Logo
Logo
×

বাতায়ন

একটি দাবিদাওয়া নিষ্পত্তি সংস্থার রূপরেখা

Icon

সালেহ উদ্দিন আহমদ

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

একটি দাবিদাওয়া নিষ্পত্তি সংস্থার রূপরেখা

দেশে দাবিদাওয়া নিয়ে নৈরাজ্য চরমে উঠেছে। চারদিকে দাবি আর দাবি। সংঘবদ্ধ দাবির চাপ এত বাড়ছে যে সরকার তা সামাল দিতে পারছে না এবং এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও সীমাবদ্ধতা লক্ষ করা যাচ্ছে। দাবি জানানো খুব সহজ- কর্মচারীদের বেতন ২০ শতাংশ বাড়াতে হবে, নেতারা দাবি লিখলেন। কোন কর্মচারী এ দাবির সঙ্গে একমত না হবেন? সবাই চায় নিজের বেতন অনেক বা নিদেনপক্ষে কিছুটা বাড়াতে।

দাবি ন্যায্য কি না, সরকারের সামর্থ্য আছে কি না, দাবিটি অন্য সংস্থার কর্মচারীদের জন্য বৈষম্যমূলক কি না-এসব চিন্তা করার লোক কোথায়? শুরু হলো আন্দোলন। হাসপাতালে একজন অসুস্থ ছাত্র মারা গেছেন। তার মৃত্যুর জন্য দায়ীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য শুরু হলো আন্দোলন। সরকার কিছু একটা করল, হয়তো একজন-দুজন ডাক্তারকে বদলি করল। কিন্তু আন্দোলন থামে না। মৃত ব্যক্তিকে যে ফিরিয়ে আনা যায় না, তা কেউ বুঝতে চায় না।

ধরা যাক, দাবির আন্দোলন থামাতে সরকার দাবিদাওয়া উত্থাপনকারী নেতাদের জেলে ঢুকিয়ে দিল। দাবির আন্দোলন থামবে? মোটেও না। বরং পুরোনো দাবির সঙ্গে আরও নতুন দাবি যুক্ত হয়ে আন্দোলন তিব্রতর হবে। সরকার ও রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, ধৈর্য ধরুন, সময় দিন। কিন্তু কেউই শুনছে না, দাবির আওয়াজ আরও বাড়ছে। এই নৈরাজ্য থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

এতসব ক্ষোভ ও দাবিদাওয়া নির্ণয়ের জন্য জনগণকে একজন পথনির্দেশক ‘ন্যায়পাল’ দেওয়া উচিত। এতে যে কোনো বিষয়ে তাৎক্ষণিক ক্ষোভ রাস্তায় না গিয়ে পথনির্দেশকের ঘরে কিছুটা ঝেড়ে ফেলা যাবে এবং একটা সুবিবেচনা পাওয়ার আশা জাগতে পারে। যে কোনো ক্ষোভ ও অস্থিরতার প্রাথমিক ধাক্কাটা যদি আগেভাগে কিছুটা সামাল দেওয়া যায়, তাহলে পরবর্তী প্রতিক্রিয়া আরও যুক্তিসংগত হবে। আমরা কেন এত দাবিপ্রবণ হয়ে গেলাম? এ ধরনের দাবি-দাওয়া নিয়ে এত হাঙ্গামার কারণ কী? কত উপাদান যে রয়েছে এসবের পেছনে, সেসব নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা হওয়া দরকার। কিন্তু ঘরে যখন আগুন লাগে, তখন প্রথম কাজ হলো আগুন নেভানো।

আগুন নেভানোর জন্য আমি প্রথমেই খুঁজব একটি দাবিদাওয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মপন্থা। প্রস্তাব করছি, অবিলম্বে একটি ‘দাবিদাওয়া নিষ্পত্তি সংস্থা’ গঠন করা হোক। এ সংস্থার কাজ হবে দাবিগুলোকে যাচাই-বাছাই করে যেগুলো অন্যায্য, সেগুলোর উত্থাপনকারীদের কাউন্সেলিং করে বা যুক্তি দিয়ে বোঝানো। যেগুলো ন্যায্য, সেগুলো নিয়ে নিষ্পত্তি সংস্থা দাবি উত্থাপনকারীদের পক্ষ হয়ে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে তদবির করবে। আইন বিভাগ আইনগত দিক খতিয়ে দেখবে।

এটা গতানুগতিক অন্যসব সংস্থার মতো হবে না। এর সঙ্গে জড়িত থাকবেন দেশের বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষ, যেমন বিচারকার্যে দেশে এককালে জুড়ি প্রথা ছিল। প্রয়োজনে রাজনীতিকদের জড়িত করা যেতে পারে, আগুন নেভানোর জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এ সংস্থার প্রধান হবেন একজন ন্যায়পাল। তার অধীনে থাকবে-১. যাচাই-বাছাই বিভাগ, ২. আইন বিভাগ ও ৩. কাউন্সেলিং বা পরামর্শ বিভাগ।

পাঠক হয়তো ভাবছেন আমি একটা বড় মাথাভারী সরকারি সংস্থার কথা বলছি, যার অফিসঘর, টেবিল-চেয়ার এবং লোকজন গোছাতে সময় লাগবে ছয় মাস কিংবা এক বছর। মোটেও না, একজন ন্যায়পাল খুঁজে একটা অফিসঘরে এখনই শুরু করে দেওয়া যায় এ সংস্থা। ন্যায়পালের অফিসসহ চার বিভাগে দুজন করে আটজন লোক দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। প্রচার করে বলে দেওয়া হোক, ছোট বা বড়, ন্যায্য বা অন্যায্য যে কোনো দাবি প্রথমে এ সংস্থায় জমা দিতে হবে, নতুবা কোনো দাবি কোনোভাবেই বিবেচনা করা হবে না। যেহেতু ঢাকা দেশের রাজধানী, তাই বেশিরভাগ অবাস্তব ও হাঙ্গামামূলক দাবিদাওয়া ঢাকাভিত্তিক। তাই ঢাকা থেকেই শুরু করা হোক।

এখন আমরা দুটি দাবিদাওয়া ঘটনার পর্যালোচনা বা কেস স্টাডি করব-

১. একজন ছাত্র মারা গেছেন হাসপাতালে। ছাত্ররা ক্রুদ্ধ। বললেন, ডাক্তারের অবহেলায় মেরে ফেলা হয়েছে ছাত্রটাকে। সহপাঠীরা এলো দাবিদাওয়া নিষ্পত্তি সংস্থায়। নাম জমা দিল ডাক্তারদের, যারা চিকিৎসা করেছেন। তাৎক্ষণিক যোগাযোগ করা হলো হাসপাতালের প্রধানের সঙ্গে।

২. সচিবালয়ের কর্মচারীরা সমাবেশ করছে তাদের দাবি নিয়ে। দাবিদাওয়া অনেক লম্বা। আস্তে আস্তে এটা গড়াবে চরম আন্দোলনে, তা জানা কথা। দাবি-দাওয়া নিষ্পত্তি সংস্থার লোকেরাও বসে নেই। তারা পত্রিকায় দেখে আগেভাগে সক্রিয় হলেন, কথা বললেন কেবিনেট ডিভিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে, প্রয়োজনবোধে অর্থ বিভাগের সঙ্গে। আগেভাগে জেনে নিলেন কোন কোন দাবি অন্যায্য এবং পূরণ করা যাবে না এবং কেন যাবে না। নেতারা নিয়মমাফিক নিষ্পত্তি সংস্থায় আসবেন। তাদের কাউন্সেলিং করতে হবে, যেন তারা দাবির যুক্তিহীনতার কারণগুলো মাথা খাটিয়ে উপলব্ধি করতে পারেন।

‘দাবিদাওয়া নিষ্পত্তি সংস্থা’ সরকারের অন্যান্য সংস্থার মতো হবে না। তারা বসে বসে ফাইল আদান-প্রদানকারী লোক নিয়ে গঠিত হবে না। এখানে সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক নেতাদেরও প্রয়োজনবোধে জড়িত করা হবে। তারা হবে সংকট ব্যবস্থাপনা টিম। তারা জনগণকে সম্পৃক্ত করে এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে যে কোনো সংকট তীব্র হওয়ার আগেই তা সমাধানের চেষ্টা করবেন। এখানে বলে রাখা ভালো, এ সংস্থা শুধু সংঘবদ্ধ দাবিদাওয়া নিয়ে কাজ করবে। ব্যক্তিগত দাবির জন্য জনগণকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা থানায় যেতে হবে।

সাধারণত দুই ধরনের দাবি নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়-

১. কর্মযোগ্য দাবি, যা পূরণে সরকার কিছু একটা করতে পারে। যেমন, সরকারি চাকরিতে ঢোকার বয়সসীমা ৩৫ বছর করা, শহরের ভেতর ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলে অনুমতি দেওয়া ইত্যাদি। অনেক কিছু আইনসিদ্ধ না হলেও বা সরকারের নীতিবহির্ভূত হলেও সরকার তা সম্পূর্ণ বা আংশিক মেনে নিতে পারে। আবার এটাও মনে রাখতে হবে যে, অনভিপ্রেত দাবি মেনে নেওয়ার অর্থ নতুন দাবির ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। যেমন, বয়সের দাবি ৩৫ বছর মেনে নিলে ৩৮ বছরের দাবি আসতে কতক্ষণ?

২. অকর্মযোগ্য দাবি, যে ক্ষেত্রে সরকার কিছু করতে পারছে না। যেমন, সহপাঠীর মৃত্যু নিয়ে আন্দোলন। এক্ষেত্রে সহপাঠীকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। শোকসন্তপ্ত ছাত্রদের বোঝাতে ও বুঝতে সাহায্য করতে হবে কাউন্সেলিং করে। বিদেশে মানুষকে শান্ত রাখার জন্য কাউন্সেলিংকে একটা উপযুক্ত হাতিয়ার হিসাবে গণ্য করা হয়। আমাদের দেশে কেন তা করা যাবে না? যে কোনো শোক-ক্রোধ ও হাঙ্গামা প্রথমে শুরু হয় অল্পসংখ্যক লোক থেকে, যাদের শান্ত করতে পারলে বড় সংকট এড়ানো যেতে পারে।

দাবি কখন কোত্থেকে আসবে, সেটা অনুমান করে লাভ নেই। দাবি আসতে পারে ছাত্রদের কাছ থেকে, গার্মেন্ট কর্মীদের কাছ থেকে, রিকশা চালকদের কাছ থেকে বা বাস মালিক সমিতি থেকে। দাবি আসতে পারে রাজনীতিকদের কাছ থেকে। তারা অধৈর্য হলে বিপদ আরও বাড়তে পারে, তারাও মিছিল-হরতাল করে দাবি জানাতে পারেন। ভবিষতে আমাদের দাবিদাওয়া নিষ্পত্তি সংস্থা একটা বিশেষ গোয়েন্দা বিভাগ রাখতে পারে বা জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে চোখ রাখতে পারে-কোথা থেকে ঝামেলা শুরু হতে পারে, যেন তারা তাদের কার্যক্রমের জন্য আগেভাগে প্রস্তুতি নিতে পারে। তবে গোয়েন্দাদের তথ্যের ভিত্তিতে ধরপাকড় বা জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে না, অতীতে এর ফল ভালো হয়নি। গোয়েন্দাগিরির একমাত্র উদ্দেশ্য দাবিদাওয়া নিষ্পত্তি সংস্থা ও সরকারকে প্রস্তুতি গ্রহণে সাহায্য করা।

আশা করি, এভাবে দাবি-দাওয়ার আন্দোলন বেশ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালো থাকবে। আরেকটি বিষয় আমরা জানি, আমাদের জাতীয় আকাঙ্ক্ষাকে রূপায়িত করতে আমরা সবসময় দাবিদাওয়া ও জাতীয় আন্দোলনের ওপর নির্ভর করেছি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে এ দাবি-দাওয়া ও আন্দোলনের পালা চলছেই। কেউ আমাদের প্রাপ্য দাবিগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে পূরণ করেনি। আমরা যদি সুশৃঙ্খলভাবে আমাদের বড় আকাঙ্ক্ষাগুলোকে ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি করতে পারি, তাহলে জনগোষ্ঠীর ছোট আকাঙ্ক্ষাগুলোয়ও এর প্রতিফলন ঘটবে। ততদিন আমাদের এ সমস্যাগুলোকে নিষ্পত্তি করতে হবে এবং নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জনগণকেও বোঝাতে হবে কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক।

সালেহ উদ্দিন আহমদ : শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক; ডাকসুর সাবেক সম্পাদক (১৯৭০-৭২)

salehpublic711@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম