শিল্পোন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু বিষয়ক প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে
এরশাদুল আলম প্রিন্স
প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জলবায়ুবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলো আমাদের জন্য সবসময়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর এবারের সম্মেলন (কপ২৯) আরও গুরুত্ববহ। এবারের সম্মেলনের মূল এজেন্ড জলবায়ু তহবিল বা জলবায়ু অর্থায়ন। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় আমরা প্রায় শীর্ষে অবস্থান করছি। আমরা সমুদ্র তীরবর্তী ভাটির দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রায় সব ঝুঁকিই আমাদের ওপর দিয়ে প্রবহমান। ঝড়, বন্যা, খরা-আমরা এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার। এখনো যদিও বরফ পড়ে না; প্রচণ্ড শীত ও অতি গরম এখন প্রায়ই হানা দেয়। অর্থনৈতিক সক্ষমতা কম থাকায় এসব দুর্যোগ আমাদের জন্য আরও ভয়াবহ রূপে আবির্ভূত হয়। এর ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে আমাদের অনেক সময় লাগে। প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে আমরা এক ধরনের সক্ষমতা অর্জন করেছি। কিন্তু টেকসই সক্ষমতার জন্য যে আর্থিক বিনিয়োগ দরকার, তার জন্য পর্যাপ্ত অর্থায়ন আমাদের নেই। এবারের জলবায়ু অর্থায়নবিষয়ক কপ২৯ সম্মেলনটি তাই আমাদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল আজারবাইজানের বাকুতে যোগদান শেষে দেশে ফিরে এসেছেন। সন্দেহ নেই, বাকুতে এবারে আমাদের প্রতিনিধিত্ব এক ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। ড. ইউনূসের উপস্থিতি এ সম্মেলনে বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। তিনি পরিবেশ নিয়েও কাজ করেন, বিশ্বব্যাপী এ নিয়ে কথা বলেন। তার ‘তিন শূন্য’র পৃথিবী ক্যাম্পেইন ইতোমধ্যে তিনি পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দিয়েছেন। শূন্য কার্বন নিঃসরণ, শূন্য দারিদ্র্য ও শূন্য বেকারত্ব নিয়ে তিনি কাজ করেন। কাজেই এ সম্মেলনে তার উপস্থিতিও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং এটি শুধু সরকারপ্রধান হিসাবে নয়, একজন পরিবেশ আন্দোলনকারী হিসাবেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এখানে আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, এ সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টাও দেশের একজন বিশিষ্ট পরিবেশ আন্দোলনকারী ও পরিবেশ আইনজীবী। তিনি পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করেন বহু বছর ধরে। দেশে পরিবেশ রক্ষায় তিনি ইতোমধ্যে বেশকিছু ভালো উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে, এখানে কথা হলো-পরিবেশ রক্ষায় সামাজিক সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান হয়তো পরিবেশ রক্ষায় কিছু সরকারি আদেশ-নিষেধ জারি করবেন; কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ যতদিন সচেতন না হব, ততদিন পরিবেশ রক্ষা হবে না। আইন না মানার এক সহজাত প্রবৃত্তি আমাদের মধ্যে রয়ে গেছে। এ সংস্কৃতির পরিবর্তনে সবাইকে কাজ করতে হবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পরিবেশ জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
১৯৯৫ সালে প্রথম কপ সম্মেলন হয়। বাকুতে এবারের সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে ইউএনএফসিসিসির প্রধান নির্বাহী সাইমন স্টিল বলেন, ‘এখন কঠিন সময় যাচ্ছে। আমি এখানে আশা এবং স্বপ্ন দেখাতে চাই না। তবে আমাদের একতাবদ্ধ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। মানবজাতিকে বাঁচাতে লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের বারবার জেগে উঠতে হবে।’ কিন্তু এবারের সম্মেলনে সেই বৈশ্বিক ঐক্যের যেন এক অভাব দেখা যাচ্ছে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ ‘পাপুয়া নিউগিনি’ এবারের জলবায়ু সম্মেলন বয়কট করেছে। ভবিষ্যতে যদি আরও দেশ এ সম্মেলন বয়কট করে, তবে ধীরে ধীরে এ সম্মেলন তার গুরুত্ব হারাতে পারে। আশা করি, বিশ্বনেতারা বিশ্ববাসীদের হতাশ করবেন না। পাপুয়া নিউগিনি বলে কয়ে এবার সম্মেলন বয়কট করেছে। কিন্তু অনেক বিশ্ব নেতা বয়কট না করলেও এ সম্মেলনে যোগ দেননি। অথচ এ সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের থাকা ও তাদের প্রতিশ্রুতিই বেশি দরকার। এবারের সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স যোগ দেয়নি। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য তারাই মূলত দায়ী। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট আগামী দিনে জলবায়ু ইস্যুটিকে কীভাবে দেখবেন তার ওপর অনেকটাই নির্ভর করে বিশ্বজলবায়ু আন্দোলনের ভবিষ্যৎ। ট্রাম্প এর আগেরবার নির্বাচিত হয়ে জলবায়ু সম্মেলন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। তিনি পুনরায় যদি একইভাবে জলবায়ু সম্মেলন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করেন, তবে বৈশ্বিক পরিবেশ আন্দোলনের অগ্রযাত্রা অনেকটাই বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কাজেই জলবায়ু ইস্যুটি তিনি কীভাবে দেখবেন, সেদিকে রয়েছে সচেতন মানুষের দৃষ্টি।
এবারের সম্মেলন জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে। আমাদের মতো জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় জলবায়ু তহবিল অত্যন্ত জরুরি। জলবায়ু তহবিল ছাড়া আমাদের বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর পক্ষে জলবায়ু সক্ষমতা অর্জন সম্ভব নয়।
আবহাওয়া ও জলবায়ুর বিপন্নতা আমাদের ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। গত বছর দেশে প্রচণ্ড শীতও পড়েছে, আবার প্রচণ্ড গরমও পড়েছে। সম্প্রতি স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল পুরো ডুবে গেছে। প্রচণ্ড খড়া ও দাবদাহ তো সারা বছরই থাকে। এছাড়া একের পর এক ঘূর্ণিঝড় তো আছেই। এ জাতীয় ক্ষতি মোকাবিলার জন্য জাতিসংঘ ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলোকে অর্থায়ন করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ফ্রান্সের মতো রাষ্ট্রগুলো যদি সহযোগিতা না করে, তবে এ অর্থ জোগান সম্ভব হবে না। এসব দেশ ইতোমধ্যে কপ সম্মেলন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
কপ২৯ সম্মেলন থেকে বিশ্বনেতাদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলার জন্য এক হতাশাজন সংবাদ। জি-২০ জোটভুক্ত অনেক দেশের নেতাই এবার আসেননি। অথচ তারাই বিশ্বের ৮০ শতাংশ কার্বন নির্গম করে। উন্নত রাষ্ট্রগুলোই বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রধানত দায়ী। অথচ এ ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে বিশ্বের সবাই। আমাদের মতো দেশগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কপ২৯ সম্মেলনে উন্নত রাষ্ট্রগুলো অনুপস্থিত থাকলে সেখানে কোনো যৌথ সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। অর্থায়নের ঘোষণা আসতে হবে অর্থদাতার কাছ থেকেই। অথচ সেখানেই তারা নেই। জলবায়ু একটি বৈশ্বিক ব্যাপার। এ ব্যাপারে যে কোনো সিদ্ধান্তই ঐকমত্যের ভিত্তিতে নিতে হবে। কারণ, এ সিদ্ধান্তের অংশীদার সব রাষ্ট্রই। সবাই একমত না হলে কোনো সিদ্ধান্তই আলোর মুখ দেখবে না।
এবারের কপ সম্মেলনে আয়োজক আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ঔপনিবেশিক ‘অপরাধের’ জন্য ফ্রান্সের বিরুদ্ধে কিছু কথা বলেছেন। এরপর ফ্রান্সের পরিবেশমন্ত্রী ১৩ নভেম্বর তার বাকুগামী ফ্লাইট বাতিল করেছেন। এছাড়া নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভবিষ্যৎ জলবায়ু অবস্থান কী হবে, তা এখনই বলা মুশকিল। এভাবে নানা কারণে বিশ্বনেতারা যদি জলবায়ু সম্মেলনকে উপেক্ষা করেন, তবে স্বাভাবিকভাবেই এটি গুরুত্ব হারাবে। এতে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি আরও ত্বরান্বিত হবে।
যে কোনো কপ সম্মেলনেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানি। উন্নত বিশ্বই জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর বেশি নির্ভরশীল ও ব্যবহারকারী। বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্যও তাদের দায় বেশি। তাই তারা দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না। তাদের জন্যই বৈশ্বিক কার্বন নির্গমন অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। তাদের জন্যই দ্রুত গতিতে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়ছে। ২৮তম সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, বিশ্ব জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ক্রমান্বয়ে সরে আসবে। কিন্তু গত এক বছরে এ ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে হয় না। উপরন্তু জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর যারা বেশি নির্ভরশীল, তারাই এ সম্মেলনে আসেননি। প্রতিশ্রুতি দিয়ে সম্মেলনে না আসা দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এ প্রবণতা দুঃখজনক।
কপ সম্মেলনে বিশ্বনেতারা বিশ্ব বাঁচাতে কার্বন নির্গমন হ্রাস ও সবুজ পৃথিবী নির্মাণে আলোচনা করে থাকেন। এ আলোচনা যেভাবেই হোক অব্যাহত রাখতে হবে। ড. ইউনূসসহ বিশ্বনেতারা জলবায়ু নিয়ে আলোচনা করেছেন এটি আমাদের আশাবাদী হতে উদ্বুদ্ধ করে। কপ২৯ সম্মেলনে যোগদান করে ড. ইউনূস তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানসহ আরও অনেকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এসব গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের কারণে আমাদের দেশ নানাভাবে উপকৃত হবে। জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় উন্নত রাষ্ট্রগুলোর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব ছাড়া এসব আলোচনা ফলপ্রসূ হবে না। উন্নত রাষ্ট্রগুলোর আর্থিক সহায়তা এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া জলবায়ু আন্দোলন প্রকৃত অর্থে প্রাণ পাবে কিনা সন্দেহ। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর অনুপস্থিতি আগামীর জলবায়ু ও পরিবেশ আন্দোলনকেই চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিতে পারে। জলবায়ু একটি বৈশ্বিক বিষয়, তাই সব দেশ মিলেই এটি মোকাবিলা করতে হবে।
এবারে নতুন দায়িত্ব গ্রহণের পর ২৯তম জলবায়ু সম্মেলনের (কপ-২৯) সভাপতি বলেন, ‘এই সম্মেলন সবাইকে নতুন পথ দেখাবে।’ জলবায়ুর পরিবর্তনের বৈশ্বিক ক্ষতির ব্যাপারে যে ঐকমত্য হয়েছে, সেটি বজায় রাখতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের নাগরিক হিসাবে আমরা উদ্বিগ্ন। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির বাইরে কেউ নয়, কোনো দেশ নয়। তাই সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য কম, তাই আমাদের অর্থায়ন দরকার। শিল্পোন্নত দেশগুলো এ ক্ষতির জন্য বেশি দায়ী, তাই তারা অর্থায়ন করবে। এটি একটি বৈশ্বিক জলবায়ু নীতি। বিশ্বের সবাই এটি সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করেছে। তাই সবাইকেই তাদের নিজ নিজ জলবায়ু প্রতিশ্রুতি রক্ষায় দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
এরশাদুল আলম প্রিন্স : আইনজীবী, প্রাবন্ধিক