অনলাইন জুয়া রোধে কঠোর আইন জরুরি
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিজ্ঞান আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ- অনেক আগে থেকে চলে আসা এ প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়া মুশকিল। তবে এতটুকু বলা যায়, বিজ্ঞান আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ, তা নির্ভর করে বিজ্ঞানকে কীভাবে ব্যবহার করা হয় তার ওপর। যদি বিজ্ঞানকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানো হয়, তবে তা হবে আশীর্বাদ। আর নেতিবাচকভাবে কাজে লাগালে হবে অভিশাপ। বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
বলা বাহুল্য, বিজ্ঞানের কারণে সার্বিক যোগাযোগসহ অনেক কিছুই এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। তবে বিজ্ঞানকে খারাপ কাজে লাগানো হলে সেই দোষ বিজ্ঞানের নয়, মানুষের। কারণ, মানুষই বিজ্ঞানকে বিপথে পরিচালিত করে। যেমন, অনলাইন জুয়া। অনলাইন জুয়া এবং এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে জানার আগে জুয়া সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। মূলত জুয়া বা বাজি হচ্ছে এমন একটি খেলা, যা লাভ বা লোকসানের মধ্যে ঝুলন্ত থাকে।
জুয়া খেলায় মূলত নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ বা বস্তু (যা পুরস্কার হিসাবে ধার্য করা হয়) নির্ধারণ করা হয়। তারপর কোনো একটি বিষয়ে দুই পক্ষ চুক্তি করে হারজিত নির্ধারণ করে। যে পক্ষ হেরে যায়, সে অপর পক্ষকে সেই নির্ধারিত অর্থ বা বস্তু প্রদান করে। এ খেলায় এই ঝুঁকি নিতে হয়। এবার আসা যাক অনলাইন জুয়ার বিষয়ে। অনলাইন জুয়ায় অনলাইনে অংশগ্রহণ করে নগদ টাকা দিয়ে জুয়া খেলা অথবা গেমের ফলাফল হিসাবে বিভিন্ন পুরস্কার বা নগদ টাকা জেতার সুযোগ পাওয়ার জন্য টাকা-পয়সা বা অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী দিয়ে বা বাজি রেখে ইন্টারনেটে খেলা যায়-এমন গেম খেলতে ব্যবহারকারীকে উৎসাহ দেওয়া হয়।
যেমন- অনলাইন ক্যাসিনো, অনলাইন লটারির টিকিট বা স্ক্র্যাচ কার্ড কেনা, খেলাধুলা সম্পর্কিত বাজি ধরা ইত্যাদি। বিভিন্ন অ্যাপ খুলে চালানো হয় অনলাইন জুয়া, যা খেলা যায় দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা। আর এর ফলে দেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বেকার যুবকসহ অনেকেই অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে এবং একপর্যায়ে নিঃস্ব হয়ে বখে যাচ্ছে। অনেকেই কৌতূহলবশত অনলাইন জুয়া খেলা শুরু করলেও পরে নেশায় পড়ে যাচ্ছে। ঠিক যেমনটি হয় মাদকের ক্ষেত্রে।
সচেতন ব্যক্তিমাত্রই জানেন, জুয়া হচ্ছে এক ধরনের প্রতারণার ফাঁদ। আর এ ফাঁদে পড়ে প্রতিনিয়ত নিঃস্ব হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। একবার এ ফাঁদে পা দিলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে জুয়া তথা অনলাইন জুয়া নিষিদ্ধ হলেও বর্তমানে তা চলছে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সর্বত্র। অনলাইন জুয়ায় মানুষ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জুয়া খেলার টাকা লেনদেন করছে। যে কেউ ইচ্ছা করলেই অতি সহজে মোবাইল বা কম্পিউটারে জুয়া খেলার অ্যাপ দিয়ে ঘরে বসেই অ্যাকাউন্ট খুলে অনলাইনে জুয়া খেলতে পারে। সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য জুয়ার সাইটগুলো কমিশনের ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের এজেন্ট নিয়োগ দিয়ে থাকে।
অনলাইনে বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে জুয়ার ফাঁদ পাতা হয়। লোভ দেখানো হয় একদিনেই বড়লোক হওয়ার। আর এ ফাঁদে যারা পা দিচ্ছে, তারা একপর্যায়ে খোয়াচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। ফলে অনলাইন জুয়ার কারণে বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি, মানসিক বিষণ্নতা, দাম্পত্য কলহ ইত্যাদি। জুয়া খেলার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে অনেকে অপরাধের আশ্রয় নিচ্ছে। ফলে বাড়ছে নানা ধরনের অপরাধ। এদেশে জুয়া নিষিদ্ধ হলেও জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলসহ অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রচারিত হতে দেখা যায়। অনলাইন জুয়াড়িদের একটি চক্র দেশের বাইরে থেকে এসব বিজ্ঞাপনের কার্যক্রম পরিচালনা করে।
প্রতিটি জুয়ার সাইট দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হওয়ায় প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, অনলাইন জুয়ায় এদেশ থেকে বছরে পাচার হচ্ছে ৫০০০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ। ইতঃপূর্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক প্রায় ২০০ জুয়ার ক্ষেত্র শনাক্ত করে সেসব ওয়েবসাইট লিংক বন্ধ করে দেওয়া হলেও অনলাইন জুয়া বেড়েই চলেছে। যেন কিছুতেই এটি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক দেশেই জুয়া খেলা আইনগতভাবে বৈধ হওয়ায় অনলাইনে এর প্রসার ঘটছে। ওয়ার্ল্ড গ্যাম্বলিং মার্কেট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে শুধু অনলাইন জুয়ার বাজারমূল্য ছিল ৬ হাজার ৩৫৩ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২৩ সালে তা প্রায় ১১.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ এ বাজার ঊর্ধ্বমুখী।
বাংলাদেশে ১৯৭২-এর সংবিধানেই জুয়া খেলা নিষিদ্ধ করা হয়। প্রচলিত আইনেও জুয়া খেলা অবৈধ। এ আইন প্রণয়ন করা হয় ১৮৬৭ সালে। অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলে। তবে এ আইনে সাজার পরিমাণ খুব নগণ্য। প্রকাশ্যে সরঞ্জামাদি ব্যবহার করে জুয়া খেলা হলে ১৮৬৭ সালের পাবলিক জুয়া আইনে ব্যবস্থা নেওয়া যায়; কিন্তু অনলাইনে জুয়া খেলা হলে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট অনুযায়ী, যে কোনো ঘর, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসাবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনো সাহায্যকারী তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ রকম কোনো ঘরে তাস, পাশা, কাউন্টার বা যে কোনো সরঞ্জামসহ কোনো ব্যক্তিকে জুয়া খেলারত বা উপস্থিত দেখতে পাওয়া গেলে তিনি এক মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ১০০ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। অর্থাৎ এ আইন শুধু প্রকাশ্য জুয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং এ দণ্ডবিধি বর্তমান সমাজ বাস্তবতার উপযোগী নয়। তাই অনলাইন জুয়া নিয়ন্ত্রণে অতিদ্রুত নতুন আইন প্রণয়ন অপরিহার্য এবং তা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
মাদক ব্যবসায়ীদের মতো জুয়াড়িরাও সমাজ, দেশ, জাতি ও পরিবারের শত্রু। তাই তাদের শক্তির উৎসগুলো শনাক্ত করে সেসব উৎস যে কোনো মূল্যে চিরতরে বন্ধ করা প্রয়োজন। দেশ থেকে জুয়া তথা অনলাইন জুয়া নির্মূলে কঠোরতর আইন প্রণয়ন করাও আবশ্যক। সবাইকে মনে রাখতে হবে, অনলাইন জুয়া এখন দেশের জাতীয় সমস্যায় পরিণত হতে চলেছে, যা সবার জন্যই একটি অশনিসংকেত। এ জুয়া মানুষের অতীব মূল্যবান জীবনকে ধ্বংস করে কর্মশক্তির বড় একটি অংশকে গ্রাস করছে প্রতিনিয়ত। অনলাইন জুয়ায় আসক্ত থাকার কারণে নষ্ট হচ্ছে যুবসমাজের সম্ভাবনাময় শক্তি। জাতি হাঁটছে অন্ধকারের দিকে। তাই দেশ, সমাজ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে কঠোর সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা উচিত। এ জুয়ার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করাও জরুরি। সর্বোপরি অনলাইন জুয়া বন্ধে সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গণমাধ্যম, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, নাগরিক সমাজ, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দলসহ সবার সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রয়োজন এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। মাদকের মতো জুয়া তথা অনলাইন জুয়াকেও ‘না’ বলার বার্তা পৌঁছে দিতে হবে ঘরে ঘরে। যে যুবসমাজের ওপর দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল, আজ তারাই যদি অনলাইন জুয়ার কারণে পথভ্রষ্ট হয়ে যায়, তাহলে দেশ কোন দিকে যাবে, তা সহজেই অনুমেয়। তাই অনলাইন জুয়ার ভয়ংকর অভিশাপ থেকে দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে বর্তমান সরকারসহ সবাইকে আন্তরিকভাবে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় এর পরিণাম ভয়াবহ হতে বাধ্য।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
kekbabu@yahoo.com