Logo
Logo
×

বাতায়ন

শিক্ষা খাত কি অবহেলিতই থাকবে?

Icon

ড. মো. আবদুল জলিল

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষা খাত কি অবহেলিতই থাকবে?

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার দেশের বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কারের জন্য ইতোমধ্যে ১১টি কমিশন গঠন করেছে। এখন পর্যন্ত গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। কিন্তু জনপ্রত্যাশা পূরণে সংস্কার কাজে অগ্রাধিকার নির্ধারণে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে। কেননা শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতের সংস্কারকে অগ্রাধিকার তালিকায় স্থান দেওয়া হয়নি।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে শিক্ষা সবচেয়ে অবহেলিত একটি সেক্টর। আধুনিক, উন্নত ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় শিক্ষার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি থাকলেও অতীতের কোনো সরকারই শিক্ষার উন্নয়নে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি। শিক্ষা খাতকে অব্যাহতভাবে গুরুত্বহীন করে রাখায় সমাজেও শিক্ষা ও শিক্ষকদের মর্যাদা ক্রমাগতভাবে হ্রাস পেয়েছে। তথাকথিত সামাজিক মর্যাদার বুলি আউড়িয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকরা শিক্ষকদের সর্বদা বঞ্চিত করে আসছেন। সম্মান আর সামাজিক মর্যাদার লোভে অনেকেই শিক্ষকতা পেশায় এলেও যখন উপলব্ধি করতে পারেন, পেটে খাবার না থাকলে সামাজিক মর্যাদাও পাওয়া যায় না, ততক্ষণে অন্য কোনো পেশা বেছে নেওয়ার সুযোগ আর থাকে না। ফলে তাদের হতাশা, বিষণ্নতা এবং নিজের ও সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার বেড়াজালে পাঠদানে মনোনিবেশ করা শুধু আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়। এতে জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার শিক্ষার্থীরা যেমন বঞ্চিত হন, একইসঙ্গে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নও দক্ষ জনশক্তির অভাবে বাধাগ্রস্ত হয়।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ যুগে টিকে থাকতে হলে শিক্ষা খাতের আশু সংস্কারের বিকল্প নেই। রাজনৈতিক সরকারগুলো বিগত দিনে শিক্ষা সংস্কারে উদ্যোগ নেয়নি, বরং আমাদের শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কতিপয় শিক্ষক, আমলা ও রাজনৈতিক ব্যক্তি পকেট ভারী করার চেষ্টা করেছেন। জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে বৈষম্যমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের অঙ্গীকার নিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারও শিক্ষাকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের অগ্রাধিকার তালিকার অনেক নিচে রেখেছে বলে প্রতীয়মান।

একটা সময় ছিল, যখন জমিদার শ্রেণি চাইত না প্রজাদের সন্তানরা শিক্ষা-দীক্ষা লাভ করুক। প্রজাদের শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত রাখতে পারলে তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে জানতে পারবে না। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ শিক্ষিত না হলে তারা যে শোষিত ও বঞ্চিত হচ্ছে, তা বুঝতেই পারবে না। তাদের অধিকার কেউ কেড়ে নিলে প্রতিবাদ করতে পারবে না। ফলে শোষক শ্রেণি নির্বিঘ্নে শাসন-শোষণ চালিয়ে যেতে পারবে। নিকট অতীতে কয়েক দশক আগেও মফস্বল এলাকায় কিছু জোতদার শ্রেণি ছিল, যারা কখনো চাইত না তাদের এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক। আশঙ্কা একটাই-কৃষকের সন্তান লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে গ্রামে জোতদার শ্রেণির প্রভাব কমে আসবে এবং সর্বস্বান্ত কৃষক তাদের ওপর নির্ভরশীল না থেকে আত্মনির্ভরতার দিকে এগিয়ে যাবে। এ জমিদার-জোতদার শ্রেণির বদ্ধমূল ধারণা ছিল, চাষার সন্তানদের জন্য লেখাপড়া নয়। ব্রিটিশ শাসনামলে ঢাকায় যখন একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা শুরু হয়, তখনো কলকাতার নাক উঁচু জমিদার শ্রেণি থেকে বলা হচ্ছিল, মূর্খদের জন্য আবার বিশ্ববিদ্যালয়? উল্লেখ্য, দার্শনিক সক্রেটিসকেও হেমলক বিষপানে হত্যা করা হয়েছিল শিষ্যদের মধ্যে জ্ঞান বিতরণের অপরাধেই!

শিক্ষাকে একটি জাতির মেরুদণ্ড হিসাবে বিবেচনা করা হয়। একটি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা কীভাবে দেখতে চাই, তাদের মধ্যে কোন ধরনের যোগ্যতা-দক্ষতা থাকবে, এমনকি তাদের চিন্তাচেতনা কীভাবে বিনির্মিত হবে, তা নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায় হচ্ছে শিক্ষা। সেজন্য যে কোনো দেশের শিক্ষানীতিতে জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে থাকে এবং সেই আলোকেই শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত আমাদের দেশে কোনো শিক্ষানীতিই স্থায়িত্ব লাভ করতে পারেনি। মহান স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরও বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। বিশ্বায়নের ফলে উদ্ভূত সামাজিক-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য কোন ধরনের যোগ্যতাসমম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট আমাদের প্রয়োজন, সে সম্পর্কে কোনো গবেষণা করতে আমরা আগ্রহী নই। কোনো দেশে প্রচলিত একটা ব্যবস্থা দেখেই আমরা অনেক সময় আমাদের দেশেও সেটা চালু করে ফেলি। কিন্তু আমাদের দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় এটি কতটুকু উপযোগী, যাদের জন্য এ ব্যবস্থা চালু করা হবে, তারা সেটা গ্রহণ করতে প্রস্তুত আছে কি না এবং নতুন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের সক্ষমতা আমাদের কতটুকু আছে-সেসব যাচাই করার প্রয়োজন আমরা মনে করি না। ফলে হঠাৎ করে এসএসসি পরীক্ষায় নৈর্ব্যক্তিক মূল্যায়ন চালু করার কয়েক বছরের মধ্যেই আমরা এর অসারতা বুঝতে পারলাম। ঢাকঢোল পিটিয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে আমরা অনুধাবন করলাম, এ পদ্ধতি আমাদের দেশের বাস্তবতায় সত্যিকার অর্থে শিক্ষার্থীদের কাজে আসছে না। শিক্ষানীতিতে উল্লেখ না থাকলেও পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা প্রবর্তন করে পরবর্তীকালে আবার পরীক্ষাবিহীন একটা শিক্ষাপদ্ধতি চালু করা হলো। কিন্তু এ নতুন ব্যবস্থা সম্পর্কে শিক্ষকদের কী প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, কারা প্রশিক্ষণ দেবেন, প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রয়োজন হবে কিনা, শিক্ষার্থীদের কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে-এসব বিষয় নির্ধারণ না করেই নতুন ব্যবস্থা চালু করে দেওয়া হলো। অভিভাবকরা সন্দিহান হলেন; অনেক শিক্ষক বুঝতে পারলেন না তিনি কী পড়াবেন, কীভাবে মূল্যায়ন করবেন; শিক্ষার্থীদের মধ্যেও শঙ্কা থেকে গেল। মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হলো। ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ আর বৃত্তভিত্তিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা থেকে পরবর্তীকালে বিষয়ভিত্তিক পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর দিয়ে মূল্যায়ন করার কথা বলা হলো। একদিকে আমরা শুনলাম ডিভাইসনির্ভরতা শিশুদের মধ্যে অস্থিরতা, পড়াশোনায় অনাগ্রহ, নৈতিক স্খলন, এমনকি অটিজমের কারণ হতে পারে। আবার নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় ডিভাইসনির্ভরতাকে শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ করে দেওয়া হলো। এর প্রভাব সম্পর্কে কোনো গবেষণা করা হলো না।

শিক্ষা খাতে আমাদের অবহেলার আরেকটি দিক হচ্ছে শিক্ষায় আমরা পর্যাপ্ত অর্থ ব্যয় করতে আগ্রহী নই। অথচ শিক্ষায় ব্যয় করা মানে হচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ করা। শিক্ষাক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের আর্থিক বরাদ্দ সর্বনিম্ন। ইউনেস্কো যেখানে জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করে, সেখানে আমরা ২ শতাংশের আশপাশেই ঘুরপাক খাচ্ছি। শতাংশ বিবেচনায় আমাদের বরাদ্দ বরং প্রতিবছর কমে আসছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে শিক্ষায় আমাদের বরাদ্দ ছিল জিডিপির ২.০৮ শতাংশ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সেটা কমে ১.৮০ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমরা বরাদ্দ দিতে পেরেছিলাম জিডিপির ১.৭৬ শতাংশ। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে জিডিপির মাত্র ১.৬৯ শতাংশ, যা দিয়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। অথচ যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান শিক্ষায় বরাদ্দ রেখেছে তাদের জিডিপির ৩ শতাংশের বেশি।

শিক্ষায় একদিকে যেমন আমাদের বিনিয়োগ কম, অন্যদিকে জাতি গঠনের কারিগর শিক্ষকদের প্রতি অবহেলা একটি স্বাভাবিক প্রপঞ্চে পরিণত হয়েছে। শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার বেলায় বলা হয় শিক্ষা কোনো পেশা নেয়, এটি একটি ফ্যাশন। শিক্ষকদের লোভ-লালসা থাকতে নেই। অনেক সময় উদাহরণ দেওয়া হয় শিক্ষকরা কম বেতন সত্ত্বেও সংসার চালিয়ে কেতাদুরস্ত জীবন পরিচালনা করতে পারেন এবং তাদের সন্তানরা প্রায় সবাই শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান। এসব মনভোলানো কথা বলে শিক্ষকদের ভ্রমের মধ্যে রাখা হয়। আবার তাদের কাছ থেকে অক্সফোর্ড-ক্যামব্রিজের শিক্ষকদের মতো সেবা না পেলে সমালোচনা করতে পিছপা হন না অনেকে।

আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সবচেয়ে অবহেলিত ও বঞ্চিত। স্নাতক পাশ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করে যিনি ১২ বা ১৩তম গ্রেডে বেতন পান, তারই সহপাঠী স্নাতক পাশ করেই সরকারি চাকরিতে ৯ম গ্রেডে বেতন পান। তাহলে একজন মেধাবী তরুণ কীসের নেশায় সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে না গিয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমাদের শিশুদের মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার কঠিন দায়িত্ব নেবেন? এরপরও কি আমরা বলতে পারব, শিক্ষা খাত রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার তালিকায় আছে?

শিক্ষা খাতকে অবজ্ঞা করে বিশ্বের কোনো জাতি উন্নয়নের সড়কে উঠতে পারেনি। তাই সত্যিকার অর্থে একটি বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়তে হলে শিক্ষা খাতের সংস্কারে সবার আগে মনোনিবেশ করা উচিত। শিক্ষায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করে শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে জাতি হিসাবে আমরা উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছাতে পারব। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী জনশক্তি গঠন করে একটি আধুনিক ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকরাই হবেন প্রধান কারিগর। এজন্য শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় করে তোলা এবং শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষা খাতের মৌলিক সংস্কারের বিকল্প নেই।

ড. মো. আবদুল জলিল : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম