শুধু পলিসি রেট বাড়িয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না
এম এ খালেক
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশ ব্যাংক আবারও পলিসি রেট বৃদ্ধি করেছে। ২৭ অক্টোবর থেকে তা কার্যকর হয়েছে। এর আগে পলিসি রেট ছিল সাড়ে ৯ শতাংশ। সর্বশেষ দশমিক ৫০ শতাংশ বেসিক পয়েন্ট বৃদ্ধি করে পলিসি রেট ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এটাই সর্বোচ্চ পলিসি রেট। তিন বছর আগেও পলিসি রেট ছিল ৫ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শিডিউল ব্যাংকগুলোকে স্বল্প সময়ের জন্য ঋণ বা ধার গ্রহণের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ হারে সুদ দিতে হতো। এখন তা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত হলো। বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসি রেট বারবার বৃদ্ধির পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে অভ্যন্তরীণ বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে এনে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা।
মুক্তবাজার অর্থনীতির সূত্র মোতাবেক, কোনো কারণে যদি পলিসি রেট বৃদ্ধি করা হয়, তাহলে ব্যাংক ঋণের সুদের হারও আনুপাতিকভাবে বৃদ্ধি পাবে। এতে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ আগের তুলনায় ব্যয়বহুল হবে। ফলে সাধারণ ঋণগ্রহীতা এবং উদ্যোক্তাদের মাঝে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের আগ্রহ এবং সামর্থ্য উভয়ই হ্রাস পাবে। বাজারে অর্থের জোগান কমে যাবে। এ অবস্থায় বাজারে বিভিন্ন পণ্যের উপস্থিতি থাকলেও ভোক্তারা চাইলেও তা ক্রয় করতে পারবেন না। ফলে মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে কমে আসবে। তাত্ত্বিকভাবে পলিসি রেট বাড়ানোর এটাই মূল উদ্দেশ্য। পলিসি রেট বাড়ানো হলে সংশ্লিষ্ট দেশের বিনিয়োগ কার্যক্রমে কিছুটা হলেও স্থবিরতা নেমে আসার আশঙ্কা থাকে। তাই উচ্চ বিনিয়োগ প্রত্যাশী কোনো দেশ সাধারণত একেবারে অপারগ না হলে পলিসি রেট বৃদ্ধি করে না।
করোনা-উত্তর বিশ্ব অর্থনীতি যখন পুনরুদ্ধারের পর্যায়ে ছিল, তখন শুরু হয় ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইন সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতি অসহনীয় উচ্চমাত্রায় চলে যায়। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকা (ফেড) বারবার পলিসি রেট বৃদ্ধি করতে থাকে। ফেডের অনুসরণে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্তত ৭৭টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বৃদ্ধি করে। বিনিয়োগ স্থবিরতার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকা দুই বছরের ব্যবধানে পলিসি রেট অন্তত ১৩ বার বৃদ্ধি করে। পলিসি রেট বৃদ্ধি এবং অন্যান্য প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১ শতাংশ থেকে কমে মূল্যস্ফীতির হার বর্তমানে ৩ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। শ্রীলংকার মতো আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত একটি দেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতি ৭৫ থেকে ২ শতাংশে নেমে এসেছে। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকা এখন আবার পলিসি রেট বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুসরণে বাংলাদেশসহ যে ৭৭টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বৃদ্ধি করেছিল, তারা প্রায় সবাই উচ্চ মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে বিস্ময়কর ব্যতিক্রম। বাংলাদেশ ব্যাংক নানাভাবে চেষ্টা করেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখনো সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্দেশ্যমূলক ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখনো কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান শীর্ষ কর্মকর্তারা উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু উদ্যোগটি গ্রহণ করা হয়েছে বড়ই বিলম্বে। মুক্তবাজার অর্থনীতির একটি সীমাবদ্ধতা হচ্ছে একে যদি স্বাধীনভাবে চলতে না দেওয়া হয়, তাহলে উলটো ফল দিতে পারে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সবকিছুর মূল্য বাজার চাহিদা ও জোগানের ওপর ভিত্তিক করে নির্ধারিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। কোনো কারণে যদি এ স্বাভাবিকতায় হস্তক্ষেপ করা হয়, তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের অতীত সিদ্ধান্ত সেটাই প্রমাণ করে। অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রবণতা দেখা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসি রেট বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু প্রায় একই সময়ে দেশের একটি প্রভাবশালী ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা শ্রেণির চাপের মুখে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়। একই সময়ে আমানতের ওপর প্রদেয় সুদের সর্বোচ্চ হার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে সাড়ে ৫ শতাংশ এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের বেলায় ৬ শতাংশ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। সেই সময় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড ছিল সোয়া ৮ শতাংশ। সোয়া ৮ শতাংশ ব্যয়ে সৃষ্ট ফান্ড কি কখনো ৯ শতাংশ সুদে বিনিয়োগ করা সম্ভব? কিন্তু এটি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। গত বছর জুনে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার ৯ শতাংশ নির্ধারিত ছিল। আমানতের ওপর প্রদত্ত সুদের হারও অপরিবর্তিত থাকে। অথচ একই সময়ে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল সাড়ে ৯ শতাংশের ওপরে। যেহেতু মূল্যস্ফীতির হার আমানতের ওপর প্রদেয় সুদ হারের চেয়ে বেশি ছিল, তাই আমানতকারীরাও ব্যাংকে আমানত সংরক্ষণের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ফলে আমানতের স্বল্পতার কারণে অধিকাংশ ব্যাংক সংকটে পতিত হয়। ব্যাংক ঋণের সুদের হার মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম হওয়ার ফলে একটি প্রভাবশালী মহল বিভিন্নভাবে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে তা অন্য খাতে প্রবাহিত করেন। এমনকি বিদেশে পাচার করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। গত এক মুদ্রানীতিতে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। অথচ সেই সময় ব্যক্তি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। একই সময়ে শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি হ্রাস পেয়েছিল ১৪ শতাংশ করে। আর ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি কমেছিল ৭৬ শতাংশ। তাহলে এটি নিশ্চিত, শিল্পে ব্যবহারের জন্য যে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছিল, তা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়েছিল। সেই সময় বাংলাদেশ ব্যাংক যদি পলিসি রেট বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের সুদের হার নির্ধারণের ইস্যুটি বাজারের ওপর ছেড়ে দিত, তাহলে পরিস্থিতি এমন হতো না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান কর্তৃপক্ষ পলিসি রেট বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের সুদের হার নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। গত তিন মাসে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি পেয়ে ১৬ দশমিক ৬৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। হঠাৎ করেই ব্যাংক ঋণের সুদের হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার ছিল জিডিপির ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, যা পরবর্তী বছর (২০২২-২০২৩) ৫ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। চলতি অর্থবছরেও ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। অর্থবছরের প্রথম ২ মাসে শিল্পে ব্যবহার্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হয়েছে ২৮ দশমিক ৫০ কোটি মার্কিন ডলারের। এটি আগের বছর একই সময়ের তুলনায় ৪৩ দশমিক ৭১ শতাংশ কম। পরিসংখ্যান থেকে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে, আমরা উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি, তা ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান পর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসি রেট বৃদ্ধির মাধ্যমে বরং উলটো দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতিকে স্থবির করে ফেলছে। প্রথম দিকে যখন বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসি রেট বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করে, সেই সময় একইসঙ্গে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাজারভিত্তিক না করে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ কোনো নির্ধারণ করে রাখা হয়েছিল, তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কি জানতেন না পলিসি রেট বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের সুদের হার ফিক্সড করে রাখলে তার পরিণতি কী হতে পারে?
বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থার ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। রাজনৈতিক আনুগত্য প্রদর্শনকারী একটি গোষ্ঠী বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তারা সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে যৌক্তিক কারণ ছাড়াই একটি পণ্যের মূল্য হ্রাস-বৃদ্ধি করতে পারেন। গত ১৫ বছরে বাজারে সৃষ্ট প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য এখনো বিদ্যমান। এদের যদি শায়েস্তা না করা যায়, তাহলে দ্রব্যমূল্য কোনোভাবেই সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসবে না। আর মূল্যস্ফীতি কমানো না গেলে সরকারের সব অর্জন অরণ্যে রোদনে পরিণত হতে বাধ্য। বাংলাদেশ প্রধান জ্বালানি পণ্য জ্বালানি তেল আমদানির মাধ্যমে চাহিদা পূরণ করে থাকে। জ্বালানি তেল এমনই এক উৎপাদন উপকরণ, যার প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ সাহচর্য ব্যতীত কোনো উৎপাদন কার্যক্রম সম্পাদিত হতে পারে না। জ্বালানি তেলের মূল্য সার্বিকভাবে একটি দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি সৃষ্টিতে অন্যতম প্রভাবক হিসাবে কাজ করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে জ্বালানি ব্যবহার সম্পর্কিত সঠিক নীতিমালা নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছালে অভ্যন্তরীণ বাজারে একাধিকবার জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানো হয়। সবশেষ প্রতি লিটার জ্বালানি তেলের মূল্য প্রায় ৪২ শতাংশ বাড়ানো হয়। সেই সময় বলা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস পেয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারেও জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হবে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ৬৪ মার্কিন ডলারের বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু অঙ্গীকার মোতাবেক স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমানো হয়নি। জ্বালানি তেলের মূল্য যৌক্তিকভাবে কমানো হলে তা উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অনেকটাই সহায়ক হতো। এ মুহূর্তে জ্বালানি তেলের মূল্য যৌক্তিকভাবে কমানো যেতে পারে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠনের প্রভাব প্রত্যক্ষ করা যায়। তারা নানাভাবে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। এদের বিরুদ্ধে বাজার সিন্ডিকেটকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। তাই এদের ব্যাপারেও অনুসন্ধান চালাতে হবে। এরা যাতে বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে কোনো ধরনের কারসাজি করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। বাজারে যেসব সিন্ডিকেট তৎপর রয়েছে, তাদের কঠোর হস্তে দমন করা না গেলে কোনোভাবেই পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
এমএ খালেক : অর্থনীতিবিষয়ক লেখক; অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি