অশান্ত বাজারে অন্তর্বর্তী সরকার
হাসান মামুন
প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
আলুর দাম আরও বেড়েছে। পেঁয়াজের দাম বাড়ার প্রবণতা ছিলই। হালে এর দামও নতুন করে বেড়েছে। দাম বৃদ্ধির প্রবণতা রোধের চেষ্টা যে নেই, তা নয়। অন্তর্বর্তী সরকার কর-শুল্ক কমিয়ে এগুলোর আমদানি বাড়াতে চাইছে ঘাটতি মেটাতে। তবে বাজারে এর প্রভাব নেই বললেই চলে।
টানা অনেক বছর আলু আমদানি করতে হয়নি আমাদের। এটা বরং ছিল রপ্তানিপণ্য। বিগত সরকার আমলের শেষদিক থেকে আবার করতে হচ্ছে আলু আমদানি। ডিম আমদানিও করতে হয় তখন। বর্তমান সরকার আমলেও মাঝে ডিমের দাম অনেক বাড়ায় নতুন করে শুরু করতে হয় আমদানি। এক্ষেত্রেও কমানো হয় শুল্ক। ডিমের দাম কমে আগের জায়গায় এসেছে এর মধ্যে। কিন্তু বেড়েছে অন্য দুই নিত্যব্যবহার্য পণ্য আলু ও পেঁয়াজের দাম। করাচি থেকে সরাসরি যে জাহাজ এসেছিল, তাতেও কিছু কনটেইনারে এসেছে আলু ও পেঁয়াজ। স্থলবন্দর দিয়েও আমদানি অব্যাহত। সেক্ষেত্রে আমদানি হচ্ছে ভারত থেকে। এ আমদানিটা আমাদের জন্য বিশেষ সুবিধাজনক। তবে ভারতেও পেঁয়াজ, আলুর মতো কৃষিপণ্যের দাম সম্প্রতি বেড়েছে। বিশেষ করে পেঁয়াজের দাম লাফিয়ে বেড়েছে মাত্র কদিনে। এ প্রবণতা সেদেশটির বাজারেও উপস্থিত। ওখানে অতিবৃষ্টিতে পেঁয়াজ, আলুর মতো ফসলের চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বাজারে। ভারতে পেঁয়াজের দাম এ মুহূর্তে পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অথচ কমাস আগেই তারা পণ্যটি রপ্তানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছিল। এতে খুশি হয়েছিলাম আমরা। এখন মন খারাপ হচ্ছে ভারতে পেঁয়াজের দাম বাড়ায়। ওখানে আলুর দামও বাড়ছে। এ অবস্থায় অন্য কোনো উৎস থেকে আলু এনে বাজার শান্ত করা যাবে কি?
দেশের হিমাগারগুলোয় আলুর মজুত এখন কম। সময়মতো নতুন আলু বাজারে এসে গেলে অবশ্য তেমন সমস্যা হতো না। এখানেও অতিবৃষ্টিতে আলু ও পেঁয়াজের ‘আগাম ফলন’ বিঘ্নিত। অপেক্ষাকৃত উঁচু অঞ্চলে যেটুকু আবাদ হয়েছিল, সেখান থেকে কিছু আলু এলেও তা খুবই অপর্যাপ্ত। দামও স্বভাবতই বেশি। নতুন আলুর কেজি কোথাও কোথাও ৪০০ টাকা বলে মাঝে খবর হয়েছিল। সেটা ঠিক হলেও নিতান্ত বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কোনো কোনো অঞ্চলে কেশুর ও মিষ্টি আলুর কেজিপ্রতি দাম ৫০০ টাকা বলেও খবর মিলছে। নবান্নের উপকরণ হিসাবে এগুলোর এক ধরনের চাহিদা রয়েছে বৈকি। দাম অনেক বলে এর বিক্রিও নিশ্চয় কম। এটা অর্থনীতির মূলধারার বাইরের ঘটনাও বটে। তবে এ খবর উদ্বেগজনক যে, বিভিন্ন অঞ্চলে বীজ আলুর সংকট সৃষ্টি হয়েছে এবং এর দামও অনেক বেড়েছে। বীজ আলু রান্নাঘরে চলে যাওয়ায় এর ঘাটতি বেড়েছে বলে খবর মিলছিল। খাদ্যপণ্য হিসাবে সংরক্ষিত আলুর দাম হঠাৎ বাড়লে বীজ আলু রান্নাঘরে চলে আসতে পারে বৈকি। এখন আবার খাদ্যপণ্য হিসাবে রাখা আলুকে বীজ হিসাবে ব্যবহারের প্রবণতা বাড়লে বাজারে এর সরবরাহ কমবে। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা এসব দিকে হয়তো যথোচিত দৃষ্টি দিতে পারেননি। এটা তো ঠিক, একটা নজিরবিহীন অস্থির সময়ে তারা দায়িত্ব নিয়েছিলেন। স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত প্রশাসনেও চলছে অস্থিরতা। এখন যেভাবেই হোক, বীজ আলুর সংকট হতে দেওয়া যাবে না। তাহলে পরবর্তী উৎপাদন বিঘ্নিত হয়ে আলুর দাম আরও বাড়বে।
পেঁয়াজের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার দিকেও দিতে হবে দৃষ্টি। এক্ষেত্রে বীজ সংকটের কথা শোনা না গেলেও উপকরণের কোনোরকম ঘাটতি যেন না হয়। আলু ও পেঁয়াজে ভালো দাম মিলছে বলে চাষিদের উৎসাহ থাকবে এগুলোর উৎপাদনে। অন্য কৃষিপণ্যের বদলে তারা এগুলোর আবাদে বেশি মনোযোগী হতে পারেন। এতে আবার অতি উৎপাদনের সংকট সৃষ্টি হয়ে দাম কমে যাবে কি না, সে প্রশ্নও তোলা যেতে পারে। তবে সাম্প্রতিককালে আলুর মতো পণ্য আমদানি করতে হওয়ায় মনে হচ্ছে পরিস্থিতি এখন ভিন্ন। গেল বছর আলু উৎপাদনের তথ্য নিয়ে কৃষি বিভাগ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে তীব্র মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল। কৃষি বিভাগ বরাবরই চায় উৎপাদন বৃদ্ধিতে বড় সাফল্য দেখাতে। সরকারও উন্নয়নের বয়ান বেশি বেশি প্রচার করায় ওই কাজে তাদের উৎসাহ বেড়েছিল। এতে আলুর ক্ষেত্রে ঘটে যায় সর্বনাশ। উৎপাদনের বড় ঘাটতি আড়াল হওয়ায় এর দাম বাড়ে অনেক। এখন আসলে চলছে সেটারই এক ধরনের জের। বাজারে যাওয়া খুব কমসংখ্যক মানুষই অবশ্য এসব খতিয়ে দেখতে চাইবে। তারা সাদা চোখে দেখবে, উচ্চস্তরে থাকা আলুর দাম নতুন করে বেড়েছে! এর সঙ্গে আবার চালের দাম তুলনা করে দেখা হয় সাধারণত। দেখা যাচ্ছে, আলুর বর্ধিত দাম মানসম্মত চালের দামকেও গেছে ছাড়িয়ে।
মাঝে চালের দামেও দেখা গেল ঊর্ধ্বগতি। বিগত অর্থবছরে চাল আমদানি হয়নি বলা চলে। দাবি করা হচ্ছিল, চালে কোনো সরবরাহ সংকট নেই। বাস্তবে সংকট হয়তো ছিল তখনও। যে দেশে জনসংখ্যা কমিয়ে দেখানো হচ্ছে বলে জোর অভিযোগ রয়েছে, সেখানে কোনো পণ্যের চাহিদার হিসাব কি গ্রহণযোগ্য? বিগত সরকার আমলেও কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন কিছু চাল আমদানি করে রাখার কথা। কারণ, টানা তাপপ্রবাহে বোরো উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল। সরকার এতে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু তাদের সময়ও চালের বাজারে চলছিল অস্থিরতা। চলতি বছরের শুরুতে সবশেষ ভুয়া নির্বাচনের সময়টায় এর দাম বাড়লে শুরু হয় চালকল মালিকদের ওপর হম্বিতম্বি। ওঠে সিন্ডিকেটবাজির মুখস্থ অভিযোগ। এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের সময় কয়েক দফা বন্যা হয়ে গেছে দেশে। তাতে আউশ ও আমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বৈকি। মাঝে সবজি ও ডিমের দাম অনেক বেড়ে গিয়ে যে একটা অস্থিরতা সৃষ্টি হলো, তারও বড় কারণ ছিল বন্যা। এতে মাছ, মুরগির সরবরাহও কমে যায়। নিম্ন-আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে আমিষের প্রধান উৎস ডিম ও ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়ে গেলে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, সেটা সহজেই অনুমেয়। দেশে তারাই তো সংখ্যাগুরু।
পরিস্থিতি খুব প্রতিকূল হয়ে গেলে সব সরকারই চেষ্টা করে ভর্তুকি দামে পণ্যসামগ্রী সরবরাহের ব্যবস্থাটি জোরালো করতে। হালে আমরা দেখছি চাল-ডালের পাশাপাশি মাংস, পেঁয়াজ ও সবজির মতো পচনশীল দ্রব্যও সরকারিভাবে জোগানোর চেষ্টা করতে। তবে এসব কার্যক্রম রাজধানী ও বন্দরনগরীর মতো শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ। আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকায় এ কার্যক্রম জোরদার করা কঠিনও বটে। বিগত শাসনামলে চালু এক কোটি ‘ফ্যামিলি কার্ড’ নিয়ে আবার দেখা দিয়েছে সংকট। বহু লোক যে জালিয়াতি করে কার্ড নিয়েছে, সেটা তখনও জানা যাচ্ছিল। বর্তমান সরকার তা চিহ্নিতকরণের উদ্যোগ নেওয়ায় বিপুলসংখ্যক কার্ড গেছে আটকে। বাছবিচার শেষে সত্যিকারের দাবিদারদের এখন এ কার্যক্রমে যুক্ত করতে হবে। ওএমএসে যে চাল ও আটা জোগানো হয়, তাতেও কি দুর্নীতি হচ্ছে না? তবে খেয়াল রাখতে হবে, দুর্নীতি বন্ধ করতে গিয়ে এমন কঠিন সময়ে যেন আবার দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের রক্ষার কার্যক্রম ঝুলে না পড়ে। তাতে সাধারণ মানুষের জীবনে ন্যূনতম স্বস্তি জোগানোর কাজটিও পড়ে যাবে সংকটে।
সরকার একের পর এক খাদ্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিয়ে কম রাজস্ব হারাচ্ছে না। এদিকে আবার খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিতে বাড়াতে হচ্ছে ব্যয়। বিভিন্ন খাতে বিগত সরকারের রেখে যাওয়া বিপুল দায়দেনাও মেটাতে হচ্ছে। বকেয়া বিল মিটিয়ে সার ও ডিজেল সরবরাহ রাখতে হচ্ছে স্বাভাবিক। বিদ্যুতের একটা অংশ হচ্ছে আমদানি। এলএনজিও আনতে হচ্ছে। গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার সঙ্গে সার কারখানা সচল রাখার সম্পর্ক রয়েছে। এর সঙ্গে আছে কৃষি উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার যোগ। সামনে প্রধান খাদ্যশস্য মৌসুম বোরো। আর এটা হলো উপকরণনির্ভর। সরকারের সামনে মৌসুমটি এক বড় চ্যালেঞ্জ তাই। আগামের পর আলু, পেঁয়াজের মূল মৌসুমেও সংকট তৈরি হতে দেওয়া যাবে না। তাতে এসব ক্ষেত্রে বাড়বে আমদানিনির্ভরতা। আমাদের আমদানি সক্ষমতা যে বেশি, তা তো নয়। রিজার্ভ ও ডলার বাজার আগেকার চেয়ে ভালো হলেও এখনো স্বস্তিকর নয়। এ অবস্থায় আলুর মতো নতুন নতুন কৃষিপণ্যে আমদানিনির্ভরতা যাতে না বাড়ে, সেদিকে রাখতে হবে সতর্কদৃষ্টি। সেক্ষেত্রে উৎপাদনে জোর দেওয়ার বিকল্প নেই।
চালে ‘টেকসই স্বয়ংসম্পূর্ণতা’ যেন অর্জিত হয়, সে পদক্ষেপ নিতে হবে। আখ, তেলবীজ ও গম উৎপাদনে আমরা খুব এগোতে পারব না। মসলা (পেঁয়াজ বাদে) উৎপাদনেও দ্রুত এগোনো কঠিন। এসব ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভরতা থেকেই যাবে ধরে নিয়ে সে পথটি বরং নির্বিঘ্ন রাখতে হবে। এ সময়ে আবার সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম বেড়েছে বিশ্ববাজারে। এর প্রভাব পড়েছে দেশে। চালের মতো ভোজ্যতেলের শুল্ক পুরোপুরি তুলে দিয়ে হলেও এর বাজার শান্ত করার উদ্যোগ হয়তো নিতে হবে। এসব পণ্যের বাজারে স্বল্পসংখ্যক উদ্যোক্তার নিয়ন্ত্রণ থাকায় চেষ্টা করতে হবে-‘অতিরিক্ত মুনাফা’ শিকারের সুযোগ যেন কেউ না পায়। রাজনৈতিক কারণে কিছু ব্যবসায়ী ভোগ্যপণ্য ব্যবসায় হঠাৎ অনুপস্থিত বলেও খবর মিলছে। এর বড় প্রভাব যেন ‘সাপ্লাই চেইনে’ না পড়ে, সেদিকে রাখতে হবে দৃষ্টি। অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা হয়তো জরুরি ইস্যু নয়; কিন্তু পণ্যবাজার অস্থির এবং এ কারণে মানুষ সমালোচনামুখর থাকলে তাদের পক্ষে মন লাগিয়ে কাজ করে যাওয়া কঠিন হবে। ‘অত্যাবশ্যকীয় সংস্কারে’ও তখন কমে যেতে পারে খোদ সরকারের উৎসাহ। সেটা কাম্য নয় বলেও পণ্যবাজার শান্ত করে আনার ব্যাপারে তাদের সিরিয়াস থাকতে হবে। অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে শুরুর কমাসে এ কাজে শৈথিল্য থাকলেও সেটা দূর করতে হবে দ্রুত। আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় এক্ষেত্রে জরুরি। এক মন্ত্রণালয়ের কারণে আরেক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, এমনসব দিকেও রাখতে হবে দৃষ্টি। সমন্বয়ের একটা পাকা ব্যবস্থাও করতে হবে।
হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক