জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতেই হোক সংবিধান সংস্কার
সাকিব আনোয়ার
প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছাত্র-জনতার এক অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় ইতিহাসের এক নিকৃষ্টতম স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। পতন হয় সাড়ে ১৫ বছরের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের। স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের লড়াইয়ের পরিক্রমায় ’২৪-এর সফল গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দল এবং জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের স্বপ্ন এবং জনগণের ব্যাপক প্রত্যাশা নিয়ে যাত্রা শুরু করে হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশের নতুন সরকার।
নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের দাবি ওঠে ’২৪-এর অভ্যুত্থানের অংশীজনদের কাছ থেকে। সফল অভ্যুত্থানের পর সংবিধান সংস্কারের পাশাপাশি পুনর্লিখন বা নতুন সংবিধান প্রণয়নের প্রস্তাবও এসেছে কোনো কোনো মহল থেকে। সংবিধান সংশোধন না পুনর্লিখন, তা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে নানারকম মত দেখা যাচ্ছে। সংবিধান অপরিবর্তনীয় নয়। এটা সময়ের প্রয়োজনে পরিবর্তনের দাবি রাখে। জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে সংবিধান সংশোধন করতে হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখনের আইনগত ভিত্তি আছে কিনা, এ নিয়েও বিতর্ক চলছে।
বিগত ৫৩ বছরে ১৭ বার সংবিধানে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭(খ) দুষ্পরিবর্তনীয়-এটা অযৌক্তিক। এটা মানবরচিত, ভুল ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। সংবিধানে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে এ ব্যাপারে ছাত্র-জনতা, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। প্রয়োজনে রেফারেন্ডাম দিয়ে সংবিধানে সংশোধন আনতে হবে।
কেউ কেউ মনে করছেন, সংস্কারের নামে জোড়াতালি দিয়ে সংবিধান সংশোধন করা হলে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র রোধ করা সম্ভব না। তবে এর বিপরীতে ভিন্ন যুক্তিও আছে। গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে, নতুন দেশ গঠিত হয়নি। তাই সংবিধান পুনর্লিখনের কোনো প্রয়োজন আছে বলে তারা মনে করেন না।
সংবিধানের পুনর্লিখনের ইতিহাস পৃথিবীতে আছে। কিন্তু সংবিধান পুনর্লিখন বা নতুন সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিশৃঙ্খলা, সংঘাতের সৃষ্টি করেছে। ১৯৯৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সংবিধান পুনর্লিখন করেছিল। ২০০৮ সালে আইসল্যান্ডে অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্দেশ্যে সংবিধান পুনর্লিখন করা হয়েছিল, যদিও পরবর্তী সময়ে তা কার্যকর হয়নি। আরব বসন্তের পর ২০১৪ সালে তিউনিসিয়ায় সংবিধান পুনর্লিখন করা হয়েছিল। ২০১২ সালে বিপ্লবের পর মিসরের সংবিধানকে পুনর্লিখন করা হয়েছিল। চিলি ২০১৯ সালে সংবিধান পুনর্লিখন করেছিল।
দেশের জুলাই অভ্যুত্থানের সঙ্গে ২০১১ সালের মিসরের তাহরির স্কয়ারের বিক্ষোভের মিল রয়েছে। ওই বিক্ষোভের জেরে মিসরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক পদত্যাগ করে সৌদি আরবে পালিয়ে যান, ঠিক যেভাবে শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। হোসনি মোবারক পদত্যাগ করার পর মিসরের দায়িত্ব নেয় দেশটির সেনাবাহিনী। কিন্তু তাহরির স্কয়ারের বিক্ষোভকারীরা আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ এল বারাদিকে মিসরের রাষ্ট্র ক্ষমতায় দেখতে চেয়েছিল। এ সময়ে মিসরে নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি ওঠে। খুলে যায় প্যান্ডোরার বাক্স। এমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী একটি সংবিধান সভা আহ্বান করতে ২০১২ সালে নির্বাচন করতে বাধ্য হয়। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে মুসলিম ব্রাদারহুড। এক বছরের মাথায় ২০১৩ সালে ব্রাদারহুড সরকারকে উৎখাত করে সেনাবাহিনী। এবার তারা এল বারাদিকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে নিয়োগ দেয়, যাকে চেয়েছিল তাহরির স্কয়ারের বিক্ষোভকারীরা। কিন্তু তিনিও মাত্র জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত ওই পদে থাকতে পেরেছিলেন।
ওই সময়কালে মিসরের সামরিক বাহিনী সংবিধান স্থগিত করে এবং সেনাপ্রধান নিজেই প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসেন। সেই জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মিসরের প্রেসিডেন্ট হিসাবে ক্ষমতায় রয়েছেন। তিনি তাহরির স্কয়ারে আন্দোলনকারী বেশির ভাগ নেতাকেই কারাবন্দি করেছেন।
দেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয় নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। বলা যায়, তিনি বাংলাদেশের এল বারাদি। তার সরকার ইতোমধ্যে তিন মাস পূর্ণ করেছে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ব্যারাকেই রয়েছে। কিন্তু সংবিধান প্রশ্নে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতা এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যে মতপার্থক্য প্রকাশ্যে এসেছে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। সংবিধান সংস্কার নাকি পুনর্লিখন বা নতুন সংবিধান-এই প্রশ্নে জুলাই অভ্যুত্থানের শক্তিগুলো এখন বিভক্ত। কেউ কেউ দাবি করছেন বিদ্যমান সংবিধান ছুড়ে ফেলে দিয়ে সংবিধান সভার মধ্য দিয়ে নতুন সংবিধান প্রণয়নের। কেউ কেউ আরও একধাপ এগিয়ে বর্তমান সরকারকে প্রচলিত রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং জবাবদিহির ঊর্ধ্বে বিপ্লবী সরকার ঘোষণার দাবি করছেন, যে সরকার কোনো ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ রাখবে না। সেই সরকার প্রণয়ন করবে নতুন সংবিধান। বিদ্যমান সংবিধান ফেলে দিয়ে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে কি নতুন সংবিধান লেখা সম্ভব হবে? কোনো পক্ষ কি তাদের অবস্থান থেকে ছাড় দিতে রাজি হবে? বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এ ঐকমত্যের কোনো সম্ভাবনা নেই, তা বিনা বাক্যব্যয়ে বলে দেওয়া যায়। সংস্কারে সন্তুষ্ট না থেকে যদি নতুন সংবিধান প্রণয়নের দিকে আমরা অগ্রসর হই, সেক্ষেত্রে যে প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যাবে, তা কি আমরা বন্ধ করতে পারব?
দেশের প্রতিটি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তাদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য বারবার সংবিধানকে সংশোধনের নামে কাটাছেঁড়া করেছে। বিশেষ করে গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী শাসনামলে বাংলাদেশের সংবিধানের এমন কিছু জায়গায় হাত দেওয়া হয়েছে, যা বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সাংবিধানিকভাবে স্বৈরাচারী কাঠামো তৈরি করেছে।
সংবিধানের এমন কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে, যা সময়ের প্রয়োজনে ও জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য যে সংস্কার দরকার, সেই সংস্কার যেন না করতে পারে, তার বন্দোবস্ত করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৭ (খ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সব অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সব অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলি সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সব অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলি সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হবে’। অর্থাৎ কোনোভাবেই ওই বিষয়গুলো পরিবর্তন করা যাবে না।’
কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, এ কারণে বিদ্যমান সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্ভব নয়। তারা নতুন সংবিধান প্রণয়নের কথা বলছেন। সংবিধান সংস্কার বা পুনর্লিখন যা-ই হোক না কেন, সেটা হতে হবে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে। ফলে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা গেলে বিদ্যমান সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কারও করা সম্ভব। বরং সংবিধানের পুনর্লিখন বা বর্তমান সংবিধান ছুড়ে ফেলে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে গেলে যে প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যাবে, তা বন্ধ করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজসহ অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে বিভাজন এত স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে যে তা সংঘাতে রূপ নিতে পারে।
সংবিধান পুনর্লিখন বা নতুন সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ নিলে-কেউ দাবি করতে পারেন ইমলামি প্রজাতন্ত্রের, কেউ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার, কেউ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নতুন কোনো ধারণা নিয়ে আসতে পারেন। কেউ ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে রাষ্ট্রের ভিত্তি ধরতে পারেন, কেউ বলতে পারেন ২৪ থেকেই হোক নতুন বাংলাদেশের যাত্রা, সেকেন্ড রিপাবলিক। বিদ্যমান সংবিধানের মতো সামনে একটা ফ্রেমওয়ার্ক না থাকলে অংশীজনরা নিজেদের দাবিতে অটল থাকতে পারেন। সেক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়ন কি সম্ভব হবে? উত্তরটা সম্ভবত আমরা সবাই অনুমান করতে পারি। ২৪-এর অভ্যুত্থানের ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশে যে বসন্ত এসেছে, সেই বসন্ত পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে গ্রীষ্মের উত্তাপ। নতুন এ বাংলাদেশে আমরা বিভক্তি, বিভাজন, অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা প্রত্যাশা করি না। কোনো সংঘাতকে আমরা আমন্ত্রণ জানাতে পারি না। আর এ কারণেই জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে বিদ্যমান সংবিধানের সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে অগ্রসর হওয়াই সম্ভবত আমাদের সামনে একমাত্র পথ।
সাকিব আনোয়ার : রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক