মিঠে কড়া সংলাপ
চারদিকে এসব কীসের আলামত!
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গত কয়েক মাস ধরে সারা দেশে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে যা ঘটে চলেছে, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। আমরা সাধারণ মানুষ রাস্তায় বের হলেই অবরোধের মুখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হচ্ছে। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার দেশের মানুষকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ আস্বাদনের যে সুখবাণীটি শুনিয়েছিল, রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে তার বিপরীত চিত্রই আমরা দেখতে পাচ্ছি। কারণ, রাস্তায় আমাদের চলাচলের স্বাধীনতাটুকুও হরণ করা হচ্ছে। যে কেউ যখন-তখন আমাদের রাজপথে আটকে রাখায় আমরা নিদারুণ দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হচ্ছি।
অতিরিক্ত জনঅধ্যুষিত এ দেশে সমস্যারও অন্ত নেই। কিন্তু তাই বলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত ছাত্ররাও সেসব সমস্যার ক্ষেত্রে বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে দাঁড়াবেন, এমনটি ভাবতে কষ্ট হয়। স্কুলের ছাত্ররা পরীক্ষায় ফেল করে অটোপাশের দাবিতে রাস্তায়-সচিবালয়ে আন্দোলন করবেন; কলেজের ছাত্ররা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হবেন নিজেরাই তা ঠিক করে এ নিয়ে আন্দোলন করতে রাস্তায় নেমে আমাদের অবরুদ্ধ করে রাখবেন; কোন কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে হবে, সংশ্লিষ্ট কলেজের ছাত্ররাই তা ঠিক করে রাস্তায় নেমে জনভোগান্তি সৃষ্টি করবেন-এসব কর্মসূচি মেনে নেওয়া যায় না। আবার পোশাক শ্রমিক, ব্যাটারিচালিত রিকশা শ্রমিকদের আন্দোলনের কারণেও জনসাধারণকে অশেষ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। পোশাক শ্রমিকরা বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিসহ বিভিন্ন অজুহাতে রাস্তা অবরোধ করে চলেছেন। ফলে আন্তঃজেলাসহ রাজধানীতে যানবাহনে চলাচলরত যাত্রীরা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন; ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের রাস্তায় আটকে রাখা হচ্ছে। অথচ পোশাক শ্রমিকদের বেতন-ভাতার সঙ্গে রাস্তায় চলাচলরত যাত্রীদের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ তাদের কেউ গার্মেন্ট মালিক নন। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
এসব জনভোগান্তি ও অরাজকতার প্রেক্ষাপটে সরকারের করণীয় কী, সে বিষয়টিই এখন একটি জাজ্বল্যমান প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, রাস্তাঘাটে এসব অরাজকতা অব্যাহত থাকলে মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে চলাচল করতে পারবেন না, দেশ দুষ্কৃতকারীদের দখলে চলে যাবে। আবার এসব ঘটনার পাশাপাশি উগ্রবাদী শক্তি যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তা দেখেও মানুষকে প্রমাদ গুনতে হচ্ছে। একশ্রেণির গোঁড়া মানুষকে একটি পত্রিকা অফিসের সামনে গরু জবাই করতে দেখে, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পত্রিকা অফিস ভাঙচুর করা দেখে মনে হয়েছে, তারাও দেশে অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে।
এ অবস্থায় বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে একশ্রেণির সংগঠন যে লাগামহীন হয়ে পড়েছে এবং তারা যত্রতত্র যা খুশি করে চলেছে, সে কথাটিও জনান্তিকে বলে রাখা প্রয়োজন। তারা অতি উৎসাহী হয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছবি ভাঙচুর বা কোনো ব্যক্তির বাড়িতে রক্ষিত পূর্বপুরুষদের দেওয়ালচিত্র, ম্যুরাল ইত্যাদি ভাঙচুর বা নষ্ট করে দিয়ে তাদের শক্তিমত্তার প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছে। যদিও এসব ঘটনা সরকারের হাইকমান্ডের কানে পৌঁছাচ্ছে বলে মনে হয় না। কারণ কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব ঘটনা পুলিশকে অবহিত করা হলেও তারা গুরুত্বের সঙ্গে তা বিবেচনা করছেন না। অথচ বিপ্লবোত্তর সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর উগ্রবাদীরা যাতে কোনো সুযোগ গ্রহণ করতে না পারে, প্রথম থেকেই সে বিষয়ে জোরালোভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। আমাদের দেশের একশ্রেণির ধর্মীয় বক্তা, যারা দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন, তারা ধর্মের ভুল ব্যাখা দিয়ে ধর্মপ্রাণ সরল মানুষকে ব্যবহার করে যে কোনো অঘটন ঘটিয়ে দিতে পারেন। এক্ষেত্রে সম্প্রতি চট্টগ্রামে একজন আইনজীবীকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য। দেশে ধর্মীয় উন্মাদনার আরও অনেক উদাহরণ আছে, যা মোটামুটি আমরা সবাই জানি। এ অবস্থায় বর্তমান সরকার এ উগ্রবাদীদের নিয়ন্ত্রণ করাসহ কথায় কথায় রাস্তা অবরোধকারীদের হাত থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করবে, সেটাই প্রত্যাশা।
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, বর্তমান সরকার সীমিত জনবল নিয়ে দেশ পরিচালনাকারী স্বল্পমেয়াদি একটি সরকার। সুতরাং তারা সব বিষয়ে কাজ করতে পারবেন না। কারণ অনেক ক্ষেত্রে, অনেক কাজে যে রাজনৈতিক দক্ষতার প্রয়োজন, যে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন, তা সবার আছে বলে মনে হয় না। তাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যেসব সমস্যার সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি সময়ের প্রয়োজন, সেসব ক্ষেত্রে হাত না দেওয়াই ভালো। যেমন নতুন করে সংবিধান রচনা করা বা সংবিধানে বড় কোনো পরিবর্তন আনা বর্তমান সরকারের কাজ নয় বলে মনে করি। শুধু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন বা অন্য কোনো জরুরি পরিবর্তনসহ কিছু সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণের পর একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পারলেই বর্তমান সরকার সার্থক বলে ধরে নেব। অন্যথায় আমরা সবাই জানি, প্রত্যেক মানুষেরই একটা নিজস্ব ধ্যানধারণা আছে, আবার প্রত্যেক মানুষই কিছুটা ইগো ধারণ করেন। সেক্ষেত্রে কোনো উপদেষ্টা যদি নিজের কোনো ধ্যানধারণা বাস্তবায়নের জন্য কোনো কাজে হাত দেন, তাহলেও তা ঠিক হবে বলে মনে হয় না। কারণ বর্তমান অবস্থায় কোনো সংসদ না থাকায়, তথা সম্মিলিতভাবে দীর্ঘ আলোচনা শেষে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ না থাকায় এক্ষেত্রে নিজস্ব চিন্তাধারা প্রয়োগ করে কাজ করাটাই স্বাভাবিক এবং তাতে ভুল হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়।
এ বিষয়ে একটি উদাহরণ টানা যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি আবার নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের কাজে হাত দেবেন। তার এ ঘোষণাটিকে সাধুবাদ জানিয়েই আমরা বলতে চাই, কথাটা বলা যত সহজ, কাজটা কিন্তু তত সহজ নয়। কারণ উপদেষ্টা মহোদয়ের হাতে সে কাজটি করার মতো যথেষ্ট সময় নেই। তাছাড়া কাজটি শুরু করার আগে মনে রাখা প্রয়োজন, গত পনেরো বছর ধরে বিগত সরকার এ কাজটি করতে গিয়ে যতটা দুর্নাম কুড়িয়েছে, তার কোনো তুলনা নেই! যিনি বা যারা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর অপছন্দের লোক ছিলেন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও তাদের অনেকের মুক্তিযোদ্ধা সনদ তিনি বাতিল করে দিয়েছিলেন এবং মুক্তিযোদ্ধা নন এমন শত শত ব্যক্তিকেও একটি ফরম পূরণ করে বা অনলাইনে দরখাস্ত গ্রহণ করে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দিয়েছেন। আর এসব করতে তিনি জামুকা কার্যালয়কে ঘুসের আখড়ায় পরিণত করেছিলেন। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, জামুকার সেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীই কিন্তু এখনো স্ব স্ব পদে বহাল আছেন। সুতরাং, কাদের দিয়ে তিনি আবারও যাচাই-বাছাই করাবেন, সে প্রশ্নটিও এসে যায়। এক্ষেত্রে শুধু জামুকার কয়েকজন সদস্য পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়।
এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত একটি সংবাদের প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। কয়েকদিন আগে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্ষুব্ধ চিত্তে আমাকে জানান, তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে, ছয় মাস আগে তার নামে বীর মুক্তিযোদ্ধা উল্লেখ করা জাতীয় পরিচয়পত্র প্রস্তুত করে রাখা হলেও তাকে তা দেওয়া হচ্ছে না। অথচ তার সহযোদ্ধারা তেমন পরিচয়পত্র হাতে পেয়েছেন। এ বিষয়ে তাকে কেন পরিচয়পত্রটি দেওয়া হচ্ছে না, জানতে চাইলে তাকে বলা হয়েছে, উপদেষ্টা মহোদয় নতুন করে যাচাই-বাছাই করবেন বলে ঘোষণা দেওয়ায় ইস্যুকৃত এমনসব পরিচয়পত্র আটকে রাখা হয়েছে। কিন্তু যেসব মুক্তিযোদ্ধার কাছে এমন পরিচয়পত্র বিলি করা হয়েছে, সেসবের কী হবে বা ইস্যুকৃত পরিচয়পত্রগুলো আটকে রাখার বিষয়ে উপদেষ্টা মহোদয় বা মন্ত্রণালয়ের কোনো নির্দেশনা আছে কিনা তা জানতে চাইলে বলা হয়, ‘না, উপদেষ্টা বা মন্ত্রণালয় থেকে কোনো নির্দেশনা নাই।’ কারও কোনো লিখিত নির্দেশনা না থাকা সত্ত্বেও, এমনকি মন্ত্রণালয়ের কোনো মৌখিক নির্দেশনা না থাকা সত্ত্বেও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যেসব পরিচয়পত্র প্রস্তুত হয়ে রয়েছে, সেসব প্রদানও আটকে রেখেছে। এ অবস্থায় উপদেষ্টা মহোদয় এসব কর্মকর্তা দ্বারা কতদূর কী করতে পারবেন, সে বিষয়টিও ভেবে দেখতে বলব। কেননা এই শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তারাও কিন্তু বর্তমান সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারেন।
বর্তমান সরকারের সদিচ্ছা সম্পর্কে আমাদের কোনোই সন্দেহ নেই এবং জরুরি কিছু ক্ষেত্রে সংস্কারমূলক কাজ তারা করুন, সেটাও আমাদের কাম্য। কিন্তু এমন কিছু করা তাদের উচিত হবে না বলে মনে করি, যেসব কাজে তারা সফলতা পাবেন না। কারণ সংস্কারের ক্ষেত্রেও এমন অনেক কাজ আছে, যেখানে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতা প্রয়োজন। সুতরাং, সেসব কাজ একটি নির্বাচিত সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়াই সমীচীন। পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট ছাড়া কারও পক্ষে সেসব করা সম্ভব নয়। আর ভবিষ্যতে যদি কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসে আবারও জনগণের স্বার্থে তাদের কমিটমেন্ট পালন না করে, সেক্ষেত্রেও তাদের শাস্তি কী হবে, ইতিহাসই তার সাক্ষী।
সবশেষে বলতে চাই, আপাতত আমাদের রাস্তাঘাটে চলাচলের ব্যবস্থা নির্বিঘ্ন করাসহ ন্যূনতম কিছু সংস্কারের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার কাজটিকেই বর্তমান সরকারের সার্থকতা হিসাবে আমরা ধরে নেব। অন্য কোনো বড় কাজে হাত না দিলেও চলবে। কারণ, বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে দেশের ভেতর-বাইরে যেসব চক্রান্ত হচ্ছে এবং হবে, সেসব মোকাবিলা করে খুব বেশিদিন তারা সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারবেন বলে মনে হয় না। অতঃপর দেশের রাজনৈতিক দল বা শক্তিগুলো সেসব চক্রান্ত কতদূর মোকাবিলা করতে পারে, তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট