বাংলাদেশ এখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। প্রতিদিনই নিত্যনতুন ঘটনা নতুন সংবাদের জন্ম দিচ্ছে। অনেক ঘটনা আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় তাৎক্ষণিকভাবে শেষ হয়ে গেছে; কিন্তু সেগুলোর ফলাফল সুদূরপ্রসারী। এসব ঘটনা মানুষের মনের আয়নাঘরকে উন্মোচিত করেছে। এমন কিছু ঘটনা এখানে তুলে ধরা হলো।
মব জাস্টিস : আমাদের মনের আয়নাঘর
মব জাস্টিস বাংলাদেশে নতুন নয়। রাস্তাঘাটে অনেক দেখেছি, পকেটমার বা ডাকাত বলে একজনকে সবাই মিলে মারছে। এমনও দেখেছি, মব-মারের জটলায় লোকজন হুড়াহুড়ি করে এসে সবার দেখাদেখি লাথি মারলেন, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে ভাই? মব জাস্টিসে অংশগ্রহণ যেন আমাদের নাগরিক দায়িত্ব! আমরা আয়নায় নিজেদের দিকে তাকালে দেখব, আমাদের মনের মাঝেই একেকটা আয়নাঘর! যারা এ মব-মারে অংশগ্রহণ করেন, তাদের বেশিরভাগ আত্মসমর্থনের জন্য বলেন, আমি তো মাত্র একটা লাথি দিয়েছিলাম, লোকটাকে মেরে ফেলার মতো এমন কোনো আঘাত করিনি।
একটা লোকের মৃত্যুর জন্য বিশটা লোকের একটা করে লাথি বা দশটা লোকের একটা করে লাঠির আঘাতই যথেষ্ট। কী নিষ্ঠুর! কেউ কি ভেবে দেখেছেন লোকটা নির্দোষও হতে পারেন! ভেবে দেখেছেন, ছোটখাটো অনিচ্ছাকৃত অপরাধের জন্য আপনি এবং আমিও মব-মারের শিকার হতে পারি? রাস্তার কিনারায় প্রস্রাব করা, কোনো নারীর দিকে অভদ্রভাবে তাকানো, রিকশাওয়ালার সঙ্গে ভাড়া নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি, গাড়ি-রিকশা ধাক্কা লাগা, সড়ক দুর্ঘটনা-এসব বিষয় অনেক সময় অবাঞ্ছিত ঘটনার জন্ম দেয় এবং যে কেউই এগুলো থেকে মব জাস্টিসের শিকার হতে পারেন। মব-মারের সময় ইচ্ছা থাকলেও কেউই মার খাওয়া লোকটাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন না। যে বাঁচাতে চাইবে, তাকেও হয়তো সহযোগী চিহ্নিত করে মারতে থাকবে।
সম্প্রতি ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি মব-মারের ঘটনা ঘটেছে। আশার কথা হলো, এ দুটি ঘটনা নিয়ে সর্বস্তরের মানুষ উচ্চস্বরে প্রতিবাদ করেছে এবং দুই দিনের মধ্যেই দোষীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। দোষীদের দল-মত ও পদবি কোনো বিবেচনায় আনা হয়নি। এক সময় তদন্তের নামে এসব ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হতো।
দীপু মনিকে যখন আদালতে আনা হয়, তখন আইনজীবীরা তার ফাঁসি চেয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। যখন আদালতে তোলা হয়, তখন কয়েকজন লোক ও আইনজীবী দীপু মনিকে চড়-থাপ্পড় মারেন। এদিকে যখন আমির হোসেন আমুর রিমান্ড শুনানি শুরু হয়, তার আইনজীবীকে মারধর করে আদালত থেকে বের করে দেওয়া হয়। শুধু এ দুজন নন, অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতা, যাদের আদালতে আনা হয়েছে, তাদের কারও কারও ভাগ্যে জুটছে একই বিড়ম্বনা।
যখন বিচার হবে, আমি নিশ্চিত, দীপু মনি এবং আমির হোসেন আমু অনেক দোষে দোষী হবেন ও শাস্তি পাবেন। কিন্তু তারা যখন রাষ্ট্রীয় হেফাজতে এবং আদালতের আঙ্গিনায়, তখন তাদের বা তাদের আইনজীবীর ওপর হামলা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ও গর্হিত কাজ। যেসব লোক এর সঙ্গে জড়িত, অবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
স্বৈরাচারকে বিদায় করা হয়েছে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য, আইনকে নিজের হাতে নেওয়ার জন্য নয়। যখন একজন আইনজীবী আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেন, তখন তাকে তার রাজনৈতিক পরিচয় ভুলে শুধু পেশাগত পরিচয় অনুযায়ী আচরণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আইনজীবীরা হলেন দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার একটা স্তম্ভ।
সাদা-নীল উপাচার্য
একজন তরুণ যখন জানে, তার বাবার ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তখন সে কী করে? তার আগে আমরা জেনে নিই, রাতুল নামের একজন তরুণ কী করেছেন। বাবা পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবিএম ওবায়দুল ইসলামের সম্ভাব্য এ নিয়োগের বিরোধিতা করেছেন তারই ছেলে রাফিউল ইসলাম রাতুল। কেন? বিএনপি নেতা, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ভূতপূর্ব অধ্যাপক ড. আবদুল মঈন খানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করলে কেমন হবে? কিংবা ড. রেজা কিবরিয়া? তিনি রাজনৈতিক দল গণঅধিকার পরিষদের নেতা, একজন অক্সফোর্ড গ্র্যাজুয়েট এবং নামকরা অর্থনীতিবিদ। আমি জানি, সবাই হাত নেড়ে ‘না না’ বলছেন। রাজনীতিকদের কেউ উপাচার্য হিসাবে দেখতে চায় না। তাহলে রাতুল চাইবেন কেন? অনেকেই রাতুলের সমালোচনা করেছেন বাবার বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য।
রাতুল বলেছেন, ‘দাবিটা খুবই সহজ, রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস চাই। যিনি গবেষণা ছেড়ে রাজনীতিতে নেমেছেন এবং বিএনপির মূলধারার রাজনীতির অন্যতম সক্রিয় নেতা, তাকে ভিসি হিসাবে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত অচৌকশ।’
রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস চাওয়া অবশ্যই অন্যায় কিছু নয়। গত পঁচিশ বছরের ভূতপূর্ব উপাচার্যদের কার্যকলাপ আবার যদি আমরা ফিরে দেখি, দেখব তারা সাদা-নীল রং থেকে কখনো বের হয়ে আসতে পারেননি। হয়তোবা বিএনপি ও ছাত্রদলকে নিয়ে কিংবা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চালিয়েছেন ও শাসিয়েছেন। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি ও হানাহানি লেগেই ছিল, শাসকদলীয় ছাত্ররা ছাড়া অন্যরা ছিল কোণঠাসা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাসা বেঁধেছিল শিক্ষা ও বুদ্ধি হরণের আয়নাঘর।
রাতুল বাবার সম্ভাবনাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত না হয়ে নতুন বাংলাদেশে রাজনীতিমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শান্তিপূর্ণ শিক্ষার পরিবেশের সম্ভাবনা নিয়ে বেশি উচ্ছ্বসিত। তিনি ভাঙতে চেয়েছেন আমাদের শিক্ষা ও বুদ্ধি হরণের আয়নাঘর। রাতুলদের জন্য রইল আমাদের অনেক সমর্থন ও আশীর্বাদ।
পুরোনো অভ্যাস ছাড়তে হবে
গত পনেরো বছরে বিএনপির নেতাকর্মীরা ভীষণভাবে বঞ্চিত ছিলেন এবং জেল-জুলুমও অনেক খেটেছেন। আজকের এ দিনটার জন্যই তারা অপেক্ষা করছিলেন। এখন অনেক সুযোগ, আওয়ামী লীগের পরিত্যক্ত সবকিছু এখন শুধু দখলে যাওয়ার অপেক্ষায়। বিএনপি হাইকমান্ড চেষ্টা করছে আগের বদনামগুলো যেন নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে না ওঠে।
সামনে এক সময়ে হবে নির্বাচন। মাঠ একদম ফাঁকা। বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বীও হয়তো হবে বিএনপি, খেলোয়াড় পরিবর্তন হয়েছে, খেলা একই। ২১ আগস্ট সকালে বিএনপির কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও কৃষক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন অন্তত পঁচিশজন। দুই নেতার একই উপজেলায় বাড়ি। দুজনেই ভবিষ্যতে নির্বাচন করার জন্য পথ পরিষ্কার করতে চাইছেন। বিএনপি হাইকম্যান্ড অবশ্য অবস্থা বেশি দূর গড়াতে দিলেন না, দুজনেরই সদস্যপদ স্থগিত হলো। অবশ্য সম্প্রতি এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়।
হাছান মাহমুদ পলাতক, এখন সাংবাদিকদের চোখ রাঙানোর কেউ নেই। এগিয়ে এলেন বিএনপি নেতা বুলু। তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনার ছবি বা তার বক্তব্য যেসব পত্রপত্রিকা ছাপাবে, সেগুলোর অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হবে। বর্তমান পরিবেশে এসব বড্ড বেমানান, বিএনপি হাইকম্যান্ড বুঝতে পেরেছে, তাই তাকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পদ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বুলুও বুঝেছেন, পুরোনো অভ্যাস ছাড়তে হবে এবং ক্ষমা চেয়েছেন। পারবে কি পুরোনো বিএনপি নতুন বিএনপি হতে?
পদোন্নতি নিয়ে বিশৃঙ্খলা
বিগত বছরগুলোতে যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে, ক্ষমতায় এসেই শুরু করেছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজেদের পছন্দের লোক বসানোর প্রতিযোগিতা। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অনেক নিরীহ ও যোগ্য সিভিল সার্ভেন্ট। তাদের কাউকে বছরের পর বছর পদোন্নতি না দিয়ে সেকশন অফিসার অথবা ওএসডি করে রাখা হয়েছে। একদলের হাতে উন্নতি পেয়েছেন যারা, তারা আবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অন্যদল ক্ষমতায় আসায়। এ বৃত্ত চলছেই। এর একটা প্রতিফলন হলো, প্রায় সব সরকারি কর্মচারীর গায়ে একটা দলীয় সিল পড়ে গেছে। কেউ কেউ আবার, যেমন ডাক্তারদের একটা বড় অংশ, রাজনৈতিক দলগুলোর অংশীদারত্ব সংগঠন ড্যাব ও স্বাচিপের মাধ্যমে নিজেরাই নিজেদের রাজনৈতিক পরিচিতি প্রতিষ্ঠা করেছে। এ সংঘবদ্ধতাকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানে সরকারি কর্মচারীরা ঘেরাও, জোর খাটিয়ে প্রমোশনের দাবি আদায় করতে গিয়ে সচিবালয়ে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছেন। শৃঙ্খলা যারা ভেঙেছেন, তারা যে পদোন্নতির যোগ্য নন, এটি তাদের বুঝতে হবে।
সাগর-রুনী আর ত্বকী হত্যার বিচার
চারদিকে শুধু মামলা আর মামলা। শেখ হাসিনার সরকার পতনের সময় ৭১৭ জন মানুষকে হত্যা করেছে (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের খসড়া তালিকা অনুযায়ী)। এসব হত্যার নিশ্চয়ই বিচার হবে। আগের আরও তিনটি হত্যার কথা আমরা যেন ভুলে না যাই। দুটি খুনের মামলা রাজনৈতিক কারণে অনেকদিন ধরে ঝুলে আছে। হাসিনা সরকারের সময় সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনীর খুন এবং নারায়ণগঞ্জের ছোট্ট ত্বকীর হত্যাকাণ্ড ভীষণভাবে জাতির বিবেককে ক্ষতবিক্ষত করেছে। সাগর-রুনী হত্যা মামলা ১০০ বারেরও বেশি পিছিয়েছে। ত্বকীরটা কতবার, খেই হারিয়ে ফেলেছি। সাগর ও রুনী হত্যা মামলার জন্য টাস্কফোর্স গঠন করেছে সরকার, দেখা যাক কী হয়।
পরের কয় মাস সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ডিবি ও জেলে আসা-যাওয়া করবেন। জাতির আশা থাকবে, তার কাছ থেকে সাগর-রুনী ও ত্বকী হত্যার বিস্তারিত বের করা হবে এবং তাদের খুনের বিচার ত্বরান্বিত করা হবে।
সালেহ উদ্দিন আহমদ : শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক; ডাকসুর সাবেক সম্পাদক (১৯৭০-৭২)