Logo
Logo
×

বাতায়ন

কেন বিলুপ্তির পথে যৌথ পরিবার

Icon

ড. মো. রফিকুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কেন বিলুপ্তির পথে যৌথ পরিবার

মানবসমাজের সূচনাকাল থেকে আজ অবধি পরিবারপ্রথা চালু রয়েছে। বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে একসময় যৌথ পরিবার বেশি থাকলেও দিনদিন তা হ্রাস পাচ্ছে। এর মূলে আমাদের স্বাভাবিক মন-মানসিকতার অভাব কাজ করছে কি না, এটিও এক প্রশ্ন। দিনদিন মানুষের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটছে। পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যৌথ পরিবার কেন কমছে, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। কালের বিবর্তনে যৌথ পরিবার বিলীন হলে সমাজে এর কী প্রভাব পড়বে, তা এখনই ভাবতে হবে। যৌথ পরিবার বিলীন হওয়ার প্রধান কারণ পরিবারিক কলহ এবং সম্পত্তি নিয়ে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিরোধ। বস্তুত পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নানা দ্বন্দ্বের কারণেই যৌথ পরিবার বিভক্ত হচ্ছে। সমাজে নিজ স্বার্থের কারণে অন্যের যে কোনো ধরনের ক্ষতি করতে কেউ কেউ আপন-পর কাউকে পরোয়া করে না। এক্ষেত্রে কেউ কেউ সামাজিক সম্পর্ক নামক বিষয়টির কথা একবারও চিন্তা করছে না। তাই জীবনযুদ্ধে হেরে গিয়ে বেশির ভাগ স্বামী-স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে গড়ে তোলে ছোট্ট পরিবার। আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতার কারণেও গ্রাম-শহরে একক পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। তাছাড়া চলতি শতাব্দীতে পরিবারের বাইরে কর্মসংস্থান, গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন-এসব কারণেও দেশে যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। অর্থাৎ জীবন ও জীবিকার তাগিদে দিনদিন ছোট হচ্ছে পরিবারের আকার। সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করা, পারিবারিক বন্ধন দুর্বল, ভবিষ্যৎ সঞ্চয়, চাকরি, ব্যবসাসহ নানা কারণে বাড়ছে একক পরিবারের সংখ্যা-এমনটাও মনে করছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। বেশি বয়সে বিয়ে হওয়া, নারীদের বেশি বয়সে মা হওয়া, কোনো কোনো দম্পতির কম সন্তান নিতে পছন্দ প্রভৃতি কারণেও দেশে বাড়ছে একক পরিবারের সংখ্যা। সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে মূল্যবোধ, সেই সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে সমাজের অনুশাসন।

অতীতে যৌথ পরিবারগুলোয় সবাই নিজেদের স্বার্থ পরিত্যাগ করে বছরের পর বছর একসঙ্গে বসবাস করতে কোনোরকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না। সেই সময়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দাদা-দাদি ও চাচা-চাচিদের কাছেই সন্তানরা বড় হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ভিন্ন চিত্র লক্ষ করা যাচ্ছে। এখন যৌথ পরিবার থেকে বেরিয়ে আসা চাকরিজীবী মা-বাবা তাদের সন্তানদের কাজের লোক কিংবা চাইল্ড কেয়ারে রেখে বড় করছেন। এতে কোমলমতি শিশু বাবা-মা এবং অভিভাবকের আদর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অর্থাৎ চাকরির কারণে অনেকে তাদের সন্তান এবং মা-বাবাকেও সময় দিতে পারছে না। এমনকি অনেকেই বৃদ্ধ মা-বাবাকেও পর্যন্ত ওল্ড হোমে রেখে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। বর্তমানে যৌথ পরিবার বিভক্ত হওয়ার পেছনে নগরায়ণেরও একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশে বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো অনেক দর্শকের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এ প্রবণতার কারণে দেশীয় সংস্কৃতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব চ্যানেলে এমন অনুষ্ঠানও প্রচার করা হয়, যা যৌথ পরিবারগুলো বিভক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। আমাদের মনে আছে, এ চ্যানেলগুলো যখন ছিল না, তখন আমাদের দেশের পরিবারগুলোর সদস্যদের মধ্যে আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা ছিল। আমাদের দাদা-বাবা সেই আমলে দুঃখ-দুর্দশার মধ্যেও বছরের পর বছর যেভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে যৌথ পরিবারগুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করতেন; এখন সেরকম আন্তরিকতা অনুপস্থিত। এখন সবাই যার যার স্বার্থে ব্যস্ত।

অনেকে মনে করেন, যৌথ পরিবার থেকে আলাদা হলেই জীবনব্যবস্থা আরও উন্নত হবে। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। বর্তমান সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় ও যৌথ পরিবার বিলুপ্তির ফলে শিশু-কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া বড়দের প্রতি সম্মানবোধ ক্রমেই কমছে। বিশেষ করে নিজেদের চিন্তাধারা ও মতামতের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণে যৌথ পরিবার বিভক্ত হচ্ছে। ফলে পারিবারিক বন্ধন দিনদিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। পরিবারগুলোর ভঙ্গুরতার কারণে অনেক তরুণ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এতে পারস্পরিক সহযোগিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অভাব ঘটছে। ইউনিসেফ বলছে, গত কয়েক দশকের যে কোনো সংকটের চেয়ে কোভিড মহামারি বিশ্বব্যাপী শৈশবকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। অর্থাৎ মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব ও অপব্যবহার থেকে শুরু করে শিক্ষায় ব্যাঘাত শিশুর মনোজগতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। সম্ভবত পারিবারিক কাঠামোতেও এর প্রভাব পড়েছে-যৌথ পারিবারিক কাঠামো ভেঙে একক পরিবারের মধ্যেই মানুষ স্বস্তি খুঁজছে। কিন্তু সত্যিই কি মিলছে স্বস্তি? এমন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সহজ কোনো উত্তরও মিলছে না।

উল্লেখ্য, অন্যান্য দেশের চেয়ে আমাদের দেশে পারিবারিক বন্ধন অত্যন্ত সুদৃঢ়। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এ বন্ধন ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে যাচ্ছে; একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে ছোট হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে প্রবীণরা আরও বেশি একাকিত্বের যন্ত্রণা ও অবহেলার শিকার হচ্ছেন। এশিয়ার সবচেয়ে ধনী দেশ জাপানে প্রবীণদের আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। এ প্রবণতা যাতে আমাদের মধ্যে বিস্তৃত না হয়, সেদিকে সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। অনেক গবেষক বলেছেন, আর্থসামাজিক উন্নতি, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ, নগরায়ণ, শিল্পায়ন, শিক্ষার প্রসার ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের পরিণতিতে যৌথ পরিবারের পরিবর্তে একক পরিবারের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। এ বিষয়ে একজন সমাজবিজ্ঞানী বলেছেন, ভারত ও বাংলাদেশে এখন অনেকে যৌথ পরিবারে বসবাস করার পেছনে পারিবারিক ব্যবসা ও চাকরি বা পেশায় নারীদের অপেক্ষাকৃত কম অংশগ্রহণ বড় ভূমিকা রাখছে।

বর্তমানে নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে পরিবার পরিচালনা করা খুবই কষ্টদায়ক হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে একক পরিবারের পরিবর্তে যৌথ পরিবারের প্রতি বহু মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। যৌথ পরিবারের ঐক্য ধরে রাখার জন্য পরিবারের সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ থাকা অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া শিশুকে কাজের লোক কিংবা চাইল্ড কেয়ারে না রেখে দাদা-দাদি বা নানা-নানির সান্নিধ্যে রাখা জরুরি। এতে শিশু অতীত জীবন ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারবে; যা তাদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে আমাদের দেশের ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে বিদেশি চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার না করাই উত্তম। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বস্তুত যৌথ পরিবার শিক্ষার একটি বড় জায়গা। তাই এ একান্নবর্তী পরিবার নামক প্রথাকে ফিরিয়ে আনতে হলে আমাদের জীবনযাপনের কিছু রীতিনীতিরও পরিবর্তন আনতে হবে। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব, হানাহানি, হিংসাবিদ্বেষ-সবকিছু ভুলে নিজেদের স্বার্থে যৌথ পরিবারে বসবাস করাই শ্রেয়। এর জন্য প্রথমে আমাদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। তবেই পরিবারের যৌথ কাঠামো এ সামাজিক ও নৈতিক বন্ধন আরও দৃঢ় হবে। বিশেষ করে যৌথ পরিবারে একসঙ্গে খাওয়ার মতো অসাধারণ ব্যাপারগুলো আবার ফিরে আসুক-এটাই আমজনতার সময়ের দাবি। সমাজ ও দেশের উন্নয়নে আদর্শ মানুষ তৈরি করতে হবে। আদর্শ মানুষ তৈরির শিক্ষাটা শুরু করতে হবে পরিবার থেকেই। সমাজ ও দেশের স্বার্থে যৌথ পরিবারের প্রতি গুরুত্ব বাড়াতে হবে।

ড. মো. রফিকুল ইসলাম : গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম