Logo
Logo
×

বাতায়ন

যাদের জন্য সংস্কার, তাদের মতামতও দরকার

Icon

ড. আলা উদ্দিন

প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

যাদের জন্য সংস্কার, তাদের মতামতও দরকার

সংগৃহীত

গত ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, যারা দীর্ঘদিনের একদলীয় শাসনের চক্র থেকে দেশকে মুক্ত করার প্রত্যয়ে বিভিন্ন সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল এমন একটি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে জনগণের মতামত, অংশগ্রহণ ও অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। ইতোমধ্যে সরকার গঠনের তিন মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত জনসাধারণের প্রত্যাশা ও গৃহীত বিভিন্ন সংস্কার প্রক্রিয়ায় তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায়, অনেকের মধ্যে প্রশ্ন ও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় এ সংস্কারগুলো সত্যিকার অর্থে সফল ও কার্যকর করতে হলে যাদের জন্য এ পরিবর্তন, সেই জনগণের সক্রিয় মতামত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। জনগণ আশা হারাতে চান না। কারণ, এবার যদি তারা নিরাশ হন, তবে জনগণের ক্ষমতা, জনবান্ধব সরকার ও জনকল্যাণমুখী দেশগঠনের সুযোগ আবার আসবে কি না, কিংবা কবে আসবে, তা নিয়ে জনমনে গভীর সংশয় রয়েছে। তাই, অন্তর্ভুক্তিমূলক সফলতার কোনো বিকল্প নেই।

প্রতিটি সফল সংস্কারের মূলে থাকে জনগণের কল্যাণ ও তাদের জীবনমান উন্নয়নের উদ্দেশ্য। অন্তর্বর্তী সরকারও সেই লক্ষ্যে সমাজের বৈষম্য দূরীকরণ, অর্থনৈতিক অসমতা হ্রাস এবং সুশাসনের ভিত মজবুত করার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। কিন্তু সমস্যাটি হলো, এ সংস্কারের উদ্যোগগুলোর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ধরন জনগণের সঙ্গে আশানুরূপভাবে সংযুক্ত নয়। অর্থাৎ সংস্কারের প্রধান লক্ষ্যভুক্ত মানুষের মতামত ও তাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া সংস্কারের ফল সাধারণ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। তাছাড়া নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত ভবিষ্যতের সংস্কার, জনগণের কাছে খুব বেশি চিত্তাকর্ষক নয়। বিষয়টিকে সব সংস্কারের পূর্বশর্ত হিসাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন।

সবার অংশগ্রহণ একটি কার্যকর ও টেকসই সংস্কার প্রক্রিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। জনগণের মতামত ও অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো নীতি বা আইন শুধু সরকার বা একটি ক্ষুদ্র অংশের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে প্রণীত হলে তা বাস্তব জীবনে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। জনগণের অংশগ্রহণ সংস্কার প্রক্রিয়াকে বাস্তবসম্মত ও সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত করে তোলে। যখন জনগণ নিজেরাই তাদের সমস্যার সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারে, তখন তারা সংস্কার প্রক্রিয়াকে নিজেদের উদ্যোগ হিসাবে অনুভব করে। এ অনুভূতি সংস্কারের সফলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো এলাকার পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য নতুন আইন প্রণীত হয়, তবে সেই এলাকার মানুষের মতামত ও অংশগ্রহণ সেই আইনটি কার্যকর করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আইনটি প্রণয়ন করা হলে তারা তখন আইনটির প্রতি দায়িত্বশীল মনোভাব নিয়ে এটি বাস্তবায়নে সহায়তা করে। এভাবে জনগণের অংশগ্রহণ সংস্কারের প্রতি তাদের সমর্থন ও সহযোগিতাকে দৃঢ় করে। ফলে সংস্কারটি দীর্ঘমেয়াদে টেকসই ও জনগণের জন্য উপকারী হতে পারে।

সংস্কার প্রক্রিয়ায় জনসাধারণের অংশগ্রহণে যেসব বাধা রয়েছে, তা দূর করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, জনগণের মধ্যে শাসনব্যবস্থার ওপর আস্থাহীনতা একটি বড় কারণ। যখন পূর্ববর্তী সংস্কার ও উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি পূরণ হয় না, তখন মানুষের মনে সংশয় সৃষ্টি হয়, ফলে তারা নতুন উদ্যোগে সাড়া দিতে চায় না। দ্বিতীয়ত, অনেক মানুষ মনে করেন, তাদের মতামত বা অংশগ্রহণ সরকারের সিদ্ধান্তে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না, ফলে অংশগ্রহণে তাদের আগ্রহ কমে যায়। তৃতীয়ত, গ্রাম ও শহরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনেকেরই মতামত-উচ্চশ্রেণি বা প্রভাবশালী মহলে তাদের বিষয়টি অবহেলিত হয়, যা অংশগ্রহণের প্রতি অনীহা সৃষ্টি করে। এ পরিস্থিতিতে, একটি সমন্বিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কার প্রক্রিয়া গড়ে তোলার মাধ্যমে এ জনগোষ্ঠীগুলোকে সম্পৃক্ত করার জন্য প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি, আস্থার পুনর্গঠন ও সবার আওয়াজ শোনার একটি সমান সুযোগ সৃষ্টি করা।

অংশগ্রহণমূলক সংস্কারকে কার্যকর ও টেকসই করতে জনগণের মতামত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপায় গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রথমত, জনমত সংগ্রহ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। বিভিন্ন মাধ্যম, যেমন: জনমত জরিপ, স্থানীয় বৈঠক কিংবা মতবিনিময় সভার মাধ্যমে জনগণের মতামত সংগ্রহ করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজন সম্পর্কে সরকার অবগত হতে পারে, যা ভবিষ্যতের নীতিমালা তৈরিতে সহায়ক হয়। এ প্রক্রিয়াগুলো জনগণকে প্রস্তাবিত সংস্কারের অংশ হিসাবে অভিজ্ঞতা ও মতামত প্রকাশের সুযোগ দেয় এবং নীতিমালা গ্রহণযোগ্য করে তোলে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা। স্থানীয় প্রতিনিধিরা জনগণের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করতে পারেন এবং বিভিন্ন সংগঠন সংস্কারের মূলধারায় জনসাধারণকে অন্তর্ভুক্ত করতে সহায়তা করতে পারেন। এতে জনগণ তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ পাবে এবং সংস্কারের প্রক্রিয়ায় নিজেকে দায়িত্বশীল মনে করবে। জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ প্রক্রিয়ার প্রতি তাদের আস্থা ও সমর্থন বাড়াবে, যা সফল সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয়।

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা অংশগ্রহণমূলক সংস্কারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। জনগণকে সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পর্কে যথাযথ তথ্য প্রদান করে, তাদের আস্থা অর্জন করা সম্ভব। জনগণের কাছে প্রক্রিয়ার তথ্য উন্মুক্ত রাখা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা হলে তারা বুঝতে পারে সংস্কার কীভাবে তাদের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। স্বচ্ছতার মাধ্যমে জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পায় এবং তারা সংস্কারে ইতিবাচকভাবে সাড়া দেয়। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য। এ ধরনের কর্মসূচি জনগণকে সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন করে এবং তাদের সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করে। তারা সংস্কারের লক্ষ্য ও প্রভাব সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করে, যা সংস্কারের দীর্ঘমেয়াদি সফলতা নিশ্চিত করতে সহায়ক।

সফল সংস্কার কেবল কিছু পরিবর্তন আনাই নয়, বরং এটি জনগণের জীবনমানের উন্নতি ও তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে সফল হিসাবে বিবেচিত হয়। একটি কার্যকর সংস্কার জনগণের চাহিদার প্রতিফলন ঘটায় এবং তাদের জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত হয়। যখন সংস্কার পরিকল্পনা জনগণের মতামত ও প্রত্যাশার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়, তখন জনগণ তাদের জীবনে পরিবর্তন ও উন্নতি দেখতে পায় এবং সংস্কারের সুফল নিজেরাই অনুভব করতে পারে।

এভাবে জনগণের সম্পৃক্ততা ও মনোবল বৃদ্ধি পায় এবং তারা সংস্কার প্রক্রিয়াকে নিজেদের উদ্যোগ হিসাবে মনে করতে শুরু করে। এ অংশগ্রহণমূলক অনুভূতি, জনগণের মধ্যে দায়িত্ববোধ ও সমাজে ইতিবাচক অবদান রাখার আগ্রহ জাগিয়ে তোলে। একে কেন্দ্র করে মানুষ নিজেদের জীবনের পরিবর্তন ও উন্নয়ন দেখতে পায়, যা আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং সামাজিক নিরাপত্তা ও গর্বিত অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। সফল সংস্কার প্রক্রিয়া তাই শুধু নীতি বাস্তবায়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি সমাজের উন্নয়নের মাইলফলক এবং জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক সুদৃঢ় করার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায়।

সংস্কার প্রক্রিয়ায় জনগণের মতামত না থাকা বেশকিছু ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। যদি এ সংস্কার শুধু উপরের স্তরে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে জনগণের সঙ্গে সরকার ও প্রশাসনের সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া সংস্কারের প্রকৃত লক্ষ্য অর্জন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। কোনো সংস্কার উদ্যোগ যদি জনগণের অভিজ্ঞতা, প্রত্যাশা ও চাহিদার প্রতিফলন না ঘটায়, তবে সেটি কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল দিতে ব্যর্থ হয়। অধিকন্তু, যদি সরকার একতরফাভাবে সংস্কারকাজ করে, তবে জনগণের মনে প্রক্রিয়াটির উদ্দেশ্যের ব্যাপারে সন্দেহের জন্ম দিতে পারে। জনগণ ভাবতে পারে, সংস্কারের লক্ষ্য তাদের কল্যাণের জন্য নয়, বরং অন্য কোনো উদ্দেশ্যে। এর ফলে জনগণ সংস্কার প্রক্রিয়ায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে, যা ভবিষ্যতে এ উদ্যোগগুলোর সাফল্যকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে জনগণের অবিশ্বাস ও আগ্রহের অভাব, সংস্কার প্রক্রিয়াকে ধীরগতি বা ভঙ্গুর করে তুলতে পারে, যা দেশের উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

‘যাদের জন্য সংস্কার, তাদের মতামতও দরকার’-এ কথা মাথায় রেখে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত সংস্কার উদ্যোগগুলোয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। অনলাইনভিত্তিক অংশগ্রহণ বর্তমান সমাজ কাঠামোয় খুব বেশি কার্যকর পন্থা নয়; অনলাইনে মানুষের মনের কথা প্রকাশ থেকে দূরে থাকার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে সংগত কারণে। তাছাড়া অনলাইনে অল্পসংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করেন। স্থানীয় নেতা, বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী প্রমুখের মাধ্যমে নানা উপায়ে স্থানীয় পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয় পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। শুধু অংশগ্রহণ বা মতামত গ্রহণ নয়, সংস্কারে মতামতের প্রতিফলনও নিশ্চিত করতে হবে।

সঠিকভাবে অংশগ্রহণমূলক সংস্কার না হলে সেই সংস্কারের প্রকৃত উদ্দেশ্য সফল হওয়া কঠিন এবং জনগণের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব আরও বাড়তে পারে। সংস্কারগুলোকে কেবল একটি নীতি পরিবর্তন হিসাবে না দেখে, জনগণের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার একটি সুযোগ হিসাবেই বিবেচনা করা উচিত। জনগণের অংশগ্রহণ ও মতামতের যথাযথ মর্যাদা দিলে, সংস্কারগুলো তাদের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে ও ভবিষ্যতের জন্য একটি টেকসই সমাধান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

ড. আলা উদ্দিন : অধ্যাপক ও সাবেক সভাপতি, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম