Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কার জরুরি

Icon

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কার জরুরি

জনবহুল বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের সুবিধা অপ্রতুল। অগণিত রোগীর বেসামাল অবস্থায় সরকারি হাসপাতালগুলো বিপর্যস্ত। প্রয়োজনীয় ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য লোকবল, ওষুধপত্র, চিকিৎসা সরঞ্জাম ইত্যাদির সংকটে পর্যাপ্ত সেবাপ্রদান প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সক্ষমতার তুলনায় তিন-চারগুণ বেশি রোগীকে সেবাদান সর্বত্রই কঠিন রূপ পরিগ্রহ করেছে। এই সুযোগে অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল রমরমা ব্যবসা করে যাচ্ছে। সেবাগ্রহীতার জন্য এসব হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় অসহনীয় পর্যায়ে ঠেকেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিষেবায় অভিজ্ঞ-প্রশিক্ষিত কতিপয় চিকিৎসকের আকাশছোঁয়া ফি পরিশোধে জনগণের নাভিশ্বাস উঠছে। অবৈধ-অসাধু উপায়ে অর্থ উপার্জনকারী ছাড়া মধ্য-নিম্নবিত্ত নাগরিকদের পক্ষেও চিকিৎসা ব্যয় মেটানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরে গড়ে ওঠা বিশাল ভবনের হাসপাতাল থেকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সুবিধা পেতে তারা সম্পূর্ণ অপারগ। বিত্তশালী ব্যক্তি ও ধনাঢ্য রাজনীতিকদের ঘনঘন বিদেশে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নেওয়া এক ধরনের বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে। এসব হাসপাতাল কর্তৃক বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে অপ্রয়োজনীয় অর্থ আদায় তাদের বাণিজ্যিক লোভ-লালসার অন্যতম পন্থা হিসাবে বিবেচিত।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্য খাত দেশের সর্বাধিক দুর্দশাগ্রস্ত খাতগুলোর একটি। কম বাজেট বরাদ্দ, প্রশাসনিক সুশাসনের অভাব, অনিয়ম-দুর্নীতি, চিকিৎসকদের মূল্যবোধের অভাব, অত্যধিক বাণিজ্য প্রবণতা ইত্যাদি দেশের স্বাস্থ্য খাতকে দুর্দশাগ্রস্ত করে তুলেছে। পতিত সরকারের আমলে বিভিন্ন সময় স্বাস্থ্য খাতের নানা বিষয় সংস্কারে অর্ধশতাধিক সুপারিশমালা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু এসব সুপারিশের মধ্যে যেগুলো শুধু ক্ষমতাসীনদের স্বার্থরক্ষা করেছে, সেগুলোই বাস্তবায়িত হয়েছে। এ খাতে সমস্যার মূলে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি খাতে যত্রতত্র মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় দুভাগে বিভক্ত থাকা, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা থেকে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি ব্যবস্থাপনা আলাদা করা, বেসরকারি খাতে ব্যাঙের ছাতার মতো ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়া, ব্যবস্থাপনার ত্রুটি, স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান নিয়ন্ত্রণে মাঠ প্রশাসনকে শক্তিশালী না করা, ওষুধের গুণগতমান রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়াসহ নানা অব্যবস্থা ও ভুল নীতি। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা অত্যন্ত অবহেলিত এবং প্রায় প্রহসনে পরিণত হয়েছে। বিপরীতে বেসরকারি খাতে চাকচিক্য থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা অত্যন্ত নিম্নমানের।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রণীত নীতিমালা অনুসারে ১৯৪৮ সালে তৈরি হয় সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, যা স্বাস্থ্যকে একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা এবং সব ব্যক্তির জন্য স্বাস্থ্যের সর্বোচ্চ মানের নিশ্চয়তা দেওয়ার অঙ্গীকার করে। জাতিসংঘ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবাকে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অন্যতম কৌশল হিসাবে বিবেচনা করেছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ৩.৮-এ সবার জন্য অসুস্থতাজনিত আর্থিক ঝুঁকিতে নিরাপত্তা, মানসম্মত অপরিহার্য স্বাস্থ্যসেবা এবং সাশ্রয়ী মূল্যে নিরাপদ-কার্যকর-মানসম্মত আবশ্যক ওষুধ ও টিকা সুবিধাপ্রাপ্তির পথ সুগম করাসহ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্য অর্জন করার কথা বলা হয়েছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার দুটি মূল উপাদান হলো-সবার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা নিশ্চিত করা এবং অসুস্থতাজনিত আর্থিক ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা দেওয়া। বাংলাদেশ ২০৩২ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর অন্তর্ভুক্তি সূচকে ২০২১ সালে বাংলাদেশ ১০০-তে পেয়েছিল ৫২। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো মধ্যে এ সূচকে বাংলাদেশের নিচে ছিল শুধু পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। বিশ্বের প্রায় ১৪০টি দেশ তাদের সংবিধানের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকে মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রকে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য বলা হয়েছে এবং স্বাস্থ্যসেবাকে জীবনধারণের মৌলিক উপাদান হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, সংবিধান গৃহীত হওয়ার ৫২ বছর পরও দেশের জনসংখ্যার বৃহৎ অংশ পরিপূর্ণ স্বাস্থ্য পরিষেবার আওতায় আসেনি। স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া মানুষের খরচের চিত্রও হতাশাব্যঞ্জক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যসেবা খরচের কারণে বিপর্যস্ত। বর্তমানে চিকিৎসায় বাংলাদেশের ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ৭৪ শতাংশ। এটি প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে বেশি। তন্মধ্যে শুধু ওষুধের জন্যই ব্যয় ৪৪ শতাংশ। এক বছরে হাসপাতালগুলোয় রোগ নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষার ফি, চিকিৎসকের পরামর্শ ফি ও ওষুধের ব্যয় বাড়ে কমপক্ষে ১৫ শতাংশ। তাছাড়া দেশে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে জনবলের সংকটও এক বড় অন্তরায়। প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য শূন্য দশমিক সাতজন চিকিৎসক এবং শূন্য দশমিক ৪৯ জন নার্স ও মিডওয়াইফ রয়েছে। এ স্বল্প জনবলের মধ্যে ২৪ শতাংশ পদই শূন্য (২০২১ সালে)। সংস্থাটির নির্ধারিত মানদণ্ডের তুলনায় দেশে চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফ ৭৪ শতাংশ কম।

দেশের বেহাল স্বাস্থ্যব্যবস্থার কারণে চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সরকারি-বেসরকারি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে বাংলাদেশ থেকে বছরে সাড়ে তিন লাখ মানুষ চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে গিয়েছিল। এতে তাদের ব্যয় হয়েছিল ২০৪ কোটি ডলার। আর এখন যাচ্ছে বছরে প্রায় ২৭ লাখ ১০ হাজার রোগী। এ হিসাবে ব্যয় বেড়েছে ৪৫০ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে শুধু ভারতেই ব্যয় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা এবং দেশটিতে যাচ্ছে বিদেশে যাওয়া মোট রোগীর প্রায় ৯২ শতাংশ। গবেষণায় দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার আটটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো-বিদেশে অভিজ্ঞ চিকিৎসক, কম চিকিৎসা ব্যয়, সঠিক রোগ নির্ণয় ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিকিৎসা চলাকালে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা, মানসম্মত চিকিৎসা, রোগীদের জন্য চিকিৎসকদের পর্যাপ্ত সময় ব্যয়, চিকিৎসা পেতে কম সময় অপেক্ষা এবং সার্বিক স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান।

এ গবেষণায় আরও জানা যায়, প্রায় ১২ রোগের চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে যাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে কার্ডিওভাসকুলার বা হৃদরোগের চিকিৎসা। এটি মোট রোগীর ১৭ শতাংশ। হৃদরোগীদের বেশিরভাগই যাচ্ছে ভারতে। এ ছাড়া ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ রোগী কিডনি রোগের, ১১ দশমিক ৫ শতাংশ রোগী অর্থোপেডিক সার্জারির, ১১ শতাংশ করে লিভার ও ক্যানসার রোগের, ৯ শতাংশ নিউরোলজির, ৬ শতাংশ গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি ও ইউরোলজির, ৫ শতাংশ নাক-কান-গলার এবং ৪ শতাংশ করে রোগী জেনারেল সার্জারি ও গাইনোকলজির, চোখ ও দাঁতের রোগী ২ শতাংশ, মেডিকেল চেকআপের জন্য ৫ শতাংশ, স্থূলতার চিকিৎসায় ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় ৪ শতাংশ রোগী বিদেশ যায়। সবচেয়ে কম যাচ্ছে প্লাস্টিক সার্জারি করাতে, যা মোট রোগীর শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ। তাছাড়া বিদেশে যাওয়া মোট রোগীর অর্ধেকেরও বেশি অর্থাৎ ৬১ শতাংশ পুরুষ ও ৩৯ শতাংশ নারী। আবার বেশির ভাগ পুরুষ রোগী যাচ্ছে সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে।

সুখের বিষয় হচ্ছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশের বিভিন্ন খাতে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। গঠন করা হয়েছে স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্কার কমিশন। স্বাস্থ্য খাতের চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক সম্প্রতি ১২ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ওই কমিটির কার‌্যাবলি হচ্ছে-দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কার, চিকিৎসা শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং নগর-গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য নীতিনির্ধারণী পরামর্শ দেওয়া। এছাড়া রয়েছে দেশের প্রধান প্রধান চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রেগুলেটরি কাঠামো শক্তিশালী করতে যথোপযুক্ত উপদেশ দেওয়ার এখতিয়ার। দীর্ঘদির ধরে প্রক্রিয়াধীন থাকা স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনের খসড়া খুব শিগগিরই মন্ত্রিপরিষদে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন সম্মানিত স্বাস্থ্য উপদেষ্টা।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নবনিযুক্ত মহাপরিচালক দেশের স্বাস্থ্য খাতকে সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। ১০ নভেম্বর গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘যেহেতু স্বাস্থ্য ক্যাডার একটি বড় খাত, তাই এক্ষেত্রে একটু সময় লাগবে। সবার সহযোগিতা পেলে দুর্নীতিমুক্ত, শোষণমুক্ত স্বাস্থ্য খাত গড়ে তোলা হবে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে সবাইকে মিলেমিশে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’

সবশেষে, বর্তমান সরকারের অধীনে রাষ্ট্র মেরামতের সব অঙ্গের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতকে অধিকতর প্রাধান্য দেওয়া আবশ্যক। পর্যাপ্ত সময় নিয়ে গভীর-পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে চলমান সংকটগুলো চিহ্নিত করা অপরিহার্য। এ ধারাবাহিকতায় গুরুত্ব অনুসারে স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর টেকসই সংস্কার সময়ের জোরালো দাবি।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম