মোসাহেবরা আরও বেশি ক্ষতিকর
গাজী মিজানুর রহমান
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মোসাহেবদের কাজ হচ্ছে ক্ষমতাবান ব্যক্তিকে বোঝানো যে, তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক অথবা প্রশাসক, সর্বশ্রেষ্ঠ গণতান্ত্রিক নেতা এবং মানুষের কাছে সর্বোত্তম প্রিয় ব্যক্তিত্ব। নেতা অথবা প্রশাসক ‘হ্যাঁ’ করলে মোসাহেবরা তার কথা লুফে নিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করে বলে, আপনাকে কষ্ট করে বলতে হবে না, আমরা বাকিটা বলে দিচ্ছি। বিনিময়ে ওপর থেকে নিচের দিকে স্নেহসুধা বর্ষিত হয়। তা পেয়ে মোসাহেবদের প্রাপ্তির ক্ষুধা যেমন আরও বাড়ে, তেমনি পদস্থ ব্যক্তিরও প্রশংসায় ভাসতে আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। মোসাহেবরা সবসময় তাদের নেতা অথবা উপরস্থ কর্তৃপক্ষ যা শুনলে খুশি হবে, সেই কথা বলে এবং তার কাছে সত্য কথা গোপন করে। এভাবে বাস্তবতা থেকে ক্ষমতাবান ব্যক্তিকে দূরে রেখে তার ও তার প্রতিষ্ঠানের সর্বনাশ করা হয়।
মোসাহেবি মূলত রাজতন্ত্র আমলের সৃষ্ট আপদ। রাজা-বাদশাহরা দরবারে মোসাহেব রাখতেন। ওদের কাজ ছিল দরবারের সভাসদদের বিনোদন দেওয়া। বিদূষক, বান্দা, ভাঁড়-এসব অভিধায় ভূষিত মোসাহেবদের মূল দায়িত্ব ছিল রাজদরবারে মনোরঞ্জন দেওয়ার জন্য রাজার পাশে পাশে থাকা। সেকালের রাজা-বাদশা ছিলেন সার্বভৌম ব্যক্তি সত্তা। কাজ করার জন্য তাদের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী বাহিনী থাকত, যারা একটু এদিক-ওদিক করলে গর্দান চলে যেত। তাই ওদেরকে কাজের দায়িত্ব দিয়ে রাজার অঢেল সময় ছিল মোসাহেবি উপভোগ করার। রাজা বীরবল সম্রাট আকবরকে শহরের কাকের সংখ্যার কৌশলী হিসাব হাজির করলে তিনি আনন্দ পেতেন। এ বিনোদনে শরিক হতো রাজসভার লোকরা-সেনাপতি বা প্রধান বিচারপতিরা। কিন্তু দরবার যখন বিচারের, দরবার যখন যুদ্ধ ঘোষণার, সেখানে ভাঁড়ামির কোনো স্থান থাকত না। সেখানে আকবর এবং তার নবরত্ন সভা ভিন্ন চরিত্রের এক সভাকক্ষ হয়ে যেত। অন্যথায় এত সুবৃহৎ হিন্দুস্তান শাসন করা তার পক্ষে সম্ভব হতো না। কিন্তু সুশাসক না হলে মন থেকে সময়ের এ বিভাজন মুছে যায়। কাজের সময় রঙ্গ এসে হাজির হয়।
রাজতন্ত্রের পর একনায়কতন্ত্র মোসাহেবিকে আনুষ্ঠানিক গাম্ভীর্য দান করে। একনায়কের কাজ হচ্ছে ক্ষমতা তার নিজের কাছে কুক্ষিগত রাখা, বিরুদ্ধবাদীকে নির্মূল করা এবং আমিত্বের সলতে জ্বেলে তার আলোয় অন্যদের দেখানো যে, একনায়ক কত মহান। এ শাসনব্যবস্থায় যেহেতু আইনি কাঠামোর মধ্যেই একজনের সর্বেসর্বা হওয়ার স্বীকৃতি রয়েছে, তাই আমিত্বের সলতেকে যত উসকে দেওয়া যায়, ততই লাভ। অনুচর-অনুসারীদের রাখাই হয় একনায়কের গুণকীর্তন করার জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের ফ্যাসিস্ট কায়দার ধনতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে দেশে জন্ম নেওয়া সামরিক একনায়কতন্ত্র মোসাহেবি জন্ম দেওয়ার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মতো সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আধুনিক রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাও মোসাহেবির জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে রাজনৈতিক মোসাহেবি জন্ম নেয়, তা সূক্ষ্ম এবং সবচেয়ে ভয়াবহ। এর কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি থাকে না, কিন্তু তলে-তলে মোসাহেবতন্ত্র যখন জেঁকে বসে, তখন তা দুধারী তলোয়ারের মতো বিধ্বংসী রূপ ধারণ করে। দল ক্ষমতায় থাকলে মোসাহেবরা রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা পেয়ে দম্ভ করে বলেন, তাদের দলই সেরা। কী গণতন্ত্র চর্চায়, কী আন্দোলনের ক্ষমতা দেখানোতে-সবক্ষেত্রে তারাই হচ্ছে আদর্শ। তারা হেঁয়ালিপূর্ণ ঠাট্টা মশকরা করে বিরোধী অবস্থানের মানুষকে খাটো করে কথা বলেন। এসবের উদ্দেশ্য উচ্চপর্যায়ের নেতাকে বোঝানো যে, বিরোধী অবস্থানের মানুষের কোনো ধর্তব্য শক্তিসামর্থ্য নেই, ওদের অধিকার ক্ষুণ্ন করলেও ওরা কিছু করতে পারবে না। এর ফলে দেশ রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের দিকে চলে যায়। দলের শীর্ষ পর্যায়ের মানুষরা মোসাহেবির কুয়াশা ভেদ করে আলোর বাস্তবতার কাছে পৌঁছতে পারে না। কিন্তু সত্য হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রে হেঁয়ালি করে প্রতিপক্ষের প্রতি ছুঁড়ে দেওয়া কথাগুলো ভাগ্যের পরিহাস (আয়রনি) হয়ে মোসাহেবদের জীবনে সত্য হয়ে দেখা দেয়। এভাবে পালা করে মোসাহেবি গণতন্ত্রের কাঁধে সওয়ার হয়।
হাল আমলের মোসাহেবির গণতন্ত্রকে একটু ভিন্ন পথে চলতে হয়। মোসাহেবি যেহেতু এখানে স্বীকৃত নয়, তাই এখানে ব্যক্তিপূজা করাটা অন্যের চোখে দৃষ্টিকটু লাগে। ফলে মোসাহেবি কায়েম করার জন্য একটি ছদ্মব্যবস্থা বলবৎ করতে হয়। এখানে মোসাহেব এবং মোসাহেবির লক্ষ্যস্থল নেতা বা নেত্রী কিছু কল্পিত বাস্তবতা হাজির করেন, যা গণতন্ত্রের সঙ্গে ছদ্মবেশে ঢুকে পড়ে। সেগুলো চাটুকারদের বানানো শব্দভান্ডার বা মিথ দ্বারা পরিপুষ্ট হয়। এগুলো প্রতিষ্ঠান-প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আত্ম-অহংকারকে উজ্জীবিত করে। এ অহংকার উসকে দেওয়া গোষ্ঠী হচ্ছে-স্বার্থসিদ্ধির জন্য তৎপর রাজনীতির অধঃস্তন সদস্যরা, সুবিধাভোগী আমলাতন্ত্র, পেশাজীবী বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠনের নেতা ইত্যাদি। এরা বেছে বেছে সেসব কথা বলেন, যা নেতা বা প্রতিষ্ঠান-প্রধানের অতিপ্রিয়। বিষয়বস্তু যা-ই থাকুক না কেন, সেই প্রিয় বিষয় নিয়ে আসেন বর্ণিত মোসাহেব-বাহিনী। উদ্দেশ্য, বাহবা দেওয়ার সঙ্গে বাহবা পাওয়া, সুবিধা আদায় করা। গণমানুষের নেতা, জনতার হৃদয়ের মণি, আপসহীন নেতা, জননেতা, স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী, চেতনার আলোকবর্তিকা ইত্যাদি শব্দরাজি এ মোসাহেব বাহিনীর মোক্ষম অস্ত্র হিসাবে কাজ করে।
ইংল্যান্ডের রাজা চতুর্থ হেনরির পুত্র যুবরাজ ‘হল্’ যখন পঞ্চম হেনরি হিসাবে সিংহাসনে বসেননি, তখন তিনি দায়িত্বহীন উড়নচন্ডি স্বভাবের কৌতুকপ্রিয় এক যুবক। তার বিদূষক দোসর ছিলেন এক বৃদ্ধ নাইট, নাম জন ফলস্টাফ। যুবরাজ ‘হল্’ যখন পঞ্চম হেনরি হিসাবে ইংল্যান্ডের রাজা হয়ে সিংহাসনে বসলেন, তখন তার এককালের বন্ধু ফলস্টাফ আকাশচুম্বি উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে দরবারে হাজির হলেন। সেকালের ফলস্টাফ হচ্ছেন এখনকার টেন্ডারবাজ, মাদক ব্যবসায়ী, টাকা পাচারকারী, স্টক মার্কেট সাফা করা নানা চরিত্র, যারা আর কিছু না পারুক, মোসাহেবি বিদ্যায় সিদ্ধহস্ত। কিন্তু আগের যুবরাজ ‘হল্’ যেদিন রাজা পঞ্চম হেনরি হলেন, তখন তিনি বদলে যাওয়া মানুষ-জনগণের অভিভাবক, দেশের শাসক। ফলস্টাফকে পাত্তা দিলে তো তার রাজ্যশাসন চলবে না, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। সময়ের প্রয়োজনে তাই তিনি ফলস্টাফকে নির্বাসন দিলেন, কুস্বভাবের ভাঁড়কে ঝেড়ে ফেললেন।
আমাদের সমাজে ভাঁড়ের বা বিদূষকের প্রাধান্য কালে কালে সর্বব্যাপী হয়েছে। সবাই আমরা শিখে গেছি, কী করে মনোরঞ্জন করে আখের গোছানো যায়। নাজিম, সুবাদার, দেওয়ান, ফৌজদার, কাজী, মনসবদার, বকশী, কোটাল, শেঠ-সবাই মোটামুটি মোসাহেবিতে দক্ষ হয়ে উঠেছি। রাজা আসে রাজা যায়, কিন্তু বীরবল এবং গোপালদের জয়জয়কার চলতেই থাকে। ওরা হাসাতে পারে, সেই ফাঁকে নিজের কথাটাও বলতে পারে। কিন্তু হাসিও বেশি হলে যে শরীরের জন্য ক্ষতির হয়, সময় নষ্ট হয়, ভাবগম্ভীর পরিবেশের অঙ্গহানি ঘটে, এটা মনে রাখা দরকার। মোসাহেবি দায়িত্ববানকে ভাবানোর সময় না দিয়ে তার অবচেতন মনে আমিত্বের বীজ রোপণ করে। সব পেশা থেকে এই মোসাহেবি বাণিজ্য দূরীভূত না হলে সব রকমের অগ্রগতি ব্যাহত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।
গাজী মিজানুর রহমান : সাবেক যুগ্মসচিব ও লেখক