উপযোগিতা মূল্যায়ন ছাড়া প্রকল্প নয়
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
দেশের জনগণ পতিত স্বৈরাচারের উন্নয়নের অনেক গালগল্প শুনে এসেছে। অতিরঞ্জিত তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-গবেষণা সংস্থা থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হতো কথিত এসব উপাখ্যান। দৃশ্যমান কিছু অবকাঠামো মানুষকে অনুপ্রাণিত করলেও এসবের পেছনে বিশাল দুর্নীতির চালচিত্রের প্রকাশ জনগণকে হতবাক করেছে। মানুষকে অন্ধকারে রেখে লুটেরাদের কদর্য কর্মযজ্ঞ প্রায় আড়ালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এসব গর্হিত কর্মের সত্যতা প্রতিনিয়ত উন্মোচিত হচ্ছে। লুটপাটের এ বিরল দৃষ্টান্তে নির্মিত হচ্ছে ক্ষোভ-যন্ত্রণা ও ঘৃণার বিশাল প্রাচীর। ব্যাংকগুলো থেকে অবৈধ উপায়ে নানা কারসাজিতে অর্থ লোপাট আর্থিক ব্যবস্থাকে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছে। হাজার কোটি টাকার অর্থ পাচারের পেছনে পৃষ্ঠপোষক-সহায়তাকারী ও ঘৃণ্য অপরাধীদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারের আওতায় আনা সময়ের জোরাল দাবি।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের ফলে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগগুলো প্রশংসিত। যেসব দেশে পাচারকৃত অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে, সেসব দেশ থেকেও এ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহে তৎপর হয়েছে বিভিন্ন সংস্থা। আশাজাগানিয়া বিষয় হচ্ছে, এ ব্যাপারে বিশ্বসংস্থাসহ সব উন্নয়ন সহযোগী সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছে। আশা করা যায়, স্বল্প সময়ের মধ্যে ইতিবাচক ফল মিলবে, অর্থাৎ দেশের সম্পদ দেশে ফিরে আসবে। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করা গেলে দেশে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যাবে। অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হবে।
সম্প্রতি জাতীয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য দেশের ব্যাংক, জ্বালানি, ভৌত অবকাঠামো ও আইসিটি-এ চার খাতে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। ৩১ অক্টোবর ইকোনমিক রিপোটার্স ফোরামের (ইআরএফ) সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, ‘এসব খাতের প্রকল্পগুলোয় অতিমূল্যায়ন, অনিয়ম, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প তৈরি এবং বড় বড় চুরির ঘটনা ঘটেছে। দেশের চলমান অর্থনীতির ভঙ্গুর অবস্থা ও সংকটের মূলে রয়েছে স্বেচ্ছাচারী রাজনীতি ও অনাচারী অর্থনীতি। বিগত সরকারের সময়ে অনাচারী অর্থনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য স্বেচ্ছাচারী অর্থনীতি সৃষ্টি করা হয়েছিল। দেশের অর্থনৈতিক সংকটের মূলে রাজনৈতিক বিবেচনায় পক্ষপাতদুষ্ট বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে চুরি হয়েছে। এতে যতটুকু অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে, তার চেয়ে বেশি অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্বৈরাচারী রাজনীতি অনাচারী অর্থনীতির সৃষ্টি করেছে, নাকি অনাচারী অর্থনীতি স্বৈরাচারী রাজনীতির জন্ম দিয়েছে সেটি খতিয়ে দেখা দরকার। স্বৈরাচারী রাজনীতির অবসম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে আজকের বিকলাঙ্গ অর্থনীতি। বড় বড় প্রকল্পের নামে শ্বেতহস্তিতে পরিণত হয়েছে। হাইটেক পার্কসহ বিভিন্ন প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা এবং ফলাফল কী হবে, সেসব বিবেচনা করা হয়নি।’
গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে দেশের পরিবহণ ও যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, শিক্ষা, গৃহায়ন, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, কৃষি, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রতিবছরের বাজেটে প্রকল্পগুলোয় দিতে হয়েছে মোটা অঙ্কের বরাদ্দ। পরিকল্পনা কমিশনের সূত্র অনুসারে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) থাকা প্রকল্পের সংখ্যা ১ হাজার ৩২১ এবং উন্নয়ন বাজেটের আকার ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়া মেগা প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। উল্লিখিত অর্থবছরে এ প্রকল্পে বরাদ্দ রয়েছে ১০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত এ প্রকল্পের আওতায় খরচ হয়েছে ৬৪ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা। এর পরের অবস্থানে আছে মেট্রোরেল লাইন-৬ প্রকল্প। চলমান অর্থবছরে এ প্রকল্পে বরাদ্দ ১ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা এবং এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ২০ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা। আরও উল্লেখযোগ্য প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে-মেট্রোরেল লাইন-১ ও ৫, যমুনা রেল সেতু, দোহাজারী-রামু-গুনদুম রেললাইন, মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন, পায়রা বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন, সার্পোট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ এবং সাসেক সংযোগ সড়ক প্রকল্প, এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ ইত্যাদি প্রকল্প। সব প্রকল্পেই হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে রাশিয়া-চীন-জাপান ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিপি) বৈদেশিক ঋণে।
অর্থনীতিবিদ ও অবকাঠামো বিশেষজ্ঞদের মতে, চলমান প্রকল্পগুলোর একটি বড় অংশ নেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। আবার এমন কিছু প্রকল্প রয়েছে, যেগুলোর অর্থনৈতিক গুরুত্ব কম। অস্বাভাবিক ব্যয়ের অভিযোগও রয়েছে একাধিক প্রকল্পে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ, বিআরটিসহ অনেক প্রকল্প থেকে কাঙ্ক্ষিত রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। অনেক প্রকল্প থাকবে আন্ডার ইউটিলাইজ্ড। যদিও প্রকল্পগুলো সম্পন্ন হয়ে গেছে বিধায় এখন আর কিছু করার নেই। তবে এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প যেন আর না নেওয়া হয়, সে ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। তাছাড়া প্রকল্পগুলোর ঋণের কিস্তি পরিশোধ যখন শুরু হবে, তখন দেশের অর্থনীতিতে বিপদ নেমে আসতে পারে। ইতোমধ্যে এর দৃশ্যমানতা কিছুটা আঁচ করা যাচ্ছে। এ সংকট থেকে উত্তরণের উপায়ও সরকারকে খুঁজতে হবে। এটি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের একটি অন্যতম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। উদ্ভূত প্রেক্ষাপটে অনেকেই রাজনৈতিক বিবেচনায় গৃহীত প্রকল্পগুলোকে নতুন করে যাচাই-বাছাইয়ের পরামর্শ দিয়েছেন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই প্রকল্পে ব্যয় সংকোচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি জানান, বিগত সরকারের সংসদ সদস্যদের নির্বাচনি এলাকার জন্য অসংখ্য প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। এগুলোর অনেক কাজ চলমান। অনেক প্রকল্প একনেকে যাওয়ার অপেক্ষায়। এগুলোর অগ্রাধিকার আছে কি না এবং কতটুকু সুবিধা বয়ে আনবে, সেগুলোর মূল্যায়ন করা হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প কাটছাঁট হতে পারে। এমনকি বাস্তবায়নাধীন কম-প্রয়োজনীয় প্রকল্পও বন্ধ করার পক্ষে তিনি নিজের অবস্থান সুস্পষ্ট করেছেন। ১০ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে টাকা খরচের উৎসবের লাগাম টানতে শুরু করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। ফেরত পাঠানো হয়েছে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের ১৩টি প্রস্তাব। প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে-তিলমারী নদীবন্দর, মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন, কালুরঘাট রেল ও সড়ক সেতু, রংপুর সিটি করপোরেশনের সড়ক উন্নয়ন ও ফরিদপুর-বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক ফোর লেন করতে ভূমি অধিগ্রহণ। ফেরত পাঠানোর পাশাপাশি খতিয়ে দেখা হচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট, চট্টগ্রাম-দোহাজারী ডুয়েলগেজ রেলপথ এবং মেট্রোরেল লাইন ওয়ান ও ফাইভ প্রকল্পের খরচ। সংসদ বিলুপ্ত হওয়ায় সাবেক এমপিদের নির্বাচনি এলাকায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য থোক বরাদ্দের প্রায় হাজার কোটি টাকার প্রকল্পগুলোও বাদ দেওয়া হয়েছে।
গত ৩০ অক্টোবর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারীকৃত আদেশে বলা হয়েছে, জনগণের মতামত না নিয়ে আর কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া যাবে না। এখন থেকে উন্নয়ন প্রকল্পের প্রস্তাব তৈরি করে তা ওয়েবসাইটে দিয়ে জনগণের মতামত নিতে হবে। এরপর জনগণের মতামত পর্যালোচনা করে প্রকল্প প্রস্তাব পাঠাতে হবে পরিকল্পনা কমিশনে। কোনো প্রকল্প প্রস্তাব সম্পর্কে যদি জনগণ নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন, তাহলে সেটি অনুমোদন করবে না পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। ওই আদেশমতে, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় ও বিভাগ প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করার পর জনগণকে জানানোর বিষয়গুলো হচ্ছে-প্রথমেই প্রকল্পের প্রাথমিক তথ্য (যেমন খরচ, মেয়াদ, উদ্দেশ্য ইত্যাদি) দিতে হবে। এছাড়া প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই (যদি থাকে), গ্রহণের পটভূমি ও যৌক্তিকতা, প্রকল্প এলাকা, আর্থিক ও অর্থনৈতিক সম্ভাব্য ফলাফল, পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব, দুর্যোগের ঝুঁকি ও ঝুঁকি প্রশমন পরিকল্পনার তথ্যও জানাতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক গণমাধ্যমে বলেছেন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির দৃষ্টিভঙ্গিতে এটি ভালো পদক্ষেপ। শুধু ওয়েবসাইটে প্রকাশ করলেই হবে না। কারণ, অনেকে ওয়েবসাইটে দেওয়া কারিগরি দলিলাদি দেখে বুঝবেন না। তাই সহজ উপায়ে দলিলাদি প্রকাশ করে জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা আবশ্যক। জনগণের অর্থ জনগণের কল্যাণে ব্যয় করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে যে কোনো ধরনের জনদুর্ভোগ লাঘবে এর উপযোগিতা অবশ্যই দৃশ্যমান হতে হবে।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী