মাটির যত্ন নেওয়া সবার দায়িত্ব

ড. মো. আবুল কাশেম
প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আজ ৫ ডিসেম্বর বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস। এবার এ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘মাটির যত্ন : পরিমাপ, পর্যবেক্ষণ ও পরিচালনা’। জীবের খাদ্যের উৎস হলো স্বাস্থ্যকর মাটি। এটা একটি জীবন্ত প্রাকৃতিক বস্তু, যা খুব ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয় এবং নিচের দিকে বৃদ্ধি পায়। আমাদের মতোই মাটি শ্বাস নেয় এবং বেঁচে থাকার জন্য বাতাস ও পানির প্রয়োজন হয়। স্বাস্থ্যকর, জীবন্ত মৃত্তিকা বা মাটি ছোট জীব থেকে শুরু করে মানবগোষ্ঠী পর্যন্ত সবাইকে প্রয়োজনীয় নানা উপাদানের জোগান দিয়ে থাকে। এটা উদ্ভিদকে পুষ্টি সরবরাহ করে, যা আমাদের খাওয়ায়, পানিকে ফিল্টার করে আমাদের পানের যোগ্য করে দেয়, বন্যা থেকে রক্ষা করে, লক্ষ কোটি জীবের বাসস্থান হিসাবে কাজ করে এবং আমাদের অ্যান্টিবায়োটিক সরবরাহ করে।
মৃত্তিকা সম্পদের সঠিক ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার ওপর সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৪ সালের ৫ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস পালন করা হয়। উল্লেখ্য, থাইল্যান্ডের সাবেক রাজা আদুলিয়াদেজ ভূমিবল মৃত্তিকা সম্পদের গুরুত্ব, তার ভাবনা ও আন্তরিকতা এবং এ সম্পদের প্রতি তার আবেগ দিয়ে সারা বিশ্বের মৃত্তিকা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। আদুলিয়াদেজ ভূমিবল ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী রাজা। তিনি ১৯২৭ সালের ৫ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৩ অক্টোবর ২০১৬ সালে মৃত্যুবরণ। তাই প্রয়াত রাজার সম্মানার্থে তার জন্মবার্ষিকীর দিন প্রতিবছর ৫ ডিসেম্বর এ দিবসটি পালন করা হয়।
বর্তমানে আমাদের আবাদের জমির মাটির স্বাস্থ্য এবং খাদ্যের গুণগত মান হুমকির সম্মুখীন। প্রায় ৭৫ শতাংশ আবাদি জমি তার উর্বরতা শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। অতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহার এবং জৈব পদার্থের ঘাটতি এর প্রধান কারণ।
মাটির চারটি প্রধান উপকরণের (খনিজ, জৈব, পানি ও বায়ু) মধ্যে জৈব পদার্থ হলো অন্যতম। একটা উর্বর কৃষিজমির মাটিতে এর পরিমাণ ৫ শতাংশ থাকা দরকার। বর্তমানে আমাদের দেশের অনেক জমিতেই এর পরিমাণ ১ শতাংশের নিচে, যা উদ্বেগজনক। জৈব পদার্থের মূল উৎস হলো বিভিন্ন ধরনের জৈব সার, গাছের লতা-পাতা, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, জৈব আবর্জনা, শাকসবজি ও গরু-ছাগলের গোবর ইত্যাদি। আগে গ্রামের কৃষকরা তাদের গৃহপালিত গরুগুলোর গোবর বাড়ির এক কোনায় গর্তে জমা করে বছরশেষে শুষ্ক মৌসুমে ফসলি জমির মাটিতে মিশিয়ে দিত। বর্তমানে এর ব্যবহার একবারেই নেই, কারণ গরু-ছাগলের লালনপালন চলে গেছে খামারিদের হাতে। তারা ডেইরি বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের কোনো ব্যবস্থা না পেয়ে নালা, নর্দমা, নদীতে বা পুকুরে ডাম্পিং করে পরিবেশ দূষণ করছে। উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের ডেইরি খামারের বর্জ্য কর্ণফুলীর জন্য বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে; প্রায় ৬০০ টনের মতো ডেইরি বর্জ্য প্রতিদিন কর্ণফুলীতে যোগ হচ্ছে। খামারিরা বর্র্জ্য নিয়ে আতঙ্কে থাকেন, অনেক সময় জরিমানারও সম্মুখীন হন। আসলে গোবর ব্যবস্থাপনার চিত্র সারা দেশে প্রায় একইরকম, এর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার। যেহেতু মাটি ছাড়া জীবন কল্পনা করা যায় না, তাই তার যত্ন নেওয়া অপরিহার্য। এক্ষেত্রে আমাদের চারপাশের পচনশীল বর্জ্য এবং গরুর গোবর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের খামার শাখার তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রায় ২ কোটি ৪৮ লাখ ৫৬ হাজার পশু রয়েছে। দৈনিক ১০ কেজি হিসাবে ওই পশুগুলো থেকে বছরে গোবর আসে প্রায় ৯ কোটি ১২.৫ লাখ টন, যা থেকে কেঁচো, ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই বা ট্রাইকো কম্পোস্ট ইত্যাদির মাধ্যমে কমপক্ষে ৪ কোটি ৬০ লাখ টন জৈব সার উৎপন্ন হবে, যা দেশের সব আবাদি জমিতে হেক্টরপ্রতি ৫ টন হিসাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে এবং ওই ব্যবস্থাপনা থেকে বছরে উপার্জন হবে কমপক্ষে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে আমাদের নগরগুলোতে দৈনিক প্রায় ২৫ হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, তার মধ্যে রয়েছে ১৭ হাজার টন পচনশীল বর্জ্য। এ পচনশীল বর্জ্যগুলোকে কালো সৈনিক পোকার (Black soldier fly larva: Hermetia) মাধ্যমে মূল্যবান সম্পদে পরিণত করা সম্ভব। ময়লা-আবর্জনা ও দুর্গন্ধ থেকে দূরে থাকা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। কিন্তু এ পোকা তার উলটো। যত রকমের পচনশীল আবর্জনা আছে, সবই তাদের পছন্দনীয় খাবার। এগুলো পরিবেশবান্ধব এবং কৃষকের বন্ধু। পচনশীল মিশ্রিত বর্জ্যগুলো গ্র্যান্ডিং মেশিনের সাহায্যে পেস্ট করে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে কালো সৈনিক পোকার বেবি লার্ভাকে দিলে ২ সপ্তাহের মধ্যে খেয়ে পূর্ণাঙ্গ লার্ভায় পরিণত হয় এবং পাশাপাশি জৈব সারও তৈরি হয়।
বিভিন্ন তথ্য এবং আমাদের অভিজ্ঞতা অনুসারে, সাধারণত ৬ কেজি মিশ্রিত আবর্জনা থেকে ১ কেজি লার্ভা ও ১ কেজি জৈব সার পাওয়া যায়। এ লার্ভায় প্রোটিনের পরিমাণ অত্যন্ত বেশি থাকায় (৫০ শতাংশের বেশি) হাঁস-মুরগি, মাছ, পশু-পাখি, বিড়াল-কুকুরের আকর্ষণীয় খাবার হিসাবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। বাংলাদেশেও এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে ১ কেজি লার্ভার মূল্য ৫০ টাকা এবং জৈব সারের মূল্য ১৫ টাকা। এ হিসাবে দৈনিক ১৭ হাজার টন আবর্জনা থেকে বছরে আয় হবে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। এ প্রক্রিয়াকে বাস্তবায়িত করতে বহুতল আবাসিক ভবন, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ক্যান্টিন, বাজার, শপিংমল, সরকারি-বেসরকারি অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্যগুলোকে আলাদা করে বিভিন্ন পাত্রে বা স্থানে রাখতে হবে। সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা শহরের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে নির্দিষ্ট সময়ে সংগ্রহ করে ওই কাজে (কম্পোস্টিং ও রিসাইক্লিং) সহায়তা করবে। আমাদের এ বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সুস্থ থাকবে মাটি ও পরিবেশ, সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান এবং রাসায়নিক সার, মৎস্য ও পশু খাদ্যের ভর্তুকি বাবদ সাশ্রয় হবে অনেক টাকা।
যেহেতু মাটি আমাদের জীবনের ভিত্তি, তাই এর যত্ন নেওয়া এবং একে সুস্থ রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব। এ সম্পদ বিলীন হয়ে যাক, তা কারও কাম্য নয়। সমতল ভূমিতে ১ ইঞ্চি মাটি তৈরি হতে প্রায় ৫০০ থেকে ১০০০ বছর সময় লাগে, কাজেই একবার হারিয়ে গেলে তাকে ফিরিয়ে আনা একেবারেই অসম্ভব।
তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এ সম্পদ রক্ষায় ও যত্নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন এবং জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে।
ড. মো. আবুল কাশেম : অধ্যাপক, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়