আলো আনতেই ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়েছে
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
সাধারণের ভাবনা ও রাষ্ট্রপরিচালনা করা দুটো এক বিষয় নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের ষোল বছরের দুর্নীতিসহ নানা অনাচার মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। কিন্তু গণতন্ত্রহীনতা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে স্বৈরাচারী মনোভাব থাকায় তারা আমলেই নেননি মানুষের ক্ষোভের বাস্তবতাকে। এভাবে ধীরে ধীরে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল এ ঐতিহ্যবাহী দলটি। আমরা যারা দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নই, তেমন দলনিরপেক্ষ মানুষের মধ্য থেকে অনেকেই সরকারকে সতর্ক করে অনেক লেখা লিখেছি কাগজে। কিন্তু স্বৈরাচাররা কখনো অভাজনদের কথা আমলে নেন না। ফলে যা হওয়ার তাই হলো। ছাত্র আন্দোলন ও নানা শক্তির প্রভাবে শেষ পর্যন্ত গণেশ উলটে গেল। ইতিহাসে যাকে বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ। দেশে গণতন্ত্র কার্যকর না থাকলে স্বৈরাচাররা নিজেদের দুর্দমনীয় মনে করে। প্রলয় না আসা পর্যন্ত উন্মত্ততা থামে না।
সৃষ্টি জগতে মানুষের মেধা, সৃষ্টিশীলতা আর ‘অসীম’ ক্ষমতা তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছে। যখন মিসরের পিরামিডের দিকে তাকাই, তখন বিস্মিত হই। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে মরুভূমির বুকে এমন বিশাল পিরামিড কী করে বানাল প্রাচীন মিসরীয়রা! স্থাপত্যকলার এমন বৈজ্ঞানিক জ্ঞান কেমন করে অর্জন করতে পেরেছিল! কেমন করে গাণিতিক আর জ্যামিতিক হিসাব-নিকাশ সুদক্ষভাবে সম্পন্ন করে বানিয়েছিল পিরামিড-যা হাজার হাজার বছর পরও সদম্ভে দাঁড়িয়ে আছে। নীলনদের ওপারে নুবিয়ার পাহাড় থেকে বিশাল বিশাল পাথর কেটে কেমন করে নিয়ে এসেছিল মরুভূমিতে! পাথরের পর পাথর বসিয়ে সঠিক হিসাবে কেমন করে সম্ভব হয়েছে সুবিশাল ত্রিকোণ ইমারত নির্মাণ করা! তখন তো আধুনিক যন্ত্রপাতিও ছিল না স্থপতিদের হাতে। মানুষের এমন ক্ষমতা দেখে বিস্মিত হতে হয়। ১৯৮২ সালে আমি এমএ ক্লাসের ছাত্র। প্রথমবারের মতো গিয়েছিলাম আগ্রায় তাজমহল দেখতে। উপরে উঠে সমাধির ওপর চোখ পড়ল। লাল-সবুজ নানা রঙের ফুলের নকশাকাটা। ফুল, পাতা এত ঝলমল করছিল, মনে হচ্ছিল, এই মাত্র বোধহয় সংস্কার করা হয়েছে। টাটকা রং হাতে লেগে যাবে। একবার আঙুলের ছোঁয়া লাগিয়ে দিলাম। না, হাতে তো রং লাগল না! ভুল ভাঙল আমার, এ তো রং নয়! রঙিন পাথর কেটে মিনা করা হয়েছে। চারশ বছর ধরে এমনই জ্বলজ্বল করছে। তখনো বিস্মিত হয়েছিলাম মানুষের প্রতিভার কথা ভেবে।
আধুনিক যুগে তো মানুষ বিস্ময়কর ক্ষমতার প্রকাশ দেখাচ্ছে। পারমাণবিক অস্ত্রসহ নানা ভয়ংকর মারণাস্ত্র বানাচ্ছে। তা দিয়ে ক্ষমতাবানরা প্রাণ ও সভ্যতা সংহার করছে। বিশ্বের নানা দেশের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে। মহাকাশযান আর আধুনিক যন্ত্রকৌশলে মহাকাশে মানুষের বিকল্প বসতি খুঁজে বেড়াচ্ছে।
আমরা মহামারির মতো মহাবিপর্যয়ে পড়লে কিছু সময়ের জন্য হলেও থমকে যাই। তখন আবার মানুষের শক্তিকে ভীষণ সীমাবদ্ধ মনে হয়। দাপুটে দেশের শক্তিমানরাও কেমন চুপসে যান। কণ্ঠের দৃঢ়তা হারিয়ে ফেলেন। করোনাকালে মার্কিন ও তুর্কি বিমান সিরিয়ায় বোমা ফেলেনি কোনো কূটনৈতিক সমঝোতা ছাড়াই। সংঘাত বন্ধ করে আরব-ইসরাইল সুপ্রতিবেশীর মতো বসবাস করেছে। রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়েও আলোচনা-পর্যালোচনা থেমে গিয়েছিল। উপনির্বাচনে পাঁচ শতাংশ ভোট পাওয়া নিয়েও তেমন উচ্চবাচ্য করেনি কেউ। এটি অনেকটা দীর্ঘ গরমে হাঁসফাঁস প্রকৃতির পরের দশার মতো। বড় বড় এসি দিয়ে ঘর ঠান্ডা হলেও চারপাশের প্রকৃতি ঠান্ডা করার উপায় নেই। কিন্তু যখন আকাশ অন্ধকার করে ঝড়-বৃষ্টি নামে, তখন আধা ঘণ্টায় পুরো প্রকৃতি শীতল হয়ে যায়। তখনো মনে হয়, মানুষের ক্ষমতা ‘অসীম’ নয়-কত সীমিত। তবুও মানুষের বড়াইয়ের শেষ নেই।
সভ্যতার ইতিহাসের ছাত্রমাত্রই জানেন ধর্ম প্রগতিবিরোধী নয়-বরং প্রগতির উদ্দীপক। ধর্মীয় প্রণোদনা ছাড়া কোনো সভ্যতারই অগ্রগতি হতো না। প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতার কথাই ধরি। পরকালের ধারণা ওই সভ্যতায় ছিল। পাপ-পুণ্যের বিচারের কথাও ছিল। মিসরীয় রাজা ফারাওরা পরকালেও রাজত্ব করবে এমনটাই ভাবত। আর এসবকে উপজীব্য করতে গিয়ে বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন করতে হয়েছে মিসরীয়দের। মৃত ফারাওয়ের দেহ অবিকৃত রাখার প্রয়োজনে মমি বানানোর কৌশল আয়ত্ত করতে হয়েছে। ফারাওয়ের মৃতদেহ পরকাল পর্যন্ত নিরাপদ রাখতে গিয়ে স্থাপত্যকলার বিকাশ ঘটাতে হয়েছে। নির্মিত হয়েছে পিরামিড। পরকালের নানা ঘটনা পিরামিডের দেওয়ালে চিত্রিত করার মধ্য দিয়ে চিত্রকলার বিকাশ ঘটেছে। আর এসব ধর্মকথা লিপিবদ্ধ করার তাগিদেই লিখন পদ্ধতির উদ্ভব ঘটেছে। আমরা পেয়েছি মিসরীয় হায়ারোগ্লিফিক। আসলে কোনো কোনো প্রগতিবাদীদের মধ্যে ধর্ম সম্পর্কে যেটুকু নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, চর্চার অভাবে তারা বুঝতে পারেন না এর দায় ধর্মের নয়, ধর্মের অপব্যাখ্যায় নিজ সুবিধাবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে এগিয়ে আসা তথাকথিত ধর্মান্ধের। এরা ধর্মের প্রকৃত দর্শন সব সময়ই আড়াল করে একটি বিকৃত ছবি উপস্থাপন করে। এসব দেখেও কিন্তু মনে হয় মানুষের ক্ষমতা কতটা সীমাবদ্ধ। তবুও আমরা ফ্যাসিবাদের নিন্দা করলেও নিজেদের আচরণকে পর্যালোচনা করি না।
আসলে বাড়াবাড়ি-তা যত ছোটই হোক এর প্রতিফল ভালো হয় না। বিপ্লবোত্তর যুগে স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তিত বাংলাদেশ পরিচালনায় যারা দায়িত্বে এসেছেন, তাদের সামনে চ্যালেঞ্জও কম নয়। অন্যদিকে মানুষের প্রত্যাশাও অনেক। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা দায়িত্বে এসেই বলেছিলেন, বিপ্লবী ছাত্ররাই তার নিয়োগকর্তা। এ পর্যন্ত ঠিকঠাক ছিল। এক বুক শুভচিন্তা নিয়ে শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমেছিল-রক্ত দিয়েছে এতে সন্দেহ নেই। তবে এ সত্যটিও মানতে হবে, অনেক মেধাবী হলেও ছাত্রনেতাদের বয়স ও অভিজ্ঞতার কারণে রাষ্ট্র পরিচালনার মতো রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তেমনভাবে দক্ষতা অর্জন করার কথা নয়। কিন্তু দায়বদ্ধতার কারণে ছাত্রনেতাদের অনেক দাবি মেনে নিতে হচ্ছে সরকার পরিচালকদের। এতে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় স্বাভাবিক ছন্দ ব্যাহত হচ্ছে কিনা এ প্রশ্নও উঠছে। অবশ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু ম্যানেজ করা সম্ভব হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হয়, তা দেখার বিষয়।
একটি ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। সরকার গঠিত হওয়ার পর আন্দোলনের ছাত্র সমন্বয়ক থেকে শুরু করে অনেকের দাবি ছিল শূন্য হয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো যারা দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন, এমন দলনিরপেক্ষ যোগ্য মানুষ দিয়ে পূরণ করতে হবে। নতুন সরকারের মনোভাবও তেমন ছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা ঘটল না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে দলনিরপেক্ষ মানুষের বদলে দলীয় সমর্থকদেরই দেখা গেল। জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির সমর্থক হিসাবে চিহ্নিত দলীয় গুণিজনরাই নিয়োগ পেতে থাকলেন। নয়া উপাচার্যদের ক্ষমতা প্রয়োগ ও প্রশাসন বিন্যাস দেখে পূর্বতন সরকারের সময়কার কপিই মনে হচ্ছে এখন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব ম্যানেজ হয়ে যায় বলে বিপ্লবী ছাত্রনেতারাও আর এ নিয়ে কোনো আওয়াজ তুলছেন না। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে নৈরাজ্য ফিরতে শুরু করেছে। আচরণে, দম্ভে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরকে শিগ্গির ছাত্রলীগের মতো সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রভু হওয়ার চিত্র দেখলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। তবে ধারণাটি ভুল হলে সবাই মুক্তির আনন্দ পাব।
কিন্তু ঈশান কোণে কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে। এখন ভিন্ন পোশাকে চাঁদাবাজি ও কমিশন বাণিজ্য একটু একটু করে শুরু হয়ে গেছে। বিভিন্ন মার্কেট, ফুটপাত, বাসস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি একইভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। বিগত ষোলো বছরে যারা অভুক্ত ছিল, তারা এখন প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কিন্তু এদের রাশ টানতে সরকার পক্ষকে তেমন সক্রিয় হতে দেখছি না। প্রথম কদিন পার হওয়ার পর ছাত্রনেতাদের পক্ষ থেকেও কোনো প্রতিরোধ কর্মসূচি দেখা যাচ্ছে না। ২ নভেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হলো কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য এখন আবার বেড়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকারের লিগ্যাসি এখনো বহন করতে হবে কেন?
কিছুদিন আগে এক মাননীয় উপদেষ্টা বলেছেন, দেশের মানুষ এখন স্বাধীনভাবে চলতে পারছে। কথাটি কি ঠিক? এ সময়ে ফ্যাসিবাদী আচরণ থেকে আমরা মুক্ত হতে পেরেছি? ২ নভেম্বর বর্তমান সরকারের ঘনিষ্ঠ জামায়াতে ইসলামীর আমির ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে সবাইকে বিভেদের রাজনীতি থেকে এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে আহ্বান জানিয়েছেন; কিন্তু বিপ্লবী ছাত্রদেরই একটি অংশ জাতীয় পার্টির অফিসে হামলা করেছে বলে অভিযোগ। অপছন্দের রাজনীতিকদের নির্মূল করার ঘোষণা দিচ্ছে এ সরকারের ঘনিষ্ঠ অন্যপক্ষ।
দেশের মানুষ কতটুকু স্বাধীনভাবে চলতে পারছে বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছে? নিজেকে দিয়েই দেখছি, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছাত্রলীগের নৃশংসতা এবং সেই সময়ের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতি নিয়ে অনেক কথা বলতে পারলেও এখন সেভাবে পারছি না।
আইন ও বিচার ক্ষেত্রে কতটা স্বাধীনতা ভোগ করছি? সরকার ক্ষমতায় আসার পর হুটহাট করে চিহ্নিত শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জামিনে মুক্তি পেতে থাকল। আগে অভিযোগ ছিল স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদের পছন্দমতো আদালতের বিচারপতি সাজাত আর ‘গায়েবি মামলায়’ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের আটক করত। পাশাপাশি এক লহমায় মামলা থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মুক্ত হতেন। বর্তমান চিত্র প্রায় একইরকম। সরকারের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের বিরুদ্ধে করা মামলার দ্রুত খারিজ বা জামিন চলছে একই রকম দ্রুততার সঙ্গে। এসব দেখে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে।
তাহলে গুণগত পরিবর্তন কোথায়? মানুষ কি একই তিমিরেই থাকবে! ছাত্র-জনতা স্বৈরাচারের অপশাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই তো রাজপথে আন্দোলন শানিয়েছিল। রক্তমূল্যে স্বৈরাচারকে বিদায় করেছিল। এদেশের সচেতন মানুষ চাইবে না এমন বিপ্লবের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার গণতান্ত্রিকমুক্ত পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার আগে এ ধারার সমালোচনার মুখোমুখি হোক। কারণ এ সরকারের সফলতার সঙ্গে এ দেশের হতভাগ্য মানুষের ভাগ্য জড়িয়ে আছে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com