এবারের জাতিসংঘের বার্ষিক জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন (কপ২৯) আজারবাইজানে শুরু হয়েছে। জলবায়ুর জন্য ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বের হয়ে আসার ব্যাপারে তেলসমৃদ্ধ দেশ আজারবাইজানের কমই আগ্রহ রয়েছে। দেশটিতে বিপুল পরিমাণ অব্যবহৃত নবায়নযোগ্য শক্তির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে দেশটির রাজস্বের প্রায় ৬০ শতাংশই আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। আগামী বছরগুলোয় তেল ও গ্যাসের উৎপাদন ‘উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি’ করার পরিকল্পনা রয়েছে দেশটির।
আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ এপ্রিলে কপ২৯-এর প্রস্তুতিমূলক বৈঠকে বলেছিলেন, ‘জীবাশ্ম জ্বালানিসমৃদ্ধ একটি দেশের প্রধান হিসাবে অবশ্যই আমরা এ দেশগুলোর বিনিয়োগ ও উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার অধিকার রক্ষা করব।’
ইলহামের কথায়ই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল যে, ২০০টিরও দেশের আইনপ্রণেতা ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সম্মেলনের আয়োজন করা দেশটি কী এজেন্ডা নির্ধারণ করবে।
উন্নত দেশগুলোর উন্নয়নশীলদের কতটা সাহায্য করবে?
অতিরিক্ত নির্গমন কমানোর পাশাপাশি দেশগুলোর সামনে আরেকটি বড় আলোচনা নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। সেটা হলো, উষ্ণতা বৃদ্ধির পরিণতি মোকাবিলা করতে এবং অর্থনীতিকে কার্বন নির্গমনমুক্ত করতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে কতটা আর্থিক সহায়তা দেওয়া উচিত, সে বিষয়ে একমত হওয়া।
যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ ধনী দেশগুলোর পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলোও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তার জন্য ২০২০ সালের মধ্যে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে অবশ্য সময় লেগেছিল ২০২২ সাল পর্যন্ত। কিন্তু তহবিলের একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দেওয়া হয়েছে উচ্চ সুদে ঋণের আকারে। এ নিয়ে কঠোর সমালোচনা এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে।
জার্মান এনজিও নিউ ক্লাইমেট ইনস্টিটিউটের জলবায়ু নীতি বিশেষজ্ঞ নিকলাস হ্যোহনে মনে করেন, আজারবাইজানের সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা ২০০ বিলিয়ন থেকে ৭০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠনে সম্মত হতে পারেন। তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী ধনী দেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে একটি ন্যায্য আর্থিক চুক্তি হবে এটা।’
ভারত এবং অনেক আফ্রিকান দেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো বরাবরই এক ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বার্ষিক অর্থায়নের আহ্বান জানিয়ে আসছে। বর্তমানে প্রতিশ্রুত তহবিলের চেয়ে এটি দশগুণ। শিল্পোন্নত দেশগুলো অবশ্য এমন দাবিকে অবাস্তব বলে উড়িয়ে দিয়েছে। তারা চায় চীন এবং তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশগুলো এই আর্থিক বোঝা ভাগ করে নেবে।
জলবায়ু ক্ষতির তালিকা কে ঠিক করবে
১৮ শতকে গ্রেট ব্রিটেন থেকে শুরু হওয়া শিল্পবিপ্লবের পর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়তে থাকে। ধনী দেশগুলো ঐতিহাসিকভাবেই বৈশ্বিক উষ্ণায়নে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে। কিন্তু ধীরে ধীরে চীনের মতো দেশগুলোও জলবায়ুর ক্ষতি করা গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রধান নির্গমনকারী হয়ে উঠেছে। কিন্তু তারপরও আনুষ্ঠানিক নথিতে চীনকে এখনো উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে একেবারেই কম দায় থাকা দরিদ্র দেশগুলোর পাশাপাশি চীনও জলবায়ু তহবিলের অর্থ পায়।
২০২৩ সালের জলবায়ু সম্মেলনের আয়োজক রাষ্ট্র সংযুক্ত আরব আমিরাতও কাগজে কলমে একটি উন্নয়নশীল দেশ। বিশ্লেষকরা অবশ্য তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জলবায়ু তহবিলে অর্থ প্রদানে অংশগ্রহণকে আশাব্যঞ্জক হিসাবে দেখছেন।
গত বছর সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে বৈশ্বিক সম্প্রদায় প্রথমবারের মতো জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ‘সরে আসতে’ সম্মত হয়েছিল। তারপরও পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি ঠেকানো যায়নি। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে কমানো না হলে প্রাক্শিল্পবিপ্লবের সময়ের তুলনায় দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে উষ্ণতা বজায় রাখতে ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির প্রতিশ্রুতি পালন করা যাবে না। বর্তমান নীতি বজায় থাকলে শতাব্দীর শেষ নাগাদ এই গ্রহের তাপমাত্রা প্রায় ৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে।
নির্গমন হ্রাস ছাড়া জলবায়ু সুরক্ষা নেই
ইউরোপভিত্তিক জলবায়ু থিংক ট্যাংক ইথ্রিজির জ্যেষ্ঠ আন্তর্জাতিক জলবায়ু নীতি বিশ্লেষক আলডেন মায়ার বলেছেন, ‘যখন আপনি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্য রাখবেন এবং মূল কাজগুলোর একটিও পূরণ করতে পারবেন না, তখন বাগাড়ম্বর ও বাস্তবতার মধ্যে বিশাল ফারাক দেখা যাবে।’
জলবায়ু সুরক্ষা তরান্বিত করার জন্য বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন উন্নয়নশীল দেশগুলার জন্য তহবিল আরও বাড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছে। অন্যদিকে, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আজারবাইজান এবং ২০২৫ সালে জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক ব্রাজিল-সব দেশই জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। একই ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রেও।
প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষরকারীদেরও পরের বছর নতুন জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা উপস্থাপন করতে হবে। তবে হ্যোহনের মতে, বেশির ভাগ দেশই এখনো এর খসড়াই তৈরি করেনি।
মায়ারের আশা, শিল্পোন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজনের জন্য তহবিল দ্বিগুণ করার বিষয়টি আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবারের সম্মেলনে। অভিযোজন ব্যবস্থার মধ্যে ঝড় বা বন্যা, উপকূলীয় সুরক্ষা, শহরগুলোয় তাপ মোকাবিলার জন্য সবুজ স্থান বা ঝড় বা বন্যা এলাকায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য উন্নত সুরক্ষার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এর জন্য বার্ষিক প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার বেশি দেওয়ার আলোচনাটি এরই মধ্যে আলোচ্য তালিকায় রয়েছে।
লস অ্যান্ড ড্যামেজের নতুন তহবিলের বিষয়টিও আলোচনার জন্য নির্ধারিত রয়েছে। এ তহবিলের জন্য প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি রয়েছে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার।
জার্মানির সবুজ দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি থিংক ট্যাংক হাইনরিশ ব্যোল ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় নয়টি বিপর্যয়কর জলবায়ু দুর্যোগের কারণে প্রায় ৩৭ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। চীন বা ধনী তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জলবায়ু তহবিলে অংশ নেওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে বিতর্ক এ বছরের সম্মেলনে আবারও তুঙ্গে উঠবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকেরা।
মার্কিন নির্বাচনের ফল : দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের লক্ষ্য ধরে রাখা যাবে?
কোভিড-১৯ মহামারির দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবের ফলে বিশ্বজুড়েই অর্থনৈতিক টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী সামরিক ব্যয়ও বেড়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম কার্বন নির্গমনকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচন জলবায়ু নিয়ে আলোচনাতেও প্রভাব ফেলবে এবং জলবায়ু অ্যাকশনের সমর্থকদের এটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প জলবায়ু বিজ্ঞানের ওপরই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, বেশ কয়েকটি পরিবেশসংশ্লিষ্ট আইন বাতিল করেছিলেন এবং প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক নির্বাচনি প্রচারণায় তিনি স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন, দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হলে তিনি জলবায়ু অ্যাকশনবিরোধী প্রেসিডেন্টই থাকবেন এবং তার নেতৃত্বেই কয়লা, তেল ও গ্যাস উত্তোলন একটি অগ্রাধিকারের বিষয় হবে।
ফসিল ফুয়েল নন-প্রলিফারেশন ট্রিটি ইনিশিয়েটিভের হারজিৎ সিং আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন, আন্তর্জাতিক চুক্তির প্রতি অবহেলা এবং জলবায়ু অর্থ প্রদানে অস্বীকৃতি সংকটকে আরও গভীর করে তুলবে।’ তিনি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ু প্রতিশ্রুতি থেকে ট্রাম্পের পিছু হটার আভাস সংকট ভারাক্রান্ত আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা আরও সংকটে পড়ার হুমকিতে ফেলেছে।
ডয়চে ভেলে থেকে
টিম শাউয়েনবার্গ : ব্রাসেলসভিত্তিক জলবায়ুবিষয়ক সাংবাদিক