ব্যবসা-বাণিজ্যে সততার চর্চা হোক
এসএম নাজের হোসাইন
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিগত সরকারের আমলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কী পরিমাণ লুটপাট হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান দিতে আরও সময় লাগবে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ছোট-বড় ২৪টি অনিয়মের মাধ্যমে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। ব্যাংক খাত থেকে অনিয়মের মাধ্যমে বের করে নেওয়া এ অর্থ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের ১২ শতাংশের বেশি। অথচ এ অর্থে অনায়াসে বাজেট ঘাটতি মেটানো সম্ভব হতো।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বহুল আলোচিত বেসিক ব্যাংকের কেলেঙ্কারির পাশাপাশি প্রায় একই সময়ে ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে আলোচিত আরেক ঘটনা ছিল রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি। এতে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার অনিয়ম হলেও তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এটি বড় অঙ্কের নয় বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এ ছাড়া ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কয়েক ধাপে জনতা ব্যাংকে ঘটে ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা। ক্রিসেন্ট ও অ্যাননটেক্স গ্রুপ এ ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ছিল। এর বাইরে ২০২১ সালে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক) ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকা অবস্থায় প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদারের আর্থিক খাতে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের ঘটনা সামনে আসে। এ ছাড়া ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) ৫০০ কোটি টাকা, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালে জনতা ব্যাংকে থার্মেক্স গ্রুপের ৮১৬ কোটি টাকা, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে শহিদুল আহসানের ৭০১ কোটি টাকা, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালে এবি ব্যাংকে ৪০০ কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটে। এর বাইরে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান প্রভাব খাটিয়ে দেশের সরকারি-বেসরকারি সাতটি ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। বিগত সরকারের আরেক ঘনিষ্ঠ এস আলম শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে নিয়েছেন। তার নিয়ন্ত্রণে থাকা অন্যান্য ব্যাংকের হিসাব পেলেও হয়তো এ অঙ্ক আরও ভারী হবে। যদিও ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণমূলক মূলধন ১০ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। ফলে একটি গ্রুপকে ইসলামী ব্যাংক সর্বোচ্চ ফান্ডেড ১ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা ও নন-ফান্ডেড ১ হাজার ৪২ কোটি টাকা ঋণ দিতে পারে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে একটি গ্রুপ ঋণ পেতে পারে ২ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণের টাকা পাচার করতে এস আলম গ্রুপ একাধিক গ্রুপ তৈরি করেছে, ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রতিষ্ঠান খুলেছে। এর বাইরে সামিট গ্রুপসহ আরও অনেক গ্রুপের হাজারও তথ্য উপস্থাপন করা যাবে, যা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় উঠে আসবে।
ক্যাবসহ বিভিন্ন নীতি-গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে দীর্ঘদিন ধরেই নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে সীমাহীন সংকটে থাকার কথা বলা হলেও সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি আমলে নিতে চাননি। উৎপাদক, আমদানিকারক, আড়তদার, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীসহ সবাই লাগামহীনভাবে বাজারের সব পণ্যের দাম বাড়িয়ে জনদুর্ভোগ বাড়িয়েছেন। চাল, পেঁয়াজ, রসুন, আলু, মাছ-মাংস, সবজি ও অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম নিু ও সীমিত আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে। মূল্যস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্যসংক্রান্ত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের সব উদ্যোগ বাস্তবায়নে কার্যকর দৃশ্যমান উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। যারা এগুলো দেখভাল করার দায়িত্বে, তারা নানা রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত। ফলে বেশ কয়েক বছর ধরেই সাধারণ মানুষকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে অসহনীয় জীবনযাপন করতে বাধ্য হতে হচ্ছে।
সাম্প্রতিক পটপরিবর্তনের পর অনেক ব্যবসায়ী এখন ভোল পালটিয়ে নতুন রূপে আবার সরকারের প্রিয়ভাজন হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত আছেন। আমাদের অনেকেরই জানা আছে, বিগত সরকারপ্রধান যখনই প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অনুদান প্রদানের জন্য ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করতেন, তার আগেই প্রতিযোগিতা পড়ে যেত কে কত কোটি টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দিতে পারেন। এফবিসিসিআই, ব্যাংক মালিকদের সংগঠন ও বিজিএমইএসহ নানা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে আসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্যানেল চূড়ান্ত করে দেওয়া হতো, যেখানে ব্যবসায়ীদের কোনো মতামত প্রদানের সুযোগ পর্যন্ত ছিল না। আর এ চর্চাটির ঢেউ লেগেছিল জেলা পর্যায়ে ব্যবসায়ী সংগঠন ও চেম্বারগুলোতেও, যার কারণে ব্যবসায়ীরাও ভোটের অধিকার হারিয়েছিলেন সাধারণ মানুষের মতো। যারা অনিয়ম করে সরকারের নানা প্রণোদনা, সুযোগ-সুবিধা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ হাতিয়ে নিয়েছেন, নিত্যপণ্যসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে কৃত্রিম সংকট ও সিন্ডিকেট করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়ে পাচার করে দেশকে ফতুর করেছেন, তারা আবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সফল গণঅভ্যুত্থানের পর ভোল পালটানো শুরু করেছেন। রাষ্ট্র সংস্কারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন। এটি কি নতুন দৃশ্যপটে চরদখলের মতো নিজেদের প্রভাব ও অস্তিত্ব ধরে রেখে আখের গোছানোর অপচেষ্টা? আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও কি তাদের নিয়ে এ মহাযজ্ঞে শামিল হতে চায়? মাঝপথে হোঁচট খেলে কাউকে কি পাওয়া যাবে?
তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেখানে প্রজাতন্ত্রের একটি কলুষিত কর্মকর্তা-কর্মচারী চক্র রয়েছে, সক্রিয় রয়েছে একটি অতি মুনাফালোভী ও সুবিধাবাদী ব্যবসায়ীগোষ্ঠী, সেখানে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে সুশাসনসহ খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ও নীতিকৌশল গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে অসাধু ও মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের খপ্পর থেকে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও নীতিকে উদ্ধার করতে হবে। কারণ, সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীদের অতিমুনাফার ফাঁদের কারণে সরকারের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ অনেক উদ্যোগ বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সর্বত্র সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বচ্ছতা, সুশাসন নিশ্চিত করার পাশাপাশি সুস্থ ধারার রাজনৈতিক চর্চা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।
এস এম নাজের হোসাইন : ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)
cabbd.nazer@gmail.com