ছেলেবেলার অনেক কিছুই ভুলে যায় মানুষ, তবে গল্পগুলো থেকে যায়। বৃষ্টিস্নাত শুক্রবারের সন্ধ্যায় বাড়ির ভেতর-বারান্দায় গোল হয়ে বসে ভাই-বোনদের সঙ্গে শোনা গা ছমছম করা গল্প কী করে ভোলা যায়? গল্প কেবল শৈশব গড়ে না। গল্পই গড়ে পরিবার, গোষ্ঠী, এমনকি সাম্রাজ্য। অথচ সেই গল্পের সাহচর্য না নিয়ে, গল্পকে সম্বল না করে আমরা জ্ঞান বিলাই, বিজ্ঞান প্রচার করি। সমাজ বদলানোর চেষ্টায় জটিল অঙ্ক আর উপাত্তের দ্বারস্থ হই। জলবায়ু পরিবর্তনের কৃষ্ণমেঘকে বর্ণনা করতে আমরা কবিদের দূরে ঠেলি, পুরাণকে অবান্তর বলে উড়িয়ে দেই; কল্পকথাকে, শ্লোককে অগ্রাহ্য করি। উষ্ণায়নের নিয়ম আর সংখ্যার ধূম্রজালে ধরিত্রীকে আচ্ছন্ন করার অনেক আগেই আমরা হারাই মানুষকে, মানুষের সদিচ্ছাকে। গল্পকে আশ্রয় করেই তাই যুদ্ধ হবে উষ্ণায়নের সঙ্গে। গল্পের কাঁধে ভর করেই গ্রিক দেবতা এটলাসের মতো ধারণ করা যাবে পৃথিবীকে। এখন তাই গল্পের সময়।
মানুষ-প্রজাতির শ্রেষ্ঠত্বের পেছনে সত্তর হাজার বছরের পুরোনো ‘চৈতন্য বিপ্লব’ বা কগনিটিভ রেভ্যুলুশনকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। প্রাচীন মানুষ নিজ গোত্রে দেড়শ’র মতো অনুসারী নিয়ে ঘুরে বেড়ালেও চৌদ্দ হাজার বছর আগে, কৃষি বিপ্লবের পর থেকে ঘরবৈঠা হতে শুরু করে তারা। এক ঘর থেকে দুই ঘর, তা থেকে গ্রাম, এরপর সাম্রাজ্য গড়ার দিকে এগোয় মানবজাতি। তবে এক্ষেত্রে জরুরি হয়ে দাঁড়ায় বিপুলসংখ্যক মানুষকে একটি চিন্তার, ধারণার, বা ইজমের অনুসারী করে তোলা। লাগামহীন, সৃষ্টিশীল একদল বিপ্লবীকে নিয়ন্ত্রণে আনতে যেন শ্রান্ত হয় সম্রাট আর রাষ্ট্রনায়করা। গল্প হয়ে দাঁড়ায় এই অনুসারী গড়ার প্রচ্ছন্ন যন্ত্র। তন্ত্রের গল্প, স্বাধীনতার গল্প, রাষ্ট্র আর আত্মপরিচয়ের গল্প একটি নিরবচ্ছিন্ন সময়ের সুতোয় গাঁথে মানুষকে। আমরা হয়ে দাঁড়াই গল্পের প্রজাতি।
অথচ গণনা আর সংখ্যার উদ্ভব ও ব্যবহার এসেছে অনেক পরে। আজ থেকে মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে সাম্রাজ্য পরিচালনার স্বার্থে সুমেরীয়রা দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ায় (টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদীর মাঝে অবস্থিত আজকের পূর্ব সিরিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্ক, আর ইরাক) প্রথম লিখিত লিপির উদ্ভাবন করে। মাটির ফলকে খোদাই করে তৈরি এই লিপি কেবল গণনার কাজে ব্যবহৃত হতো। সুমেরীয়দের এই স্ক্রিপ্টটি কিউনিফর্ম নামে পরিচিত। ইতিহাসে এমনই কাছাকাছি সময়ে মিসরে হায়ারোগ্লিফিক্স আর চীনে তাদের লিখিত লিপিও প্রবর্তিত হয়। গণনার ইতিহাসে আরেকটি উদ্ভাবনের উল্লেখ জরুরি। সুমেরীয়দের কিউনিফর্ম আবিষ্কারের কিছু পর দক্ষিণ আমেরিকায় লিখিত নয়, একটি ভৌত গণনা পদ্ধতির উদ্ভাবন হয়। এর নাম ছিল কিপু। নানা রঙের দড়িতে গেরো দিয়ে তৈরি এই গণনা পদ্ধতি। একেক রঙের দড়ি, আর তাতে দেওয়া গেরো আর গেরোর সংখ্যার একেক মূল্য। এই ভৌত গণনাপদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে ইনকা সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটেছিল। উড়ুকের গিলগামেশের সময়ে প্রবর্তিত সুমেরীয় লিপি কিংবা ইনকাদের কিপু, গণনা আর কর আদায়ের হিসাব রাখত। সেই লিপিতে কাব্য রচনা হতো না, গল্প বলা যেত না। সংখ্যা গণনায় শোষণ চলতে পারে, আত্মার খোঁজ যে সেখানে মেলে না। তার জন্যই দরকার ভাষার, কাব্যের, সাহিত্যের, অর্থাৎ গল্পের।
দেশে-দেশে আর গোত্রভেদে গল্পের, কল্পকথার ও পুরাণের নানা চরিত্র তৈরি হয়। এদের একেক চেহারা আমরা দেখি। গ্রিক মিথের প্যান্থিয়নে জিউস তার শাসন চালায়, যখন মহাভারতে লড়ে অর্জুন আর রামায়ণে ধ্বংসলীলা চালায় রাবন। তবে গোত্রে-গোত্রে গল্পের সমসত্ত্বতাও দেখা যায়। হাজার বছরের ব্যবধানে কিংবা সহস্র মাইল দূরবর্তী অবস্থানে থেকেও একই গল্প যেন বলতে চায় মানুষ। নূহ (আ.) নবির প্লাবনের কথা আমরা নিশ্চয়ই জানি। খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ শতকে পৃথিবী যখন মহাপ্লাবনে ভাসতে থাকে, তখন নূহ (আ.) নবি নৌকায় বিশ্বাসীদের নিয়ে আশ্রয় নেন। সেই নৌকাই হয়ে দাঁড়ায় পরিবর্তিত পৃথিবীর নতুন জনপদ। এটি আমাদের আদি সৃষ্টিগল্প বৈকি! এমন গল্প কিন্তু হিন্দু পুরাণেও রয়েছে। সত্যব্রত মনু রাজার মৎস্য পুরাণে মহাজাগতিক বন্যা ও তা থেকে রক্ষার জন্য প্রেরিত মাছের গল্প অলীক শোনালেও তা নূহের (আ.) প্লাবনসংক্রান্ত গল্পের সঙ্গে মিলে যায়। জানলে আশ্চর্য হতে হয় যে, এমন গল্প প্রচলিত আছে মধ্য-যুক্তরাষ্ট্রের নাভাহো গোত্রের সৃষ্টিকথায়ও। নাভাহোদের বিশ্বাস, পৃথিবীর বিবর্তনে তারা এখন বাস করছেন পরিবর্তিত চতুর্থ পৃথিবীতে। সৃষ্টির পরিক্রমায় প্রথম পৃথিবী ছিল অন্ধকার, কীটময়। দ্বিতীয় পৃথিবী ছিল নীলাভ, যেখানে পশুপাখিদের বিস্তার ঘটে। তৃতীয় হরিদ্র পৃথিবীতে নাভাহোদের পূর্বসূরিদের জন্ম ও বিকাশ ঘটতে শুরু করে। তারা ছিলেন পুণ্যবান নাভাহো। তবে এই তৃতীয় পৃথিবীর মানুষ যখন প্রকৃতির সঙ্গে, প্রাণীকুলের সঙ্গে বিবাদে আর সংঘর্ষে জড়ায়, তখন শাস্তিস্বরূপ নেমে আসে ভয়াল বন্যা। পুণ্যবান নাভাহোরা কাঠঠোকরাকে আকাশে একটি মুক্তির পথ খুঁজে দিতে বলেন। কাঠঠোকরা বানের জল আসার আগে একটি ছোট্ট ছিদ্র তৈরি করতে সক্ষম হয়। তবে তা সব পুণ্যবান নাভাহোদের মুক্তির জন্য যথেষ্ট ছিল না। বন্যার পানি বাড়তে শুরু করে। পুণ্যবানরা উপায়ান্তর না দেখে একটি কাঠের স্তম্ভ তৈরি করতে লেগে পড়েন। সেই আকাশছোঁয়া স্তম্ভ যখন কাঠঠোকরার তৈরি ছিদ্রের কাছে পৌঁছে, তখন মুক্তিকামী পুণ্যবানরা সেই ছিদ্র দিয়ে পালিয়ে আসেন চতুর্থ পৃথিবীতে। আর এটিই আমাদের আজকের পৃথিবী। নূহের নৌকা, মনু রাজার মৎস্য, কিংবা নাভাহোদের কাষ্ঠস্তম্ভ-এসবই মানবমুক্তির সোপানমাত্র। প্রকৃতির রোষ থেকে বাঁচার একমাত্র পথ যেন এই সমসত্ত্ব কল্পকথা, মহাপ্লাবনের গল্প।
জলবায়ু পরিবর্তনের আজকের গতিপথ বিপজ্জনক। শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী পৃথিবীতে উন্নয়নের নামে মানুষ যেভাবে প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, তা থেকে মুক্তির পথ কখনো তথ্যবহুল হতে পারে না। তথ্য আর বিজ্ঞানের ভিত্তি যেমন উষ্ণায়নের গতি ও এর পরিণতির পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য জরুরি, সেই তথ্যের আতিশয্য তেমনি মানব আচরণে কখনো পরিবর্তন বা পরিমার্জন আনতে পারবে না। আত্মশুদ্ধির জন্য দরকার পড়বে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের আত্মার যোগ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘটে যাওয়া ঝড়, বন্যা, খরা, আর দাবানলকে বুঝতে তাই গল্পের আশ্রয় নিতেই হবে। আজ কেবল ক্ষমতাধর প্রতীচ্য, আবিষ্কারকামী বিজ্ঞানী, আর প্রকৌশল বা যন্ত্রযোগে উষ্ণায়নের এই প্রলয়কে রোখা সম্ভব নয়। আমাদের প্রত্যেককে পৃথিবী বাঁচানোর এই যুদ্ধে শামিল হতে হবে। গল্পের চরিত্র দিয়ে, উপমা থেকে জলবায়ু পরিবর্তনকে বুঝতে হবে, বিজ্ঞানকে বুঝতে হবে। গণমানুষের এ লড়াইকে জারি রাখতে তাই গল্প জাগরূক থাকুক।
নাভিদ সালেহ : অধ্যাপক, পুরঃ, স্থাপত্য ও পরিবেশ কৌশল অনুষদ, ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস অ্যাট অস্টিন, যুক্তরাষ্ট্র