জ্বালানি সংকটের সমাধান কোন পথে
মো. আব্দুর রাজ্জাক
প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গুণিজন বলেন, বাঙালির বিদ্যা কম, বুদ্ধি বেশি। অতি অল্প সুবিধা এবং নগণ্য লাভের নেশায় সুদূরপ্রসারী ও দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের সম্ভাবনাও এক তুড়িতে উড়িয়ে দেওয়ার দৃষ্টান্তে বঙ্গদেশীয়দের জুড়ি মেলা ভার। শিল্প খাতে দেশ যখন অনুন্নত ছিল, তখন উদ্বৃত্ত জ্বালানির আত্মবিশ্বাসে জ্বালানির ঘাটতি মেটাতে টেকসই ব্যবহারের দিকে খেয়াল রাখা হয়নি। তেমনি বর্তমানে ঘাটতি চাহিদা মেটাতে নিজের সার্বভৌম সম্পদ উত্তোলনের ব্যবস্থা না করে দেশ আমদানির দিকে ঝুঁকছে। ফলে দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে অর্থনীতি ও বাণিজ্য খাত।
জল ও জ্বালানির নিরাপত্তা যে কোনো দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, ভৌগোলিক অখণ্ডতার নিরাপত্তার সর্বোচ্চ পরোক্ষ নিয়ামক এবং সবল অর্থনীতির প্রধান নিশ্চায়ক। অর্থনীতিতে ‘ডমিনো ইফেক্ট’ হলো এমন কিছু ঠেস দেওয়া পরস্পর নির্ভরশীল ক্ষেত্র, যেখানে একের ব্যর্থতা বা ধাক্কায় অন্যটির পতন হয়, তখন এ পতনকে বলা হয় ‘ডমিনো টপলিং’। বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতির ডমিনো টপলিংয়ের কেন্দ্রীয় কারণ হিসাবে বিবেচনা করা হয় জ্বালানি সংকটকে।
জ্বালানি সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিল্পোৎপাদন প্রভাবিত হয়। ফলে দেশের রপ্তানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দেশীয় বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। কাজেই জ্বালানি সংকটের প্রভাব রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় জীবনের সব অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে বিষিয়ে তোলে। অথচ জ্বালানি নিরাপত্তাই যে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এ উপলব্ধি যতটা প্রগাঢ় ও দূরদর্শিতাপূর্ণ হওয়া উচিত, তা হয়ে উঠছে না।
দেশে আবিষ্কৃত ২৯টি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে ২০টি থেকে মজুতকৃত ২৯.৭৮ টিসিএফ গ্যাসের ২০.৩৩ টিসিএফ উত্তোলন শেষ হয়েছে। গড়ে বার্ষিক এক টিসিএফ গ্যাসের চাহিদা মেটানোর পর আগামী ৭-৮ বছরের মধ্যেই দেশের জ্বালানি মজুত শূন্য হয়ে পড়বে। চলতি অর্থবছরে দেশের জিডিপিতে শিল্প ও সেবা খাতের অবদান ৫১.৩৮ শতাংশ, যা সম্পূর্ণভাবে জ্বালানিনির্ভর হওয়ায় বিকাশমান শিল্প খাতে জ্বালানির সংকট দেশের অর্থনীতিতে অশনিসংকেত হয়ে আসছে।
সবল অর্থনীতির দেশ বলতে বোঝায় মূলত কোনো দেশ হঠাৎ কোনো শকের পরও টিকে থাকতে পারে কিনা কিংবা সহজেই ঘুরে দাঁড়াতে পারে কি না তার সক্ষমতা থাকা। বাংলাদেশ এখনো সবল অর্থনীতির স্থিতিশীল রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিত রচনা করতে পারেনি। এ কথা অনস্বীকার্য, ২০৩০ সাল নাগাদ জ্বালানি খাত পুরোপুরি আমদানিনির্ভর হয়ে গেলে দেশের অর্থনীতি স্থায়ী সংকটের মধ্যে পড়বে।
জ্বালানি খাত অতীত কিংবা বর্তমানে কখনোই টেকসই পরিকল্পনার দেখা পায়নি। ফলে মহাগুরুত্বপূর্ণ এ খাতটি দাঁড়ানোর মতো কংক্রিট পাটাতনের অভাবে সর্বদাই সংশয়ের ধোঁয়াশায় আটকে থেকেছে। নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলো নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে পেশাদার নেতৃত্বের জায়গায় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে হরহামেশাই পথ হারিয়েছে জ্বালানি খাত। সিলেটের বিবিয়ানায় উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্রটি যখন আবিষ্কার হয়, তখন প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়, দেশ গ্যাসের উপর ভাসছে। দেশ শিল্পায়নে যেহেতু অনুন্নত, তাই মজুতকৃত বাড়তি গ্যাস রপ্তানি করলে দেশ আর্থিকভাবে লাভবান হবে এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত দিতেও সুবিধাভোগী শ্রেণি একসময় সক্রিয় ছিল। ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত দেশে কোনো গ্যাস আমদানি করতে হয়নি, কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে ঘাটতি পূরণে শুরু হয় এলএনজি আমদানি। বিগত ছয় বছরে পেট্রোবাংলা এক লাখ কোটি টাকা খরচ করেও লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। নানাবিধ সমস্যার ঘেরাটোপে জ্বালানি খাতের উন্নয়ন তো দূরের কথা, উঠে দাঁড়ানো ক্ষমতাও যেন হারিয়ে ফেলছে দিন দিন।
দেশে চলমান গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় দেশীয় কোম্পানির উত্তোলন সক্ষমতা ২০-৩০ শতাংশ মাত্র, যেখানে বিদেশি কোম্পানিগুলোর ৭০ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে মজুতকৃত গ্যাসের বিশাল অংশ লোকসানের খাতায় যোগ হচ্ছে। ২০১১ সালে ফ্রান্সের স্লামবার্জার কোম্পানি এ সমস্যার উত্তরণে ধরে ধরে প্রায় ৪৯টি কূপে কার্যকর সমাধান দিলেও শেষ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। চলতি অর্থবছরে ১০০টি নতুন কূপ খননের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও আগের কূপগুলোয় আরও গভীর অনুসন্ধান চালানো হয়নি। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম বলেছেন, ‘তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের সব কূপ নদীর পশ্চিম পাড়ে, বরাবর নদীর পূর্ব পাড়ে গ্যাসপ্রাপ্তির সমূহ সম্ভাবনা থাকলেও উত্তোলনে পরীক্ষাকূপ খননের দিকে যাওয়া হয়নি।’
২০১২ ও ২০১৪ সালে মিয়ানমার ও ভারতের কাছ থেকে বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশের প্রায় ১,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলে সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা হয়। জলসীমা সমস্যা মীমাংসার পর প্রতিবেশী দেশ দুটি অফশোর গ্যাস উত্তোলনে গেলেও বাংলাদেশ অফশোর অঞ্চলে মাল্টিক্লায়েন্ট সিসমিক সার্ভেই সম্পন্ন করতে পারেনি। ২০১৫ সালে নরওয়েজিয়ান কোম্পানি টিজিএস এবং ফ্রান্সের স্লামবার্জার সিসমিক সার্ভের দরপত্র পেলেও কাজ শেষ করেনি। সমুদ্রব্লকে পেট্রোলিয়ামের সম্ভাব্য মজুত, গভীরতা, উত্তোলনযোগ্য সফলতার ব্যাপারে সংশয়ের ফলে ব্রিটিশ, জার্মান, ভারতীয়, কোরিয়ান বা মার্কিন কোনো কোম্পানির সঙ্গেই সরকার পিএসসি সই করতে পারছে না। কোম্পানিগুলো কী দামে গ্যাস বিক্রি করবে, করপোরেট ট্যাক্সে রেয়াতে কী সুবিধা পাবে-এসব নিয়েও কাটছে না জটিলতা। এছাড়া সাগরে গভীর ও অগভীর অংশের ২৬টি ব্লকের একমাত্র সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রটিও ইতোমধ্যে পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়েছে। গভীর সমুদ্রে ১৫টি এবং অগভীর অংশে ৯টি ব্লক প্রস্তুত রয়েছে দরপত্রের জন্য। উদ্বেগের বিষয়, বাংলাদেশ যত বেশি বিলম্ব করছে, তত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে; কারণ পাশের ব্লকগুলোতে থেমে নেই ভারত ও মিয়ানমারের দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস উত্তোলন।
গ্যাসের মজুত ফুরিয়ে আসছে। ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ জ্বালানি মজুতশূন্য হলে পুরোপুরি আমদানিনির্ভর হয়ে এখনকার মতোই বৈশ্বিক স্পট মার্কেটে বিডিং সিস্টেমের শরণাপন্ন হতে হবে। সমস্যা হলো, স্পট মার্কেটে করোনার মতো দীর্ঘমেয়াদি দুর্যোগ, জ্বালানিসমৃদ্ধ দেশগুলোর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া কিংবা অবরোধ আরোপের নামে বিশ্ববাজারে কম জ্বালানি উত্তোলনের মাধ্যমে জোগানে ঘাটতি তৈরি করায় হু হু করে জ্বালানির দাম বেড়ে যায়। শিল্পোন্নত দেশগুলোর সঙ্গে বিডিংয়ে বাড়তি মূল্যের ভারসাম্যে সরকারের ভর্তুকির পরও তখন দেশের পণ্য ও পরিষেবা মূল্য লাগামহীন হয়ে পড়ে।
বলা হয়ে থাকে, গবেষণা খাতের ৯৮ শতাংশ অপচয়, ২ শতাংশ কার্যকর। কিন্তু ২ শতাংশ কার্যকর হলেও এ সামান্য অংশের বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। কাজেই সরকারকে অনাগত ভবিষ্যতের প্রতি লক্ষ রেখে বঙ্গোপসাগর ও স্থলভাগের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের টেকসই পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে। কার্যক্রম শুরুর অন্তত ৮-১০ বছর পর কাঙ্ক্ষিত জ্বালানির ব্যবহার সম্ভব হয়। কাজেই যত দেরি হচ্ছে, আমরা ততই পিছিয়ে পড়ছি, দূরতম সম্ভাবনাও কঠিনতর হয়ে পড়ছে দিন দিন। উপলব্ধির বদলে বিক্ষোভ, পরিচ্ছন্ন চিন্তার বদলে উদ্দেশ্যহীন ভাবাবেগ আমাদের কোনোই পথ দেখাবে না। আগামী সরকার জ্বালানি খাতের বিপর্যয় কাটাতে টেকসই-সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ নেবে এবং দেশীয় জ্বালানি খাতকে সমৃদ্ধির পথ দেখাবে, এটাই জনগণের কাম্য।
মো. আব্দুর রাজ্জাক : প্রকৌশলী ও প্রাবন্ধিক