Logo
Logo
×

বাতায়ন

ছন্দ-লয়-তাল কাটা ফলাফল!

Icon

বিমল সরকার

প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ছন্দ-লয়-তাল কাটা ফলাফল!

ফাইল ছবি

এসএসসি ও সমমান এবং এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলে বছরের পর বছর বোর্ডভিত্তিক কেন যে এমন ছন্দপতন ঘটে, ঘটে চলেছে-তা কিছুতেই আমার বোধগম্য হয় না। কেবলই কি ছন্দপতন, আমি অবাক হই; পাবলিক পরীক্ষায় একেকটি বোর্ডে এমন দুরতিক্রম্য ব্যবধান হয় কী করে! লাখ লাখ কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা এ কোন খেলায় মেতে উঠেছি! এ নিয়ে উদ্বেগাকুল অভিভাবকদেরই বা ভাবনা-অভিমত কী? নাকি এর পেছনে কোনো রহস্য লুকিয়ে রয়েছে?

প্রথমেই সিলেট শিক্ষা বোর্ডের কথা দিয়ে শুরু করি। সিলেট মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড স্থাপিত হয় ১৯৯৯ সালে। ২০০১ ও ২০০৩ সালে এর অধীনে প্রথমবারের মতো যথাক্রমে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষায় সিলেট শিক্ষা বোর্ডের শুরুর দিককার ফলাফল প্রসঙ্গে আমি নতুন করে এখানে আর বিশেষ কিছু উল্লেখ করতে চাই না। এ বছরের (২০২৪) এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ হওয়ার পর, গত ১৬ মে ‘দৈনিক যুগান্তর’ পত্রিকায় “এসএসসির ফলাফলে এমন ‘হ্যাট্রিক’ অপ্রত্যাশী” শিরোনামে বেশ তথ্যসমৃদ্ধ একটি লেখা প্রকাশিত হয়। অন্যান্য বছর যেমনই হোক; নিবন্ধটিতে আমি উল্লেখ করেছি, এসএসসি পরীক্ষায় টানা তিন বছর (২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪) দেশের সবকটি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে সিলেট বোর্ডে পাশের হার সবার নিচে; তার মানে একদম তলানিতে (১৯২২ সালে সর্বোচ্চ পাশের হার ৯৫.১৭-এর বিপরীতে সিলেট বোর্ড ৭৮.৮২ ভাগ, ২০২৩ সালে সর্বোচ্চ ৯০.১৮-এর বিপরীতে সিলেট বোর্ড ৭৬.০৬ ও ২০২৪ সালে সর্বোচ্চ ৯২.৩৩-এর বিপরীতে সিলেট শিক্ষা বোর্ডে পাশের হার ৭৩.৩৫ ভাগ)। বিষয়টি যে কোনো সচেতন ব্যক্তির কাছে বিস্ময়কর ঠেকবে, ঠেকারই কথা। পৌনঃপুনিক নয়, একদম ধারাবাহিক ফল-বিপর্যয়!

নানা কারণে কখনো কখনো কোনো শিক্ষা বোর্ডের ফলাফল আশানুরূপ না-ও হতে পারে, এমনকি ফল বিপর্যয়ও ঘটতে পারে। কিন্তু তাই বলে একাধিক্রমে তিন বছর! প্রশ্ন উঠাটা স্বাভাবিক যে, এ কী ধরনের শিক্ষা, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন-ব্যবস্থা? ঘটনা এখানেই সীমাবদ্ধ নেই। বিষয়টি কতটুকু আশ্বস্ত হওয়ার মতো, তাতে আমি বেশ সন্দিহান। এসএসসিতে এমন ফল-বিপর্যয়ের হ্যাট্রিকের পাশাপাশি ২০২২ সালে এইচএসসিতেও যেখানে পাশের হার সব বোর্ডের একদম নিচে, সেখানে গত মাসে প্রকাশিত ২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, অন্যসব বোর্ডকে অবলীলায় ডিঙিয়ে সিলেট বোর্ড পাশের সর্বোচ্চ হারটি (৮৫.৩৯) করায়ত্ত করে নেয়। এবারের (২০২৪) এইচএসসি পরীক্ষায় ময়মনসিংহ বোর্ডে সর্বনিম্ন ৬৩.২২ ভাগ ও যশোর বোর্ডে ৬৪.২৯ ভাগের বিপরীতে আলোচিত সিলেট শিক্ষা বোর্ডে সর্বোচ্চ ৮৫.৩৯ ভাগ পরীক্ষার্থী পাশ করে। ফলাফলে সিলেট বোর্ডের এই ‘শিরোপা’ অর্জনের পেছনে কী কারণ রয়েছে, তা-ই এখন আলোচনা ও জানার বিষয়।

২০২২ সালে এসএসসিতে সিলেট বোর্ডে যেসব শিক্ষার্থী ছিল সব বোর্ডের নিচে, তারাই কিনা দু’বছর পর (২০২৪) এইচএসসিতে পাশের হারে সব বোর্ডের মধ্যে সেরা ফলাফল করেছে! বিষয়টি সবার জন্য কেবল সুখকরই নয়, বিস্ময়করও বটে!

২.

ফলাফল বিশ্লেষণে সিলেট বোর্ডের ঠিক উলটো চিত্র দেখা যায় যশোর বোর্ডের ক্ষেত্রে। কেবল নিম্নগামিতা নয়, ফলাফলে একেবারে ধস! আমাদের কৌতূহল, এমনটাই বা কীভাবে হলো? ২০২২ সালে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় যশোর শিক্ষা বোর্ড বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করে। পাশের হারে সাধারণ নয়টিসহ মোট এগারোটি বোর্ডের মধ্যে যশোর বোর্ড সবার ওপরে, ৯৫.১৭ ভাগ। চলতি ২০২৪ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায়ও যশোর বোর্ড একেবারে শীর্ষে, পাশের হার এগারো বোর্ডের মধ্যে সবার ওপরে, ৯২.৩৩ ভাগ। কিন্তু এবারের (২০২৪) এইচএসসিতে হঠাৎ এ কী হলো? ২০২২ সালে এসএসসিতে এগারো বোর্ডে সেরা ফলাফল করে, মাত্র দুবছরের ব্যবধানে ওই শিক্ষার্থীরা ২০২৪ সালে এইচএসসিতে এমন তলানিতে (সর্বোচ্চ পাশের হার ৮৫.৩৯-এর বিপরীতে ৬৪.২৯ ভাগ) নামল কী করে (যশোর বোর্ডের সামান্য নিচে কেবল ময়মনসিংহ বোর্ড, ৬৩.২২ ভাগ)।

৩.

মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের ফলাফল বিশ্লেষণেও এমনটাই পরিদৃষ্ট হয়। ২০২২ সালে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় (দাখিল) এগারোটি বোর্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ পাশের হার যশোর বোর্ডে, ৯৫.১৭ ভাগ। আর মাদ্রাসা বোর্ডে এ হার একেবারে নিচের দিকে, ৮২.২২ ভাগ (কেবল সিলেট : ৭৮.৮২ ভাগ ও দিনাজপুর বোর্ড : ৮১.১৬ ভাগ রয়েছে মাদ্রাসা বোর্ডের নিচে)। একই পরীক্ষায় (এসএসসি ও সমমান) পরের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালেও মাদ্রাসা বোর্ডে ফলাফল-বিপর্যয় ঘটে। সেবার সর্বোচ্চ পাশের হার ৯০.১৮ ভাগের বিপরীতে মাদ্রাসা বোর্ডের শিক্ষার্থীদের অর্জন একেবারে সবার নিচে, ৭৪.৭০ ভাগ। এবার কী হলো? এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় আগের দুবছরের (২০২২ ও ২০২৩) ধারাবাহিকতায় এ বছর (২০২৪) পাশের হারে মাদ্রাসা বোর্ড রয়েছে অষ্টম স্থানে (পাশের হার ৭৯.৬৬)। অথচ কেউ বিশ্বাস করুন আর না করুন, এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় আগের সব ব্যর্থতা ও গ্লানি দূর করে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় (আলিম) ২০২২ ও ২০২৩ সালে পাশের হারে শীর্ষস্থানের কাছাকাছি (দ্বিতীয় স্থান লাভ) অবস্থানের পাশাপাশি এ বছর (২০২৪) মাদ্রাসা বোর্ড এগারো বোর্ডের মধ্যে একদম শীর্ষ স্থানটি (প্রথম) দখল করে নেয় (সর্বনিম্ন ময়মনসিংহের ৬৩.২২ ভাগের বিপরীতে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড সর্বোচ্চ ৯৩.৪০ ভাগ)।

বিশেষ কোনো বোর্ড নয়; বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাশের হার শীর্ষে, অথচ এইচএসসি ও সমমানে একদম তলানিতে; আবার এসএসসি ও সমমানে পাশের হারে ধস, অথচ এইচএসসি ও সমমানে পাশের হার একেবারে শীর্ষে-আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না, গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষায় পাশের হারে এমন অস্বাভাবিক উঠানামার হেতু কী। পাবলিক পরীক্ষায় বিভিন্ন বোর্ডের ফলাফলে চোখে পড়ার মতো এমন ছন্দপতন বা বিপর্যয়ের আরও দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে নিবন্ধটির কলেবর বাড়াতে চাই না।

৪.

স্কুল ও কলেজ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের বিভিন্ন পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা অমনোযোগী, গাফিলতি করেন; এমন অভিযোগের কথা প্রায়ই শোনা যায়। আমি নিজেও শিক্ষকতা করেছি দীর্ঘদিন। হয়তো বা এমন অভিযোগ যেমনই হোক আমাকেও স্পর্শ করে, আমার গায়েও লাগে। বিষয়টি খুবই ভাবায়। ইত্যাকার পরিস্থিতিতে ‘ছন্দ ও লয় এবং তাল কাটা’ এমন ফলাফল নিয়ে গুরুত্বসহকারে সংশ্লিষ্টদের নতুন করে ভাবা উচিত।

বিমল সরকার : কলাম লেখক, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম