Logo
Logo
×

বাতায়ন

আশেপাশে চারপাশে

সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া পারে আমরা কেন পারি না

Icon

চপল বাশার

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া পারে আমরা কেন পারি না

দেশে ডেঙ্গু ভাইরাস কি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে? ডেঙ্গুর উপস্থিতি মেনে নিয়েই কি আমাদের এখানে থাকতে হবে? ডেঙ্গুর প্রকোপ যে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, তাতে এ ধরনের প্রশ্ন আমাদের মনে আসতেই পারে। প্রায় ১৫ বছর বিরতির পর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব আবার শুরু হয় ২০১৮ সালে। সে বছর এ রোগে মারা যায় ২৬ জন, আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১০ হাজারের বেশি। তারপর থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েই চলেছে। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৩ লাখ ২১ হাজারের বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হন। আর মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের। এক বছরে ডেঙ্গুতে প্রাণহানি ও আক্রান্তের সংখ্যা এটাই সর্বোচ্চ।

এ বছরও ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভালো নয়। বছরের এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন প্রায় ৮৫ হাজার রোগী। মৃত্যুর সংখ্যা ৪৩৮। গত বছরের তুলনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা এখনো কম, তবে এ বছর শেষ হতে আরও বাকি। বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যেই হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, আগামী দুই মাস ডেঙ্গু নিয়ে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে।

এমন খারাপ পরিস্থিতির কথা আগে চিন্তাও করা যায়নি। আগে সাধারণত অক্টোবরেই ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে যেত। কিন্তু গত বছর থেকে এ ধারায় পরিবর্তন এসেছে। এবার নভেম্বরেই অনেক প্রাণহানি ঘটেছে। সরকারি সূত্রে বলা হয়েছে, নভেম্বরের প্রথম ২০ দিনেই ১১২ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। গত মাসে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর মোট সংখ্যা ছিল ১৩৫। মৃত্যুর এ ধারা অব্যাহত থাকলে ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ প্রাণহানি আরও অনেক বাড়বে বলে আশঙ্কা।

বর্ষা মৌসুমের শুরুতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হয়, অক্টোবরের শুরুতে এসে কমে যায়। কিন্তু এ ধারা বদলে গেছে। এখন প্রায় সারা বছরই ডেঙ্গুর প্রকোপ লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমনটি হচ্ছে। বৃষ্টির মৌসুম বেড়েছে। ডেঙ্গুর মৌসুমও বিস্তৃত হয়েছে। ডেঙ্গুর ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার প্রজননের সময় ও ক্ষেত্র বেড়ে গেছে বলেই ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার ঘটছে।

প্রাকৃতিক কারণেই এডিস মশার বিস্তার হচ্ছে, ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণও বাড়ছে-এ প্রশ্নে দ্বিমত নেই। কিন্তু ডেঙ্গু ভাইরাসের বিস্তার ও সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্যও কি প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে থাকতে হবে? ডেঙ্গুর প্রকোপকে ভাগ্যের লিখন বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে? বাস্তব পরিস্থিতি সে রকমই মনে হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ তথা কর্তাব্যক্তিরা হাত-পা গুটিয়ে, চোখ-কান বন্ধ করে বসে আছেন বলে মনে হয়। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ বা ধ্বংসের কোনো কার্যকর উদ্যোগ জনগণের কাছে দৃশ্যমান নয়। মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এডিস মশার ঘনত্ব বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, এ বছর এখন পর্যন্ত দেশে সর্বোচ্চসংখ্যক রোগী ভর্তি হয়েছেন ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার হাসপাতালগুলোতে। দুই এলাকার হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তির সংখ্যা ৩২ হাজারের বেশি। করপোরেশন এলাকার বাইরে তৃতীয় সর্বোচ্চ রোগী ভর্তি হয়েছে ঢাকা বিভাগের হাসপাতালগুলোয়। এসব হাসপাতালে ১৫ হাজারের বেশি ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। ঢাকা বিভাগের বাইরে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, সিলেটসহ আরও কয়েকটি জেলা শহরে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে।

রাজধানী ঢাকা ও ঢাকা বিভাগের অন্যত্র ডেঙ্গুর প্রকোপের প্রধান কারণ দুই সিটি করপোরেশন এবং অন্যান্য পৌরসভার নিষ্ক্রিয়তা এবং মশা নিধনে যথাযথ উদ্যোগের অভাব। সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ডগুলোতে মশক নিধনের কার্যক্রম প্রায় বন্ধ অথবা মন্থরগতিতে চলছে। এ কাজে নিয়োজিত কর্মীরা কাজ করছেন ঢিলেঢালাভাবে। ফলে মশক নিধনের কার্যক্রম ফলপ্রসূ হচ্ছে না।

মশা মারার কাজে নিয়োজিত কর্মীদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ফগার মেশিন দিয়ে ধোঁয়া ছড়ানোর, যাতে কোনো মশা বেঁচে থাকতে না পারে। কিন্তু ফগার মেশিনের ধোঁয়ায় মশা মরে কিনা সন্দেহ আছে। ধোঁয়া দিলে মশা উড়ে অন্যত্র যায়, আবার ফিরে আসে। কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে নালা, নর্দমা, ডোবা বা যেসব জায়গায় পানি জমে আছে, সেখানে মশার ওষুধ বা মশার তেল স্প্রে করে ছিটিয়ে দেওয়া। এতে এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস হয়। এ পদ্ধতিকে বলা হয় লার্ভিসাইডিং। কিন্তু এ পদ্ধতিতে কাজ প্রায় বন্ধ অথবা কমে গেছে। ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ তো বাড়বেই। গত বছর ডেঙ্গুর ভয়াবহ পরিস্থিতির পর চলতি বছর ডেঙ্গু প্রতিরোধে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে আশা করা হয়েছিল; কিন্তু তা হয়নি। ফলে এডিস মশার আক্রমণ ও ডেঙ্গুর সংক্রমণ জোরদার হয়েছে আর মানুষ রয়েছে অসহায় অবস্থায়।

ডেঙ্গু থেকে মানুষকে রক্ষা করতে মশক নিধন কার্যক্রম অবশ্যই জোরদার করতে হবে এবং তা চালাতে হবে সারা বছর। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় একসময় ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ ছিল; কিন্তু সুশৃঙ্খল ও কঠোর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশ দুটি থেকে ডেঙ্গু ভাইরাস নির্মূল হয়েছে। দুটি দেশেই ডেঙ্গু প্রতিরোধ অভিযান চলে সারা বছর। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশেও ডেঙ্গু পুরোপুরি নির্মূল না হলেও নিয়ন্ত্রণে আছে।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে কার্যকর ও কড়াকড়ি ব্যবস্থা রয়েছে সিঙ্গাপুরে। এজন্য সেদেশে সারা বছর অভিযান চালানো হয়। মশক নির্মূল কর্মীরা সেখানে রাস্তাঘাট, পার্ক, এমনকি প্রতিটি বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখেন কোথাও পানি জমে আছে কিনা। যদি কোথাও দেখা যায়, এমনভাবে পানি জমে আছে যে সেখানে মশা জন্ম নিতে পারে, তাহলে বাড়ির মালিক, ভাড়াটে বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে মোটা অঙ্কের জরিমানা করা হয়। এ কারণে সিঙ্গাপুরে সবাই সতর্ক থাকেন, নিজ বাড়ি বা আঙিনার কোথাও মশা জন্মানোর মতো পানি জমতে দেন না। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও ডেঙ্গু নির্মূলে জনগণের সচেতনতা বজায় রাখার জন্য প্রচার অভিযান চালিয়ে থাকেন সারা বছর। একইসঙ্গে চলে মশার ওষুধ ছিটানোর কাজ।

মালয়েশিয়ার রাজধানী ও অন্যান্য শহরাঞ্চলেও মশক নিধন ও ডেঙ্গু নির্মূলে সারা বছর অভিযান চলে। সিঙ্গাপুরের তুলনায় মালয়েশিয়া অনেক বড় দেশ। অতীতে সেখানে এডিস মশার উপদ্রব ও ডেঙ্গু সংক্রমণ অনেক বেশি ছিল। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর ঘটনাও কম ছিল না। সিঙ্গাপুরের মতো কড়াকড়ি ব্যবস্থা নিয়ে মালয়েশিয়া ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।

সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশ ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে আমরা পারব না কেন? কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হলে মশক নিধন ও ডেঙ্গু নির্মূল অসম্ভব কোনো কাজ নয়। ডেঙ্গু নির্মূলকে অগ্রাধিকার দিয়ে সমন্বিত কার্যক্রম চালানো হলে এ সংকটের সমাধান অবশ্যই সম্ভব।

চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক

basharbd@gmail.com

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম