Logo
Logo
×

বাতায়ন

জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার এখনই সময়

Icon

ড. মো. আব্দুল জলিল

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার এখনই সময়

দেশের যে কোনো মানুষকে সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান সফল হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলে দলমতনির্বিশেষে সবাই একবাক্যে বিগত সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার, নিরীহ মানুষকে হয়রানি, চাঁদাবাজি, ছাত্র আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি ছোড়া ও হত্যা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দায়ী করবেন। দীর্ঘ পনেরো বছর একটানা ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগে এবং সরকারে স্বার্থান্বেষী ও সুযোগসন্ধানীদের সম্মিলন ঘটেছিল। ফলে একসময়কার জনগণের দল পরিণত হয় চাটুকার ও তোষামোদকারীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে। আদর্শবান রাজনৈতিক নেতারা দলে গুরুত্ব হারান অথবা তাদের কোণঠাসা করে রাখা হয়। যেনতেন উপায়ে ক্ষমতায় থাকার মোহ পেয়ে বসায় দলের কাছে জনগণের গুরুত্ব কমে যায় এবং রাতের ভোটের কারিগরদের কদর বাড়ে। পুলিশ ও আমলাতন্ত্রের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতার কারণে দুর্নীতিবাজ আমলাদের ন্যায্য-অন্যায্য দাবি সরকারকে মেনে নিতে হয়। নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নে দলীয় আনুগত্য প্রদর্শন বেশি গুরুত্ব পায়। প্রশাসনে পেশাদারির পরিবর্তে দলীয় পরিচয় যোগ্যতার মানদণ্ড হিসাবে বিবেচিত হয়। ফলে প্রশাসন ও দলের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা অনেক ক্ষেত্রে দুরূহ হয়ে পড়ে। অনেক কর্মকর্তাই আওয়ামী ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফলে ছাত্র, যুব ও পেশাজীবী সংগঠনে দুর্নীতিবাজ, চাটুকার ও পেশিশক্তির প্রাধান্য দেখা যায়। অনিয়মই দেশে নিয়মে পরিণত হয়। বিভিন্ন এলাকায় সরকারি দলের নেতাদের ছত্রছায়ায় কিছু দালাল সৃষ্টি হয়, যারা সর্প হয়ে দংশন করত, আবার ওঝা হয়ে বিষ নামানোর দায়িত্ব পালন করত। একদিকে ক্ষমতার অপব্যবহার, অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মূল্যস্ফীতি, খুন, গুম, আয়নাঘরের বীভৎস নির্যাতন সাধারণ মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। মানুষ এ বিভীষিকাময় অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছিল। অবশেষে ছাত্র-জনতার আন্দোলন স্বৈরাচারের পতন নিশ্চিত করতে পেরেছে।

সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত হলেও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মূল দার্শনিক ভিত্তি ছিল সমাজ থেকে সব ধরনের বৈষম্য দূর করে সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠা করা। বিশেষ করে তারুণ্যের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা থাকায় এ অভ্যুত্থান জনগণকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল নতুন একটি বাংলাদেশ গড়ার। আমরা আশান্বিত হয়েছিলাম এমন এক বাংলাদেশের, যেখানে হিংসা-হানাহানি, রাজনৈতিক সংকীর্ণতা, বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা, শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ভিন্নমতকে দমন, লুটপাট ও দুর্নীতির মহোৎসব, বাজার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের যে আয়োজন করা হয়েছিল, এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখছি? সরকারের ধীরে চলার নীতি, বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারা, কোনো কোনো জায়গায় চাঁদাবাজির শুধু হাতবদল এবং কতিপয় অতি উৎসাহী ব্যক্তির বাড়াবাড়ির কারণে ‘যে লাউ সেই কদু’র বাঙালি দর্শন মাঝেমধ্যে আমাদের মাঝে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে।

নতুন বাংলাদেশে প্রথমেই আমরা হোঁচট খাই বিচারাঙ্গনের পরিবেশ দেখে। জুলাই গণহত্যার অভিযোগে বিগত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আটক করে যখন আদালতে নেওয়া হচ্ছিল, তখন আদালত চত্বরে অনেককেই শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এটি সত্য, গণহত্যার দায়ে তাদের প্রতি জনগণের ক্ষোভ ছিল। আর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরপর সব ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় কিছুটা সময় লেগেছে। কিন্তু সরকার গঠনের দুই মাস পার হলেও এখনো মাঝেমধ্যে কথিত মব জাস্টিসের অভিযোগ শোনা যায়। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কঠোর হস্তে দমন করতে না পারলে ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থান প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। মনে রাখতে হবে, একজন ব্যক্তি যত বড় অপরাধী হোক না কেন, তার বিচার আদালতেই হওয়া উচিত। আদালতে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার রাখেন। যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই অপরাধের বিচার করা উচিত। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া, আদালত প্রাঙ্গণে শারীরিক লাঞ্ছনা কিংবা হট্টগোলের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের আইনজীবীদের কথা বলতে না দেওয়া কোনো সভ্য আচরণ নয়।

আওয়ামী শাসনামলে ভিত্তিহীন মামলার ছড়াছড়ি ছিল। রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আওয়ামী নেতাকর্মীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে অনেককে মামলার গ্লানি টানতে হয়েছে। কিন্তু একই আচরণ যদি এখনো হয়, এখনো যদি গণহারে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়, অপরাধ না করা সত্ত্বেও কাউকে মামলার আসামি করা হয়, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক শত্রুতার প্রতিশোধের জন্য প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক মামলায় জড়ানো হয়, তাহলে বিগত স্বৈরশাসনের সঙ্গে বর্তমান অবস্থাকে কীভাবে আলাদা করা হবে? ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় আমার এলাকার একটি ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী-যুবলীগের নেতাকর্মীরা বিএনপি কর্মীদের ওপর হামলা করে। এতে কয়েকজন আহত হন এবং কিছু ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়। ২০১৮ সালের সেই ঘটনায় সম্প্রতি একজন মামলা করেছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে, তাদের মধ্যে কয়েকজন ওই হামলায় জড়িত ছিলেন না। এমনকি একজন ওই সময় দেশের বাইরে ছিলেন। এখন যিনি অপরাধে সংশ্লিষ্টতা না থাকা সত্ত্বেও কাউকে মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করলেন, ন্যায়বিচারের স্বার্থেই হয়রানিমূলক মামলার জন্য তার শাস্তি হওয়া উচিত নয় কি? আবার শুনলাম, মামলা থেকে নাম বাদ দেওয়ার কথা বলে নাকি টাকাও দাবি করা হচ্ছে! দলীয় সরকার ক্ষমতায় না থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক চাঁদাবাজি কেন বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না, তা বোধোগম্য নয়। এ ধরনের হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে দমন করতে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ কাম্য। অন্যথায় বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে বলীয়ান জনগণ হতাশ হয়ে পড়বেন।

একটি দেশের উন্নতির জন্য নাগরিকদের মধ্যে ঐক্য খুব প্রয়োজন। আমাদের দেশে দীর্ঘদিন চলে আসা রাজনৈতিক সংস্কৃতি ছিল জাতিকে বিভক্ত করা। সরকারি উদ্যোগে রাজনৈতিক সম্প্রীতির পরিবর্তে রাজনৈতিক বিভেদকে উসকে দেওয়া হয়েছিল। নতুন বাংলাদেশে আমাদের প্রত্যাশা-বিভেদের রাজনীতি থেকে আমরা মুক্তি পাব। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভিন্নতা সত্ত্বেও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার এটাই মোক্ষম সময়। এক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্র যদি দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালনে উদ্যোগী হয়, তাহলেই ঐক্যবদ্ধ দেশ গঠন করা সম্ভব হবে।

আওয়ামী শাসনামলে অপকর্ম হয়েছে বলে এখনো তা করা যাবে-এমন ধারণা জুলাই বিপ্লবের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একজনকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে শুধু আরেকজনকে ক্ষমতার চেয়ারে বসানোর জন্য ছাত্র-জনতার বিপ্লব সংঘটিত হয়নি। তারুণ্যের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিপ্লবকে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে হবে। নতুনভাবে যাতে ফ্যাসিবাদ জেঁকে বসতে না পারে এবং দেশের নাগরিকরা বৈষম্যহীন সমাজের সুফল ভোগ করতে পারে, সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিরোধের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলাকে যারা হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে চায়, তাদের ব্যাপারে এখনই সতর্ক হতে হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে বিতর্কিত করার যে কোনো চেষ্টাকে দমন করতে না পারলে বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।

ড. মো. আব্দুল জলিল : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম