Logo
Logo
×

বাতায়ন

গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঐক্যের তাগিদ

Icon

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঐক্যের তাগিদ

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যৌক্তিক সংস্কার দৃশ্যমান করে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরছে প্রায় সব রাজনৈতিক দল। এতে প্রতীয়মান হয়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের গণতন্ত্রহীনতার অপসংস্কৃতিকে ঘৃণাভরে সবাই প্রত্যাখ্যান করেছেন। বিগত সরকারের আমলে অর্থ পাচার, নানামুখী দুর্নীতি, অপরাজনীতি, দমনপীড়ন ইত্যাদির পেছনে গণতন্ত্রহীনতাই মুখ্য কারণ হিসাবে চিহ্নিত। প্রায় সব রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিক্রমায় ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা ছিল প্রধান দাবি। অবাধ-মুক্ত-স্বাধীন ব্যক্তিসত্তায় ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে পছন্দের ব্যক্তিকে জনপ্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত করার উদ্দেশ্যই হচ্ছে চলমান রাজনীতির প্রধান অঙ্গীকার।

মূলত স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়ে নির্বাচনকে কলুষিত করার জন্য বিগত সরকারের সব কার্যক্রম ছিল অবৈধ। সম্পূর্ণ অনৈতিক পন্থায় জনগণের অধিকারের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছিল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সাবলীল ধারা। সে সময় অনুষ্ঠিত প্রায় প্রতিটি নির্বাচনই দেশে-বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। জনগণের প্রত্যাখ্যাত এসব কথিত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ নিপীড়ন-নির্যাতনের নির্মম অধ্যায় রচিত হয়েছে। কদর্য পন্থায় ভোটের অনুষ্ঠান ছিল নির্লজ্জ কারসাজিতে পরিপূর্ণ। দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্ষমতা কুক্ষিগত করার লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়েছিল সব অশুভ কার্যক্রম। জাতীয় থেকে আঞ্চলিক পর্যায়ে সব ক্ষেত্রে জনগণের মৌলিক অধিকারকে খর্ব করা হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে বিরূপ আবহ তৈরি হয়। এরপর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ সংসদ নির্বাচন ছিল নিদারুণ বিতর্কিত। একই পন্থায় ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ডামি প্রার্থীর মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা অব্যাহত ছিল।

সংবিধানে জনগণ রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার উৎস হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত। স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিকদের সংবিধানসম্মত সব অধিকার অবারিত ভোগ করার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। মৌলিক অধিকার সমুন্নত রাখাসহ ধর্মীয়, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জনগণের অবাধ-স্বাধীন অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা সুরক্ষিত থাকে। বিশ্বের প্রতিটি দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বা ক্ষমতার পালাবদলের পরিক্রমায় জনগণের ভূমিকাই মুখ্য। অহিংস-পরমতসহিষ্ণুতার পরিবেশে যথাযথ ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে অধিকাংশের রায়ের ভিত্তিতে সরকার কাঠামো পরিবর্তনের ধারা সর্বজনস্বীকৃত। নির্বাচনে ধর্ম-বর্ণ, দল-মত, নারী-পুরুষ, অঞ্চল নির্বিশেষে প্রাপ্তবয়স্ক ভোটারদের ন্যায্য অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ের জন্য কারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন, তা নির্ধারিত হয়। সততা, যোগ্যতা, মেধা-প্রজ্ঞা ও দেশেপ্রেমে ঋদ্ধ, জনগণের স্বার্থ সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং দুঃসময়ে পরীক্ষিত নেতৃত্বকে জনপ্রতিনিধিরূপে নির্বাচিত করে জনগণ তাদের পবিত্র সংবিধানসম্মত ন্যায়সংগত অধিকার প্রয়োগে বদ্ধপরিকর। উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশে সরকার পরিবর্তনের প্রচলিত নিয়ম প্রায় অভিন্ন।

গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে পরবর্তী সরকার গঠনের সব কর্মকৌশল অবশ্যই প্রতিপালনযোগ্য। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের যথার্থ ধারণ ও পরিচর্যা আধুনিক রাষ্ট্রের উন্নয়ন-অগ্রগতির অন্যতম উপাদান। সর্বস্তরের জনগণের কল্যাণের জন্য বিধিবদ্ধ প্রক্রিয়ায় অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং জনপ্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থাই প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারার প্রকৃষ্ট উপায়। প্রকৃতপক্ষে সব দল-মতের সম্মিলিত অংশগ্রহণ ও সমর্থনে নেতৃত্ব বাছাই এবং সঠিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে সরকার গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে। গণতন্ত্র হলো আধুনিক বিশ্বের সর্বাপেক্ষা সমাদৃত শাসনব্যবস্থা, যা বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে শুরু করে বিশ্বের সর্বত্রই জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়েছিল। বিপুল পরিবর্তন-পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে বর্তমানেও গণতন্ত্র সমধিক জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থার রূপ পরিগ্রহ করে চলেছে। গণতন্ত্র যে কোনো সমাজে পরিশুদ্ধ পন্থায় সমগ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণ সাধনে রাষ্ট্র বা সরকার পদ্ধতিকে নির্দেশিত করে। একনায়কতন্ত্র বা রাজতন্ত্রের বিপরীতে জনগণের শাসন বা শাসননীতি অনুসারে পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থা গণতন্ত্রের শ্বাশত ধারণার সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। গণতন্ত্র সরকার পরিচালনা ও নীতিনির্ধারণে জনগণের অংশগ্রহণ, মানুষের স্বাধীনতা-অধিকার নিশ্চিতকরণ, রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাসহ সরকারকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে সহায়তা করে। প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রের ঐতিহ্য সমুন্নত রাখার তাৎপর্যপূর্ণ ভিত্তি হচ্ছে সর্বজনস্বীকৃত নির্বাচন অনুষ্ঠান।

গণতন্ত্রের প্রাথমিক মূল্যবোধ হচ্ছে-ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অর্থাৎ ব্যক্তির মৌলিক স্বাধীনতা তথা চিন্তার স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, ভোটদান, দল গঠন, অংশগ্রহণ, প্রার্থী হওয়ার স্বাধীনতা, নির্বাচনে অংশগ্রহণের স্বাধীনতা, ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা ও অভিযোগ উত্থাপনের স্বাধীনতা অর্থাৎ সার্বিকভাবে জীবনধারণের অধিকার, পরিবার গঠনের অধিকার, নিরাপত্তার অধিকার, আইনের আশ্রয় নেওয়ার অধিকার, স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার, বিরোধিতার অধিকার ইত্যাদি সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তিত্ব বিকাশের সঙ্গে অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা, সহনশীলতা, অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতকে সাদরে গ্রহণ করার মানসিকতা। যে কোনো সামাজিক প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির স্বাভাবিক ব্যক্তিত্ব ও সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের জন্য প্রয়োজন গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা। এজন্যই বিশ্বের সব সভ্য দেশ, বিবেকবান ও মানবতাবাদী মানুষ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ও প্রত্যাশী। গণতান্ত্রিক শিক্ষা হচ্ছে নিজের ইচ্ছার সঙ্গে অন্যের ইচ্ছার সমন্বয় ঘটানো বা অধিকাংশের ইচ্ছা বা আগ্রহকে যৌক্তিকভাবে নিজের বা ব্যক্তির অধিকারে সন্নিবেশন। ভলতেয়ার বলেছেন, ‘তোমার মতের সঙ্গে আমি একমত নাও হতে পারি, কিন্তু তোমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন হলে প্রাণ দেব।’

দেশবাসী সম্যক অবগত আছেন, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব আন্দোলন ও গণ-অভ্যত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে এ সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংকট উত্তরণের চেষ্টা করছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট কাটিয়ে ওঠা, শ্রমবাজারের সমৃদ্ধি, দাতা-উন্নয়ন সহযোগীদের বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি, তিন মাসের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ দেশবাসীর জন্য স্বস্তিদায়ক। গণ-অভ্যুত্থানের এক মাসের মধ্যে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন ও জনপ্রশাসন খাতের সংস্কারে ছয়টি কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। পরবর্তীকালে আরও পাঁচটি কমিশন গঠন করা হয়। ব্যাংক খাত সংস্কার করার জন্য এরই মধ্যে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, যা প্রশংসনীয়। দুর্বল ব্যাংক রক্ষায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা প্রদানের সংবাদে উদ্বিগ্ন ব্যাংক গ্রাহকদের মধ্যে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে এসেছে।

দেশে অবাধ-সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান লক্ষ্য। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন কর্তৃক আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারের কাছে সংস্কারবিষয়ক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন কমিশনপ্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি জানান, এ প্রতিবেদনের আলোকে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করা যেতে পারে। ইতোমধ্যে দেশে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে।

সম্প্রতি আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত কপ-২৯ সম্মেলনের প্রাক্কালে বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা সব ধরনের সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে তা নির্ভর করছে সংস্কারের গতির ওপর। স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করতে হবে। আমরা দ্রুত নির্বাচন করতে চাই। সরকারে দায়িত্ব নেওয়ার পর আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম দেশকে ভোটের জন্য প্রস্তুত করতে। প্রস্তুতি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচন দেওয়া হবে। সংস্কার কাজে দেশের সবাইকে এক হতে হবে। সরকার, সংসদ, নির্বাচনবিধি কেমন হবে, এসব খুব দ্রুত শেষ করতে হবে।’

সামগ্রিক পর্যালোচনায় আশা করা যায়, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে এবং সর্বত্র এর অর্থবহ পরিচর্যায় জনগণের দীর্ঘদিনের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য কিছুটা সময় অতিবাহিত হলেও দিনশেষে গ্রহণযোগ্য-নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকার গঠনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হোক-এটিই সময়ের দাবি।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম