Logo
Logo
×

বাতায়ন

যে কারণে সাইবার সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে

Icon

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

যে কারণে সাইবার সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে

প্রতীকী ছবি

দেশে সাইবার নিরাপত্তাসংক্রান্ত আইনের অপব্যবহারের বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে সমালোচিত। বিগত সরকারের আমলে সমালোচনার মুখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে এর পরিবর্তে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হয়। তবুও এ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ও সমালোচনা হয়। গণমাধ্যমসহ সুশীল সমাজ ও বিবেকবান জনগোষ্ঠীর কাছে এ আইনের নিরাপত্তাবিষয়ক সংস্কার অতি প্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। অবশেষে এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের মনোযোগ আকর্ষিত হয়েছে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের। আইনটির বিতর্কিত ধারাগুলো পরিহার করে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে একটি সময়োপযোগী আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা সামনে এসেছে। যে কোনো রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জনকল্যাণমুখী ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্র্য। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যুগোপযোগী তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার প্রত্যাশিত। একইসঙ্গে এর অপব্যবহার রোধেও যথাযথ নীতিমালা অবশ্যক। কোনো অসদুদ্দেশ্যে কিংবা হয়রানির জন্য নয়, বরং বাকস্বাধীনতা ও তথ্য অধিকার নিশ্চিতে একটি মানসম্মত আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

অন্যান্য দেশ তাদের ডিজিটাল বলয়কে নিরাপদ রাখতে অনেক আগেই সাইবার সিকিউরিটি আইন পাশ করে নিজ দেশের জননিরাপত্তা নিশ্চিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের আইন বলবৎ আছে। যুক্তরাষ্ট্রেও ‘সাইবার-ল-অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ নামে এই আইন পরিচিত। দেশটিতে ডিজিটাল মাধ্যমে গুজব ছড়ানোর কারণে যদি কারও মৃত্যু হয়, তাহলে সেই অপরাধের শাস্তি হচ্ছে যাবজ্জীবন সাজা, যার মেয়াদ ২০ বছর পর্যন্ত। অনলাইনে মিথ্যা তথ্য প্রতিরোধে ২০২২ সালে ‘সাইবার সিকিউরিটি লজ অ্যান্ড রেগুলেশনস’ নামে আইন পাশ করে ব্রিটেন সরকার। এ আইনের অধীনে ব্রিটেনে সাইবার অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা হয়। ব্রিটিশ প্রভাবশালী গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের তথ্যানুসারে, প্রতিদিন ব্রিটেনে যে সংখ্যক মানুষ গ্রেফতার হয়, তার ৯ শতাংশই হয় ডিজিটাল অপরাধের দায়ে। ২০২২ সালে চীন, ফ্রান্স, ইতালি ও রাশিয়ায় এ ধরনের আইন পাশ হয়েছে। তাছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন ‘সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ নামে একই ধরনের আরও ব্যাপকভিত্তিক আইনের খসড়া প্রস্তাব এবং অস্ট্রেলিয়াও ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারের নতুন দিকনির্দেশনা তৈরির পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা ইউনাইটেড নেশন্স কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ইউএনসিটিএডি) তথ্যমতে, বিশ্বের ১৯৪টি ইউএনসিটিএডি সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে ১৫৬টিই সাইবার নিরাপত্তায় আইন প্রণয়ন করেছে, যার মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত প্রায় ৯১ শতাংশ দেশে সাইবার আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। পিছিয়ে থাকা আফ্রিকার ৭২ শতাংশ দেশে সাইবার আইন সুরক্ষিত আছে। আমেরিকা মহাদেশের ৩৫ দেশের মধ্যে ৩০ দেশে, ইউরোপের ৪৪ দেশের মধ্যে ৪১টিতে, আফ্রিকার ৫৪ দেশের মধ্যে ৩৯টিতে, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৬০টি দেশের মধ্যে ৪৬টিতে, এমনকি এলডিসিভুক্ত ৩২টি দেশেও সাইবার নিরাপত্তা আইন চালু রয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো কোনো দেশে সাইবার আইনের যাচাই-বাছাই, খসড়া তৈরি, কার্যকরকরণের বিভিন্ন পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন।

সচেতন মহলসহ দেশের জনগণ সম্যক অবগত যে, আইনশৃঙ্খলার নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ হিসাবে প্রতিভাত ব্যক্তিগত তথ্য চুরি/হ্যাকিং, ডিজিটাল জালিয়াতি, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অপব্যবহার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানো, ধর্মীয় উগ্রবাদের বিস্তার, জাতিগত বিদ্বেষ প্রচার, গোপনীয় তথ্য পাচার, সাইবার বুলিং, কিশোর-কিশোরীদের বিভিন্নভাবে হয়রানি দমনে তৎকালীন সরকার ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’ প্রণয়ন করে। আইনটি নিয়ে শুরু থেকেই সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো নানামুখী সংশয়-আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছিল। সংস্থাগুলোর ভাষ্য অনুসারে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিপুল সম্প্রসারণের এ যুগে সাইবার নিয়ন্ত্রণে আইন-বিধিবিধানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হলেও এ আইনে এমন কিছু আছে, যা বাকস্বাধীনতার জন্য হুমকিস্বরূপ। সরকারের পক্ষ থেকে আইনের কোনো অপব্যবহার না হওয়ার আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও সংস্থাগুলো তাতে আশ্বস্ত হতে পারেনি। ফলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়কে ধারণ করে চিহ্নিত কিছু ধারা সংশোধনের দাবি উত্থাপিত হয়। এ আইন নিয়ে জাতিসংঘের অধিকারবিষয়ক সংস্থাগুলোও কিছু সুপারিশ করেছে, যার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় বিগত সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন ও পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত, ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ শনাক্ত-প্রতিরোধ-দমন ও এ অপরাধের বিচার এবং আনুতোষিক বিষয়ে নতুন বিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ সংসদে ‘সাইবার নিরাপত্তা বিল-২০২৩’ পাশ হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কার্যক্রম স্থগিত করে আনীত এ বিলে চারটি অজামিনযোগ্য ধারা রাখা হয়। নতুন প্রণয়নকৃত এ আইন নিয়েও বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়। তবে সে আইনে জাতিসংঘের পরামর্শ প্রতিফলিত না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন জাতিসংঘের মুক্তচিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিকাশ-সুরক্ষাবিষয়ক বিশেষ দূত আইরিন জোবাইদা খান।

ছাত্র-জনতার অসাধারণ গণ-অভ্যুত্থানের ফসল অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নিবর্তনমূলক সাইবার নিরাপত্তা আইন সংশোধন-বাতিলের দাবি জানিয়েছেন আইনজ্ঞসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তাদের মতে, বিতর্কের মুখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন গত সরকার বাতিল করলেও সাইবার নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে আগের প্রায় সব কালো আইন বহাল রাখে। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ আইনের অপপ্রয়োগ হয়েছে এবং এখনো এর সুযোগ রয়েছে। সাইবার নিরাপত্তার জন্য আইন করা হলেও অতীতে এটি ব্যবহার করা হয়েছে রাজনৈতিক ভিন্নমত দমনে। ৩০ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে প্রকাশিত আইন মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এবং সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩-এর অধীনে চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত দেশের আটটি সাইবার ট্রাইব্যুনালে ৫ হাজার ৮১৮টি মামলা চলছে। বর্তমানে স্পিচ অফেন্স সম্পর্কিত ১ হাজার ৩৪০টি মামলা চলমান, যার মধ্যে ৪৬১টি মামলা তদন্তাধীন। ৮৭৯টি মামলা দেশের আট সাইবার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। এসব মামলার মধ্যে ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্ত মত প্রকাশের কারণে দায়ের হওয়া মামলাগুলোকে ‘স্পিচ অফেন্স’ এবং কম্পিউটার হ্যাকিং বা অন্য কোনো ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে জালিয়াতিকে ‘কম্পিউটার অফেন্স’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, স্পিচ অফেন্সসম্পর্কিত মামলাগুলোর মধ্যে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের অধীন ২৭৯, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীন ৭৮৬ এবং সাইবার নিরাপত্তা আইনের আওতায় ২৭৫টি মামলা চলমান রয়েছে।

এ পরিপ্রেক্ষিতে বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। গত ৭ নভেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সাইবার নিরাপত্তা আইন (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ-২০২৪-এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের আইনি যাচাই (ভেটিং) শেষে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আবারও তা উপদেষ্টা পরিষদে উপস্থাপন করা হবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ কর্তৃক প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের খসড়ায় আইনটি বাতিলের পরও এর অধীনে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর বিচারে আইনের ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২২, ২৩, ২৭, ৩০, ৩২ ও ৩৫ ধারা বহাল রাখার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। অর্থাৎ ওই ১০টি ধারার অধীনে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর বিচার চলমান থাকবে এবং বাকি ১১টি ধারার মামলাগুলো এমনিতেই বাতিল হয়ে যাবে। খসড়ায় আরও বলা হয়, বহাল ১০টি ধারার অধীনে দায়েরকৃত মামলা সরকার আগেই প্রত্যাহার না করে থাকলে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালে এগুলোর আদেশ, রায় বা শাস্তির বিরুদ্ধে আপিল কার্যক্রম আইনটি রহিত হয়নি ধরে নিয়েই পরিচালিত ও নিষ্পত্তি হবে। ওই ১০টি ধারার অধীনে দায়ের হওয়া যেসব মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে বা মামলা তদন্তাধীন, সেগুলো সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলা বলে গণ্য করা হবে।

সাইবার আইনসংক্রান্ত দেশীয়-আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সার্বিক বিষয় পর্যালোচনায় এটি স্পষ্ট যে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সুরক্ষায়, বিশেষ করে মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় সাইবার সুরক্ষা আইন প্রণয়নের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। কার্যকর প্রগতিশীল সমাজ উন্নয়নের বিভিন্ন অন্তরায় যেমন, গুজব-সন্ত্রাস-প্রচারণা-প্রতারণামূলক সংবাদ পরিবেশন-মিডিয়া ট্রায়াল ইত্যাদি অপরাধ থেকে সমাজকে মুক্ত রাখার জন্য এ আইন হবে একটি মাইলফলক। একই সঙ্গে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, যাতে কোনো হীন ব্যক্তিস্বার্থে কাউকে ফাঁসানোর জন্য হয়রানিমূলক পন্থা অবলম্বন, দুর্নীতির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে অপ্রয়োগের মাধ্যমে এ আইনটি যেন কোনোভাবেই বিতর্কিত না হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে নিগূঢ় যাচাই-বাছাই, পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণ ও যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রকৃত অর্থেই সুসংহত থাকুক, এটিই কাম্য।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম