নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্যে বিপন্ন মানুষ

এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

চারদিকে নানা অরাজক অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যেন একটি দমবন্ধকর পরিস্থিতি অতিক্রম করছি। অনেকে মনে করেন, পটপরিবর্তকারী একটি রক্তাক্ত আন্দোলনের পর ঘোর কাটতে নাকি একটু সময় লাগে। ফলে সুস্থির সময় আশা করা যায় না। যারা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন, তাদের ক্ষোভ শান্ত হতে একটু দেরি হবে হয়তো। তাই বলে তিন মাসে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে না পারাটা চিন্তার বিষয়। আমার কাছে এর একটি কারণ খুব যৌক্তিক মনে হচ্ছে, তা হলো নানা মতের অনুসারী দেশবাসীর মধ্যে হতাশা বেড়ে যাওয়া। বড় কোনো পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষের মনে স্বপ্ন বাস্তবায়নের আকাঙ্ক্ষা যখন তৈরি হয় এবং ঘোর কাটতেই স্বপ্নভঙ্গ ঘটে, তখন চরম হতাশা থেকে অস্থিরতা বাড়ে।
বড় বড় ‘মাস্টারমাইন্ডরা’ হয়তো কিশোর-তরুণদের মধ্যে আবেগ ছড়িয়ে দিয়ে সেই আবেগের আগুন-শক্তি নিয়ে নিজেদের উদ্দেশ্য সফল করেছেন; কিন্তু মাটির পৃথিবীতে পা রেখে এ সাধারণ ছাত্র-জনতার আশাভঙ্গ হয়েছে। তারা বেদনায় মুষড়ে পড়ছেন-অথবা ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। সাধারণ ছাত্র-জনতার কাছে কে রাজা-মন্ত্রী হলো, এ বিষয়টি বড় ছিল না। তাদের প্রথম আহত করেছে শেখ হাসিনা সরকারের আচরণ। সুযোগ থাকলেও পতিত সরকার ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে সহানুভূতির সঙ্গে দেখেনি। মানুষ দেখেছে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পেটোয়া গুন্ডারা গুলি করে সশস্ত্র আন্দোলনকারীকে হত্যা করেছে। অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছে। এ খুনের হুকুমদাতা হিসাবে তারা ক্ষমা করতে পারবে না শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে।
আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রছায়ায় রাজনীতি ও প্রশাসনের সীমাহীন দুর্নীতি ক্ষুব্ধ করেছে অনেক সাধারণ মানুষকে। তাছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ধ্বংসের (নির্বাচনি ব্যবস্থা) অভিযোগ তো রয়েছেই। এসবে হয়তো ঘৃতাহুতি হয়েছে আন্দোলনে। গুলি করে আন্দোলনকারীদের হত্যা তো ক্ষোভ ও ঘৃণার আগুন ছড়াবেই। এখন সরকারের কার্যকাল যত গড়াচ্ছে আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত না হওয়ায় হতাশ আন্দোলনকারী ও তাদের অভিভাবকদের মনে নানা প্রশ্ন দেখা দেবেই। আজকের লেখায় অন্যান্য দিক নয়, আমি বাজারের অগ্নিমূল্যের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে চাই।
সাধারণ মানুষ ভেবেছিল আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সীমাহীন দুর্নীতির কারণে বাজার চলে গিয়েছিল সিন্ডিকেটের হাতে। ছাত্র-জনতা রক্তমূল্যে হটিয়েছে সেই সরকারকে। এখন ছাত্রশক্তি নিয়ে নতুন সরকার ঝাঁপিয়ে পড়ে দুর্নীতিমুক্ত করবে; বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে খান খান করে ফেলবে। কিন্তু প্রচণ্ড আশাভঙ্গ হলো। সিন্ডিকেট তো ভাঙল না, আরও সক্রিয় হলো। নাভিশ্বাস উঠল সাধারণ মানুষের। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মিছেই দৌড়ঝাঁপ করতে লাগলেন। ফসল ফলল না কোথাও। চাঁদাবাজি কমেছে এ সাক্ষ্য কোনো ব্যবসায়ী দিতে পারছে না। সরকার ডিম, আলু আমদানি করে সম্ভবত তা সিন্ডিকেটের হাতেই তুলে দিয়েছে। কারণ গত সপ্তাহে জাতীয় দৈনিকে দেখলাম সব ধরনের খরচ ও শুল্ক মিটিয়ে আমদানিকৃত প্রতিটি ডিমের দাম পড়ছে সাড়ে সাত টাকার মতো। খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ১৪-১৫ টাকা। আবার আমদানিকৃত আলুর মূল্য দেখানো হচ্ছে প্রতি কেজি ২১ টাকা। এ আলু বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকা। তাহলে বিশাল মুনাফার কোটি কোটি টাকা কোন কোন ঘাটে জমা হলো এ তথ্য কি মানুষ জানতে পেরেছে? এখন পরিসংখ্যান করে দেখার বিষয় মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় আওয়ামী লীগ সরকারকে কতটা হারিয়ে দিচ্ছে বর্তমান সরকার।
বলা হয়ে থাকে মূল্যস্ফীতি সারা পৃথিবীকে কষ্টে ফেলেছে। এ সরকার রাতারাতি পণ্যের দাম কমাবে কেমন করে! কিন্তু যখন দেখা যাচ্ছে, দেশে উৎপাদিত সবজি, মাছ, মাংসের দাম হু হু করে বেড়ে যায়, আমদানি করা ৭ টাকা ৫০ পয়সা মূল্যের একটি ডিম থেকে মুনাফা করা হয় ৭ টাকা আবার আমদানি করা এক কেজি আলু থেকে মুনাফা করা হয় ৪৫-৫০ টাকা, তাহলে এমন পরিসংখ্যানে সরকারের জবাব কী হবে?
বাজারে শাকসবজি, চাল-ডাল, মাছ-মুরগি-কোন পণ্যে হাত দেওয়া যায়? উত্তাপে কোনো ক্রেতার হাতে ফোসকা পড়ে, কারও হাত পুড়ে যায়। হাঁকডাক করে টিসিবি ট্রাকে করে স্বল্পমূল্যে কিছু ভোগ্যপণ্য বিক্রি করে। সংবাদমাধ্যমে ক্রেতার লাইন দেখতে পাই। আমাদের জানতে ইচ্ছে হয়, এদেশের ক্রেতাসাধারণের কত শতাংশ এ সীমিত সুবিধা পান? সংখ্যাটি অতি নগণ্য। দুর্ভাগ্য, নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্যে মানুষের নাভিশ্বাস এ বিষয়টি নিয়ে আমাদের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা মহোদয়ের কাছ থেকে তেমন কিছুই শুনতে পাচ্ছি না!
এর ভয়ংকর পরিণতির কথা আমরা ভাবি না। মধ্যযুগের বাংলায় ইসলাম প্রচারে সুফিরা ব্যাপকভাবে সফল হয়েছিলেন। এর পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেছিল সমকালীন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট। তেরো শতকে মুসলিম শক্তি রাজক্ষমতা দখলের আগেই সুফি-সাধকরা বাংলায় প্রবেশ শুরু করেন। বহিরাগত শাসক সেন বংশীয় রাজারা তখন এ দেশের সাধারণ মানুষকে কোণঠাসা করে রাখার জন্য সমাজে বর্ণ বিভাজন স্পষ্ট করেন। এদের শূদ্র অভিধা দিয়ে সব ধরনের অধিকার বঞ্চিত করে রাখেন। ফলে সামাজিকভাবে তারা যেমন ঘৃণিত হয়ে পড়ে, তেমনিভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিপর্যস্ত হয়ে যায়। দু’বেলা অন্ন তুলে না দিতে পারলেও নানা রকম শাস্তির বিধান রেখে মানুষের জীবন বিপন্ন করে তুলেছিলেন। তাই অপেক্ষাকৃত ভালো আশ্রয়ের আশায় ও আশ্বাসে নিম্ন শ্রেণির হিন্দুদের অনেকে মুসলমান হতে থাকে। ব্রাহ্মণ শাসকরা তা রোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
সমাজ ইতিহাস পর্যালোচনা করে আমাদেরও আশঙ্কা হচ্ছে, বাজারের আগুনে পোড়া মানুষের ক্ষোভের উত্তাপ কোনো না কোনোভাবে প্রকাশিত হবেই। তেমনটি হলে কারও জন্য মঙ্গল হবে না। অভুক্ত মানুষের কাছে বর্তমানের যাতনা অতীতের কষ্ট আড়াল করে ফেলতে পারে সহজেই। নির্বাচন, সংবিধান এসব তাদের কাছে তখন মুখ্য কোনো বিষয় হয়ে দাঁড়াবে না। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে নাকি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসবে, এসব প্রশ্ন জীবন নির্বাহের কষ্টে বিপর্যস্ত মানুষের কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দেবে। আর এ সুযোগটিই গ্রহণ করবে রাজনীতির সুযোগ সন্ধানী নেতা-নেত্রীরা।
আজকে নানা অসন্তোষে পেশাজীবীরা রাস্তায় নামছে। ‘অরাজকতা’ সৃষ্টি করছে। এর সঙ্গে কি যাপিত জীবনের কষ্টের প্রভাব নেই? যে যে জায়গায় পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছে, রাস্তায় অবরোধ সৃষ্টি করছে আর ভাঙচুর করছে; দেখা যাচ্ছে, সেসব অধিকাংশ কারখানার শ্রমিক সময়মতো বেতন-ভাতা পাচ্ছে না। দুর্মূল্যের বাজারে নিশ্চয় তাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে! অটোরিকশা প্রধান সড়কে চলার কথা নয়। সড়ক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার সুযোগে এসব বাহন প্রধান সড়কে উঠে এসেছে। এখন সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে। এরপরই উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন অটোরিকশার চালকরা। চড়াও হচ্ছেন রাজপথে। অটোরিকশা রাজপথ থেকে সরানো যতই যৌক্তিক হোক, মানুষকে বিকল্প উপায়ে জীবন-জীবিকার পথ তো দেখাতে হবে। এদেশে লাখ লাখ পরিবার অটোরিকশা চালক এবং ‘পাঠাও’ ধরনের মোটরবাইকের চালকের আয়ের ওপর নির্ভর করে। এখন এ অগ্নিমূল্যের বাজারে দগ্ধ মানুষ যদি পেশা হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ে, তাহলে চারপাশে তো তারা অন্ধকার দেখবে। এরা তখন যাবে কোথায়! এখনো পর্যন্ত এদের জন্য কোনো বিকল্প পথ দেখায়নি সরকার।
গত ১৭ নভেম্বর একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। অটোরিকশার আঘাতে জীবন হারায় মাত্র ক্লাস করতে আসা প্রথমবর্ষের এক মেধাবী ছাত্রী। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসে অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। হয়তো একটি সমঝোতার ভিত্তিতে আবার চলবে অটোরিকশা। জানলাম প্যাডেল রিকশা অনুমতি পেয়েছে। কিন্তু অসহায় হয়ে পড়েছে অটোরিকশা চালক পরিবারগুলো। তেমন এক মাঝবয়সি চালকের সঙ্গে কথা হলো। তার চারজনের পরিবার। জানলাম, অটোরিকশা ক্যাম্পাসে চালানোর জন্য কর্তৃপক্ষের রেজিস্ট্রেশন প্রয়োজন। তার আগে যোগাযোগ করতে হতো ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে। ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে প্রথম অনুমতি নিতে হতো ছাত্রলীগের কাছ থেকে। আমি যে অটোরিকশা চালকের কথা বলছি তিনি মাত্র চার মাস আগে ঋণ করে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে ছাত্রলীগের ‘ছাড়পত্র’ পেয়েছিলেন। এত দিনে সংসার চালিয়ে ধারের টাকাও শোধ করতে পারেননি। এখন আয়-রোজগার বন্ধ। এ অগ্নিমূল্যের বাজারে পরিজনদের মুখে কীভাবে খাবার তুলে দেবেন? তিনি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন, কিন্তু এখন সমালোচনামুখর সরকারের।
সমাজের ছোট ছোট বিষয়গুলোকেও বিবেচনায় রাখা এখন খুবই প্রয়োজন। সরকারের সঙ্গে ছোট-বড় দেশি-বিদেশি অনেক থিঙ্কট্যাঙ্কের যোগাযোগ নিশ্চয়ই রয়েছে। তাদের বুদ্ধি ও নির্দেশনার প্রতি আস্থা ও ভরসা রেখে সরকারের নিশ্চিন্তে বসে থাকা কল্যাণকর কিছু হবে বলে আমরা মনে করি না। সাধারণ মানুষ দু’ভাবে ক্ষেপে যায়-কৌশলে সাধারণ মানুষকে উসকে দিয়ে খেপানো যায় অথবা সাধারণ মানুষের যাপিতজীবন দুঃসহ হয়ে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে পথে নামে তারা। দ্বিতীয় সমস্যাটি মারাত্মক। আশা করব, সরকারসংশ্লিষ্ট সবাই আলোচিত সমস্যাটির সমাধানে পদক্ষেপ নেবেন।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com