবং অন্যত্র স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখবে। এই নতুন অধ্যায় সিরিয়া ও ইসরাইলের মধ্যে ব্যাপকভিত্তিক শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করতে পারে, কারণ সেখানে কোনো অনতিক্রম্য পার্থক্য নেই।
ভবিষ্যৎ সিরিয়া সব দেশের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ হবে। বিদেশে বসবাসরত সিরীয় জনসংখ্যার অর্ধেক মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে এবং এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা ধারণ করছে যে, তারা দেশের পুনর্গঠনে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করার মতো অবস্থায় রয়েছে।
এই ক্রান্তিকালীন পর্যায়ের প্রস্তুতিতে সিরীয়দের সহায়তা করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং আরব দেশগুলোর জন্য দরজা খোলা রয়েছে। যদিও এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান, বিশেষ করে জঙ্গি পটভূমির গোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে, তবু আমি বিশ্বাস করি, পূর্ববর্তী শাসন নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হওয়া শহরগুলোর অভিজ্ঞতা কঠোর ধর্মীয় শাসন আরোপ এড়ানোর একটি সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষাকেই তুলে ধরে। স্থানীয়রা তাদের নিজেদের বিষয়গুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসন চায়, যা আশাব্যঞ্জক।
আমাদের অবশ্যই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সিরিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করতে হবে, যা ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ শাসনের ছায়া থেকে বেরিয়ে একটি ব্যতিক্রমী মডেল হিসাবে দাঁড়িয়েছে।
আরব নিউজ থেকে ভাষান্তরিত
ঘাসান ইবরাহিম : সিরীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সাংবাদিক ও গবেষক; মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরান বিশেষজ্ঞ