তরুণ উদ্যোক্তা যেভাবে সফল হতে পারেন
হুমায়ুন ফরিদ
প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
আমাদের দেশে তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এটি আশাব্যঞ্জক, কেননা এ স্পৃহা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। আরও একটা বিশেষ ব্যাপার লক্ষণীয়; বর্তমানে শিক্ষিত যুবকদেরও অনেকে উদ্যোক্তা হতে চাচ্ছেন, যা প্রশংসার দাবিদার। একজন নতুন উদ্যোক্তা নিজে স্বাবলম্বী হচ্ছেন এবং একই সঙ্গে কর্মবাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখছে।
অনেকেই উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করে সফল হয়েছেন, যাদের হয়তো আমরা চিনি। কিন্তু অধিকাংশই ব্যর্থ হয়েছেন, যাদের গল্প আমাদের জানা নেই। সফল উদ্যোক্তাদের কথা শুনলে বোঝা যায় তারা কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সফলতার শীর্ষে পৌঁছেছেন। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, শতকরা ৯০ জন উদ্যোক্তাই ব্যর্থ হন, বাকি মাত্র ১০ শতাংশ সফলতা লাভ করেন। ব্যর্থতার একটা প্রধান কারণ হচ্ছে, যে ব্যবসাটা তারা করছেন, তা পরিচালনা করার পর্যাপ্ত জ্ঞান তাদের নেই অথবা খুব দ্রুত ব্যবসা থেকে সফলতা চাচ্ছেন, যেখানে ধৈর্যের অপ্রতুলতা লক্ষণীয়। পরিসংখ্যান বলছে, সফল ব্যবসার মধ্যে শুধু ১ শতাংশ ইউনিকর্ন ব্যবসায়ী হয়। যেমন-উবার, এয়ারবিএনবিসহ অনেক নব্য ব্র্যান্ড রয়েছে বিশ্বব্যাপী। অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুরু করার প্রথম বছরেই ২০ শতাংশ ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়, ৩০ শতাংশ বন্ধ হয় দ্বিতীয় বছরে, তৃতীয় বছরে বন্ধ হয়ে যায় ৫০ শতাংশ এবং দশম বছরে প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়।
এখন প্রশ্ন হলো, একজন তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে উদ্যোক্তা হতে চাচ্ছেন, নিঃসন্দেহে এটা ভালো একটা লক্ষণ; কিন্তু তারা সঠিক জ্ঞান অর্জন না করেই ব্যবসা শুরু করে দিচ্ছেন। কখনো দেখা যাচ্ছে, কোনোভাবে একটা বড় ধরনের পুঁজি জোগাড় করেছেন অথবা কয়েকজন বন্ধু নিজেদের ছোট ছোট পুঁজি একসঙ্গে করে ব্যবসায় নেমে পড়ছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের ব্যবসার প্রাথমিক ধারণা বা অভিজ্ঞতা কোনোটাই নেই। হুজুগে অন্যদের দেখে উদ্যোগী হয়ে নিজেরাই চেষ্টা শুরু করে দেন। চেষ্টা করা ভালো। কিন্তু সফলতা না আসায় হাল ছেড়ে দিচ্ছেন, এটা আশাব্যঞ্জক নয়।
উদ্যোক্তা বলেন বা করপোরেট বিজনেস হেড, প্রধানত তিনটি বিষয় তাদের মাথায় রাখতে হবে। এগুলো হলো-জ্ঞান, পরিশ্রম ও ভাগ্য। একজন উদ্যোক্তা যে পণ্য বিক্রি করতে চাচ্ছেন, সে পণ্যের ওপর সঠিক ব্যবসায়িক জ্ঞান তার থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, তাকে অনেক পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি। তৃতীয়ত, জ্ঞান আহরণ এবং শ্রম দেওয়ার পরও সফলতা না এলে হাল ছাড়া যাবে না বা ভেঙে পড়া যাবে না, নতুন উদ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। ভাগ্য বলে যে একটা কথা আছে, তা মাথায় রাখতে হবে; সেই সঙ্গে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
এক্ষেত্রে আরও কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। প্রথমত, যে পণ্যটি তিনি বিক্রি করে সফল হতে চাচ্ছেন, সেটি কি তিনি নিজেই কারখানা করে উৎপাদন করতে চাচ্ছেন, নাকি ‘ট্রেডিং ব্যবসা’ অর্থাৎ বিদেশ থেকে আমদানি করে এনে অথবা উৎপাদনকারী কোনো স্থানীয় কোম্পানি থেকে কিনে এনে বাজারজাত করতে চাচ্ছেন। যদি নিজেই উৎপাদন করতে চান, তাহলে প্রথমে বাজারে তার নির্বাচিত পণ্যটির চাহিদা কতটুকু আছে, মানুষের সেই পণ্যের ব্যবহারে আগ্রহ কতখানি, কোন ধরনের মানুষ তার এ পণ্যের ক্রেতা, ভবিষ্যতে এ পণ্যের চাহিদা আরও বাড়ার সম্ভাবনা কতটুকু, কোন কোন প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে একই পণ্য বাজারজাত করছে, আরও কোন কোম্পানি একই পণ্য বাজারে নিয়ে আসার জন্য কাজ করছে-সেসব জানতে হবে। দেশের অঞ্চলভিত্তিক পণ্যের চাহিদা জেনে কোন অঞ্চলে সে প্রথমে ব্যবসা করতে আগ্রহী, তা বিবেচনায় রাখতে হবে। অর্থাৎ উদ্যোক্তাকে প্রথমেই পণ্যটির বাজারজাত সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞান আহরণ করতে হবে।
বাজারের সম্পূরক জ্ঞান থাকার পর আবার পণ্য উৎপাদন এবং একইসঙ্গে তার কাঁচামাল আমদানি ও সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে হবে। মনে রাখতে হবে, পণ্য কেনা অথবা উৎপাদনের সময় যদি ঠকে যান, তাহলে পণ্য বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করা খুব কঠিন কাজ। অর্থাৎ কম মূল্যে কাঁচামাল ক্রয় এবং উৎপাদন ব্যয় কমাতে পারলেই একটি পণ্যের মার্কেটে থাকা অন্যান্য পণ্যের মূল্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবেন, অন্যথায় পণ্যের বেশি মূল্যের কারণে পণ্যটি বাজারে বিক্রি করতে বাধাগ্রস্ত হবেন। তাই ব্যবসা শুরু করার আগেই উৎপাদিত পণ্যের প্রতি কীভাবে গ্রাহকের দৃষ্টি আকর্ষণ করানো যায় এবং দ্রুত গ্রাহকের হাতে পৌঁছানো যায়, সেটা আগেই জেনে কাজে নামতে হবে।
পণ্য বিক্রি না হলে ব্যবসার প্রকৃত সফলতার মাপকাঠি নিরূপণ করা যাবে না। শুধু মূল্য সঠিক হলেই হবে না, কোথায় কোথায় আপনার পণ্যটি বিক্রি করবেন, সে জায়গা নির্ধারণ করতে হবে। যেমন, পণ্যটি পাইকারি মার্কেটে বিক্রি করবেন, নাকি ডিস্ট্রিবিউশনের মাধ্যমে করবেন, নাকি নিজস্ব শোরুম করে তার মাধ্যমে বিক্রি করবেন, সেটা ঠিক করতে হবে। এরপর আপনার পণ্য বা ব্র্যান্ড মানুষের মাঝে পরিচিত করাতে হবে, যার জন্য প্রয়োজন সঠিক প্রচারণা ব্যবস্থা।
দুই ধরনের পণ্য আছে। কিছু পণ্য আছে, যা কি না একজন প্রান্তিক বিক্রেতার ওপর বিক্রি নির্ভর করে। আর কিছু পণ্য আছে, যেগুলোর সম্পর্কে একজন ক্রেতা আগে থেকেই ধারণা নিয়ে কিনতে আসে। যেসব পণ্য একজন প্রান্তিক বিক্রেতার ওপর নির্ভর করে, সেসব পণ্য বিক্রির জন্য ‘ট্রেড অফার’ বা দোকানিকে বেশি লাভ বা অন্যান্য সুবিধা দিয়ে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। আর যেসব পণ্য সরাসরি একজন ক্রেতা পছন্দ করে দোকানে কিনতে আসেন, সেসব পণ্যের ক্ষেত্রে ক্রেতার চাহিদা তৈরি করতে হবে পণ্যের প্রচারণার মাধ্যমে। চতুর্মুখী প্রচারণা চালাতে হবে, যার মধ্যে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান বিশ্ব সমাজব্যবস্থা ডিজিটালনির্ভর। প্রচারেই প্রসার, এ কথাটি সবসময় মাথায় রাখতে হবে। সবসময় নতুন পদ্ধতি খুঁজতে হবে-কী করে ক্রেতার মস্তিষ্কে ব্র্যান্ডের জায়গা দখল করা যায়।
অন্যদিকে, বিক্রয়োত্তর সেবা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। তাই ব্যবসা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে কী করে আপনার গ্রাহককে সেবা প্রদান করবেন, তা নিয়েও পরিকল্পনা থাকতে হবে। ভালো বিক্রয়োত্তর সেবা আপনাকে স্থায়ী গ্রাহক তৈরিতে সহায়তা করবে। আবার একই ভাবে একজন সন্তুষ্ট গ্রাহকের সন্তুষ্টির কথা শুনে আরও নতুন নতুন গ্রাহক তৈরি হবে, যা আপনার ব্যবসার সফলতায় সাহায্য করবে।
শুধু বাংলাদেশে নয়, বর্তমানে সারা বিশ্বেই নতুন প্রজন্ম অনলাইন ব্যবসার দিকে ঝুঁকছে। একটা বড় লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও অনলাইন ব্যবসার একটা বড় বাজার সৃষ্টি হচ্ছে। দেশে বর্তমানে প্রায় ২৫০০ ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম আছে, যার মধ্যে ১ শতাংশ বৃহৎ, ৪ শতাংশ মধ্যম এবং ৯৫ শতাংশ ক্ষুদ্র আকারে ব্যবসা পরিচালনা করছে। দেশে বর্তমানে প্রায় ১২ মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হচ্ছে এ খাতে এবং ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৭ সালের মধ্যে তা প্রায় ২৪ মিলিয়ন ডলারের বাজারে পরিণত হবে; অর্থাৎ দ্বিগুণ ব্যবসা হবে এ খাতে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রচলিত অনলাইন ব্যবসার বাইরে নতুন কিছু নিয়ে হাজির হতে হবে, যা সফলতা এনে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে : আমাদের দেশের মানুষ আসলে কোন ধরনের পণ্য বা সার্ভিস অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে নিতে আগ্রহী এবং কী কী পণ্য বা সার্ভিস এখনো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নেই। নতুন কোনো আইডিয়া আপনাকে সফলতা এনে দিতে পারে, যা প্রকৃতপক্ষে মানুষের কোনো সমস্যার সমাধান এনে দিতে পারে ঘরে বসেই। মানুষ আজকাল প্রায়ই অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে পণ্য বা সার্ভিস নিয়ে প্রতারিত হচ্ছে। কাজেই আপনাকে ক্রেতার আস্থা অর্জন করতে হবে। আর তাহলেই যে কোনো অনলাইন ব্যবসায় পণ্য বিক্রি করে সফলতা অর্জন করা সম্ভব হবে। একটা বিষয় সব সময় মনে রাখতে হবে; ব্যবসায়ী হন বা বড় করপোরেট ব্যক্তিত্ব, প্রথমেই পণ্য বিক্রি করার কৌশল জানতে হবে। আবারও বলছি, পণ্য বা সেবা বিক্রি করতে না পারলে কখনোই প্রকৃত সফলতা আসবে না।
হুমায়ুন ফরিদ : বিজনেস কোচ ও উদ্যোক্তা
humayun.735@gmail.com