জলবায়ু সম্মেলনে কী পেল বাংলাদেশ?
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সবুজ বিশ্ব গড়ার লক্ষ্য নিয়ে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত হলো জাতিসংঘের ২৯তম জলবায়ু সম্মেলন কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ (কপ)। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্রতিবছর কপ সম্মেলনের মাধ্যমে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এ সম্মেলনে রাষ্ট্রপ্রধান, বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা ও নীতিনির্ধারকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। এ বছর এ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ফ্রান্সের রাষ্ট্রপ্রধানরা অনুপস্থিত ছিলেন। যদিও এ সম্মেলনের প্রধান কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিজ্ঞানীদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতার বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন ৪৩ শতাংশ কমাতে হবে। নতুবা ক্রমান্বয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা নাকচ করে দেওয়া যায় না। প্যারিস চুক্তিটি বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণের জন্য সমগ্র বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্ক হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। ফলে ২০২০ সাল থেকে প্রতিটি দেশ তাদের জাতীয় জলবায়ু কর্মসূচি পরিকল্পনা অনুযায়ী রিপোর্ট দাখিল করে যাচ্ছে। এ প্যারিস চুক্তিতে উল্লিখিত প্রতিটি দেশের ‘ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কনট্রিবিউশনস’ অনুযায়ী গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন আগের তুলনায় কী পরিমাণ কমেছে, তার একটি সুস্পষ্ট রিপোর্ট দাখিল করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। মোটা দাগে বলা যেতে পারে, প্যারিস চুক্তিটির জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। যদিও ধনী দেশগুলোর এ চুক্তির প্রতি আগ্রহ কম। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসাবে রিপাবলিকান দলের নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি তার আগের নীতি পরিবর্তন করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করবেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব ক্রমাগত বাড়ছে। উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বিশ্বের ছোট ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলোও ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বহু দেশে অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে গড়ে ৪৫ থেকে ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা পরিমাপ করা হয়েছে। এ তাপমাত্রা মানুষ ও অন্যান্য জীবের বসবাসের প্রায় অনুপযোগী। এক্ষেত্রে কৃষি ফসলও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। প্রতিটি ফসলের উৎপাদনের জন্য নির্দিষ্ট মাত্রায় তাপমাত্রার প্রয়োজন। যদি অনাকাঙ্ক্ষিত হারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, তাহলে ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এক দশকে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার আগের দশকের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। এছাড়া ২০২৩ ও ২৪ সালকেও উষ্ণ বছর হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে তাপমাত্রার বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। এভাবে যদি তাপমাত্রা বাড়তে থাকে, তাহলে ক্ষতির প্রভাবও বাড়বে। তাপমাত্রার বৃদ্ধির ফলে গত দশকে পৃথিবীর চারপাশে বরফের পরিমাণ কমে বছরে ৪ দশমিক ৫ মিলিমিটার হারে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিক তথ্যে আরও দেখা যাচ্ছে, গ্রিনল্যান্ড ও অ্যান্টার্কটিকার প্রায় ৩৮ শতাংশ বরফ কমে গেছে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে গ্রিনহাউজ গ্যাসের অবদান রয়েছে। সমগ্র বিশ্বে গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে। ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী বছরে ৫৭ দশমিক ৪ গিগাটন গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হচ্ছে। অন্যদিকে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী বৈশ্বিক উষ্ণতার বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু তাপমাত্রা যদি এভাবে বাড়তে থাকে, তাহলে বৈশ্বিক উষ্ণতা ভবিষ্যতে ২ দশমিক ৫ ডিগ্রি থেকে ২ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সুতরাং প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে হলে ২০৩০ সালের মধ্য বায়ুমণ্ডলে প্রায় ৪৩ শতাংশ গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন কমাতে হবে। গ্রিনহাউজ গ্যাসের মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বিগত শিল্পযুগের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যদি তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে হয়, তাহলে বায়ুমণ্ডলে প্রায় ২৪ গিগাটন গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন কমাতে হবে। ২০৪০ সালের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে তেল ও গ্যাসের উৎপাদন কমাতে হবে। নতুবা বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের বৃদ্ধি ঠেকানো সম্ভব হবে না।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণ বাড়ছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বছরে খরায় প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার, সাইক্লোন ও ঝড়ে ৫ লাখ ৭৭ হাজার ২৩২, বন্যায় ৫৮ হাজার ৭০০ এবং উচ্চ তাপমাত্রায় প্রায় ৫৫ হাজার ৭৩৬ জন মানুষ মারা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনে সমগ্র বিশ্বে প্রায় ৪০ শতাংশ ভূমির উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে লবণাক্ততা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। মোটা দাগে বলা যায়, ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বাড়তে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়াও পানি অ্যাসিডিক হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। সেক্ষেত্রে পানিতে বিদ্যমান জলজপ্রাণী ও উদ্ভিদের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা নাকচ করে দেওয়া যায় না। প্রতিটি জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর নির্দিষ্ট তাপমাত্রার পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জীববৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে। ইতোমধ্যেই অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আবার অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্ত হওয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশে খাদ্য উৎপাদন কমে খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ভবিষ্যতে করোনার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত রোগের প্রার্দুভাব বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগে দারিদ্র্য হারও বাড়ছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনে বছরে প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ অন্যত্র স্থানান্তরিত হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়তেই থাকবে। সেক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট ক্ষতির প্রভাব কমানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। একদিকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতির প্রভাবে সমগ্র পৃথিবী উদ্বিগ্ন।
বাকুতে অনুষ্ঠিত কপ২৯ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিকর দেশগুলো কী পেল, সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অতীতে জলবায়ু সম্মেলনগুলোতে প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়নে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো, উন্নত দেশগুলোর প্রযুক্তি উদ্ভাবনে আর্থিক সহায়তা, হাইব্রিড গাড়ির ব্যবহার বাড়ানো, স্বল্পমূল্যে উন্নয়নশীল দেশে জলবায়ু সহনশীল প্রযুক্তি স্থানান্তর ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাজেট নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। যদিও বাস্তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা অনেকটা কঠিন, তবুও এ প্রভাব কমানোর জন্য অভিযোজন ক্ষমতা বাড়ানোর দিকে বেশি নজর দেওয়া উচিত। এজন্য ক্লাইমেট ফাইন্যান্সের গুরুত্ব অপরিসীম। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সম্প্র্রতি বাংলাদেশে বন্যা, লবণাক্ততা, খরা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতিকর প্রভাব লক্ষণীয়।
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ একটি ক্লাইমেট ভালনারেবল দেশ। এক্ষেত্রে অভিযোজন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য অর্থের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট বন্যার পানির প্রবাহ বাড়ানোর জন্য স্থানীয় নদীগুলোর নাব্য বৃদ্ধিতে বিপুল অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন। গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ কমানোর জন্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনেও অর্থের প্রয়োজন। অতীতে কপ সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে, তা বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দরিদ্র ও ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অনেক বেশি হওয়ায় এসব দেশে জলবায়ু সহনশীল পরিবেশের উন্নয়নের মাধ্যমে অভিযোজন ক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ অভিযোজন ক্ষমতা বাড়াতে হলে কপ সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়ন জরুরি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি ও স্বাস্থ্যঝুঁকির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সমগ্র বিশ্বকে রক্ষার জন্য অভিযোজনের বিকল্প নেই। সেজন্য ক্লাইমেট ফাইন্যান্স নিয়ে একটি বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। কপ২৯-এ গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তব প্রয়োগই জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাংলাদেশসহ অরক্ষিত দেশগুলোকে রক্ষা করতে পারে।
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম : অধ্যাপক, এনভাইরনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
mohammad.alam@wsu.edu