Logo
Logo
×

বাতায়ন

চাল ও খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা জরুরি

Icon

হাসান মামুন

প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চাল ও খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা জরুরি

ফাইল ছবি

আবদুল লতিফ মণ্ডল সাহেব বেঁচে থাকলে আজ যে ইস্যুতে লিখছি, সে বিষয়ে তিনিও নিশ্চয় লিখতেন। খাদ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে তাকে কত যে লিখতে দেখেছি! জানি না, তিনি অর্থশাস্ত্রের ছাত্র ছিলেন কিনা। তবে কিছুদিন ছিলেন খাদ্যসচিব। তখনই সম্ভবত খাদ্য নিরাপত্তায় জোর দিয়ে লেখার আগ্রহ তৈরি হয় তার মধ্যে। অর্থনীতির অন্যান্য বিষয়েও কম লিখেননি। তবে কেন্দ্রীয় আগ্রহ ছিল খাদ্য নিরাপত্তায়। প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করেই লিখতেন। এর মধ্যে গরমিলের বিষয়েও সতর্ক থাকতে দেখেছি তাকে। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যুতেও কম লিখতে দেখিনি, বিশেষত যেসব ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন। গণতন্ত্রবোধ তার মধ্যে প্রবল ছিল। মণ্ডল সাহেব আগে কেবল ইংরেজি সংবাদপত্রে লিখতেন। যুগান্তরে চাকরি করার সময় আমি তাকে বাংলায় লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিলাম। মিডিয়ার মানুষজন এসব তো করেই থাকি। পরে বণিক বার্তায় থাকাকালে সেখানেও তাকে লেখার আমন্ত্রণ জানাই। লতিফ মণ্ডল সাহেব আমার এ সামান্য ভূমিকার কথা প্রসঙ্গ উঠলেই বলতেন। সম্প্রতি পরিণত বয়সেই তিনি মারা গেলেন। সে খবরটা মিডিয়ায় গুরুত্বসহ এসেছে, তা বলব না। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অবসর জীবনে অক্লান্তভাবে লিখে জাতিগঠনমূলক কাজে ভূমিকা রাখার উদাহরণ কি বেশি আছে? সে কারণেও আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য চাল ঘিরে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে লেখার আগে মণ্ডল সাহেবকে একটু স্মরণ করে নেওয়া জরুরি মনে করলাম।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের মাস দুয়েক পর একগুচ্ছ নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে যখন উত্তপ্ত আলোচনা হচ্ছে, তখন চালের বাজারেও কিন্তু অস্থিরতা চলছে। চালের সঙ্গে গম তথা আটা-ময়দার বাজারে অবশ্য অস্থিরতা নেই। গমকে চালের বিকল্প ধরা হচ্ছে। এ অবস্থায় দেশে গমের উৎপাদন বাড়ানোর প্রয়াসও নেওয়া হয়েছিল। তাতে আমরা সফল হইনি। নানা কারণে এর উৎপাদনে কৃষকও আগ্রহ হারাচ্ছেন। ভুট্টার আবাদে বরং আগ্রহ বাড়ছে। কৃষক তাতে লাভবান হচ্ছেন। আমাদের কৃষক সমাজে মুনাফার প্রবণতা বাড়ছে বৈকি। এ কারণে শাকসবজি উৎপাদনেও আগ্রহ বাড়ছে। সবজিতে দেশ বলা যায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। অবশ্য চালের ক্ষেত্রেই এটা আমরা বেশি বলে থাকি। গমে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার কল্পনাও বোধহয় করি না। এক্ষেত্রে আমদানিনির্ভরতা ক্রমে বাড়ছে। গেল অর্থবছরে গম আমরা বেশি আমদানি করেছিলাম। সেটা কি চালে কিছুটা ঘাটতি ছিল বলে? নাকি চালের পাশাপাশি গমের চাহিদাও বেড়েছে? শুধু চাল, গম আর ডাল, আলুর পরিভোগ বেড়ে যদি মাছ, মাংস, ডিম, দুধ; এমনকি সবজির পরিভোগ কমে যায়, সেটা কিন্তু পুষ্টি পরিস্থিতির জন্য বিপজ্জনক। অবশ্য শীতকালীন সবজি বাজারে আসবে অচিরেই। ডিমের দাম অনেক বাড়ার পর এটা বেশি করে আমদানির ব্যবস্থা হয়েছে। মাছ ধরায় চলমান নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে এর সরবরাহও বাড়বে। নতুন ধারণাসহ মনিটরিংয়ে জোর দিয়েছে সরকার। এসবের কিছু সুফল পাওয়ার আশায় আমরা থাকব বৈকি।

এ অবস্থায় চালের বাজারে অবশ্য আলাদাভাবে নজর দিতে হবে। অন্তত নতুন করে এর দাম বৃদ্ধির প্রবণতা রোধ করা জরুরি। এমন মনোভাব নেওয়াও চলবে না-অন্যান্য পণ্যের দাম কমে এলে চালের দাম কমানোর পদক্ষেপ আর না নিলেও চলবে। অবশ্য এরই মধ্যে কিছু চাল আমদানি নিশ্চিত করতে এর ওপর আরোপিত উচ্চ শুল্ক-কর হ্রাস করেছে সরকার। সংকট দেখা দিলে সরকার এটা করেই থাকে। হাসিনা সরকারও বছরের শুরুতে চালের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিলে একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল। তা সত্ত্বেও আমদানি অবশ্য হয়নি। এর বড় কারণ, প্রতিবেশী দেশ এবং চালের প্রধান রপ্তানিকারক ভারত থেকে এটা আনা কঠিন ছিল। তারা জারি রেখেছিল বিধিনিষেধ। অন্যান্য উৎস থেকে আমদানিও সহজ ছিল না। বিশ্ববাজারে চালের দাম তখন এমন ছিল যে, হ্রাসকৃত শুল্কে আমদানি করেও অভ্যন্তরীণ বাজারের চেয়ে কম দাম নিশ্চিত করা যেত না। ব্যবসায়ীদের লোকসানের ভয় ছিল। সরকারের তরফ থেকে আবার বলা হচ্ছিল, দেশে চালের সরবরাহ যথেষ্ট; উৎপাদন ভালো; সরকারের মজুতও সন্তোষজনক। এসব তথ্য নিয়ে সংশয়ও কম ছিল না। গবেষক তো বটেই, ব্যবসায়ীরাও এ নিয়ে দ্বিমত করতেন। বাজারে তাদের বক্তব্যের প্রতিফলনই বেশি দেখা যেত। আলু, পেঁয়াজের মতো পণ্যের ক্ষেত্রেও সরকার পরিবেশিত তথ্য-উপাত্তের সত্যতা শেষতক প্রতিষ্ঠিত হয়নি। উৎপাদন ঘাটতির কারণে আলু আমদানির প্রায় নজিরবিহীন সিদ্ধান্তও নিতে হয় বিগত সরকারকে। এর বাজার কিন্তু এখনো চড়া। হালে প্রধানত বন্যায় ডিমের উৎপাদন কমলে বাণিজ্য উপদেষ্টা অবশ্য দ্রুতই জানালেন, এক্ষেত্রে বড় সরবরাহ সংকট দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় আমদানি না করে শুধু মনিটরিং বাড়ালে সুফল মিলবে না।

সরকারের উচিত যে কোনো পণ্যের সরবরাহ পরিস্থিতি সম্পর্কে জনসাধারণকে স্পষ্টভাবে জানানো। ভালো হয় সংকট দেখা দেওয়ার আগেই তারা পদক্ষেপ নিতে পারলে। এখানে লুকোচুরির কিছু নেই। লুকোচুরি করতে গিয়েও বাজারে ভুল সংকেত দেওয়া হয় অনেক সময়। তাতে সংকট আরও বেড়ে ওঠে। পরিস্থিতি গোপনও রাখা যায় না। সাধারণ ক্রেতাও টের পেয়ে যান সংকট আসলে কোথায়। বাজারে কোনো ধরনের চালের অভাব চোখে পড়ছে না; তবে সংকট যে একটা রয়েছে, তা প্রতিফলিত হচ্ছে দামে। চালের পাশাপাশি ধানের দামও কিন্তু খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এটি সাধারণত আলোচনায় আনেন চালকল মালিকরা। তারা বলেন, ধানের দাম বেশি হলে কম দামে চাল দেব কীভাবে? ধানের দাম আবার বেশি থাকা প্রয়োজন; নইলে কৃষক উৎপাদনে আগ্রহ হারাবেন। তবে সমস্যা হলো, ধান ধরে রাখার ক্ষমতা তার কম। দেশে সবচেয়ে কম হয়ে থাকে যে আউশ ধান, তার উত্তোলন এর মধ্যে হয়ে গেছে। মাঠে আছে আমন। বন্যায় বেশকিছু অঞ্চলে আউশের ক্ষতি কম হয়নি। আমনেরও কম ক্ষতি হয়নি বিশেষত নোয়াখালী-কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের নজিরবিহীন বন্যায়। পুনরায় আমনের আবাদ করে ক্ষতিটা যথাসম্ভব পুষিয়ে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছিল। কৃষি বিভাগের বীজ, সার আর অর্থ দিয়ে কিছু সহায়তাও জোগানোর কথা। ওইসব অঞ্চলে সবজি, পোলট্রি, মাছ আর গরুর খামারেরও কম ক্ষতি হয়নি। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে প্রয়োজন আমনের ফলন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে না দেওয়া। চালের বাজারে নতুন করে যে অস্থিরতা, তার সঙ্গে আউশ ও আমনের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার একটা সম্পর্ক তো অবশ্যই রয়েছে। তবে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় উঁচু এলাকায় বৃষ্টিনির্ভর আমনের ফলন ভালো হতে পারে। তাতে ওইসব এলাকার কৃষকই কেবল লাভবান হবেন না; খাদ্য নিরাপত্তায়ও সেটা কিছু ভূমিকা রাখবে। বন্যা ও অন্যান্য কারণে উল্লিখিত দুটি ফসলের প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির চিত্র অবশ্য পেতে হবে সরকারকে। কৃষি বিভাগ যেন ক্ষতিটা হালকা করে দেখিয়ে নীতিনির্ধারকদের বিভ্রান্ত না করে। তবে চাল আমদানির অনুমতি এবং এতে ব্যাপকভাবে শুল্ক-কর ছাড়ের ঘটনায় বোঝা যাচ্ছে, সরকার এ ব্যাপারে সিরিয়াস। হাসিনা সরকার আমলে আমদানি হয়নি বলে এখনো চাল আমদানির প্রয়োজন নেই, এমন অন্ধবিশ্বাস নিয়ে তারা বসে নেই। সত্যি বলতে, তখনই যেভাবে হোক কিছু চাল এনে রাখা উচিত ছিল। বেসরকারিভাবে সম্ভব না হলেও সরকারিভাবে কিছু চাল আমদানি ছিল জরুরি। তাতে এখন নতুন করে আমদানির উদ্যোগ হয়তো নিতে হতো না।

এটা অবশ্য সুখবর যে, ভারত এরই মধ্যে চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেছে। সেখান থেকে আনলে পরিবহণ খরচ কম লাগে বলেও আমরা এখন কিছুটা সহজে চাল আনতে পারব। ভারত রপ্তানি সহজ করায় তার প্রতিযোগী দেশগুলোয়ও চালের দাম হয়তো কিছুটা কমে আসবে। তখন পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম থেকেও চাল আনা যাবে সহজে। এসব খবরেও চালের বাজারে হয়তো কিছু সুপ্রভাব পড়বে। গম আমদানি স্বাভাবিক রাখায়ও দিতে হবে জোর। চালের সংকটে দরিদ্ররা অনেক সময় আলু বেশি খেয়ে থাকে। তবে আলুর দামও অনেকদিন ধরে চড়া। এক্ষেত্রেও নতুন সরকার শুল্ক-করে ছাড় দিয়েছে, যাতে কম দামে আমদানি হতে পারে। তাতেও সুফল মিলছে বলে মনে হয় না। দেশে নতুন করে আলু ওঠা পর্যন্ত এর দাম কমবে বলেও মনে হচ্ছে না। ততদিনে চালের দাম কি কমে আসবে? দাম না কমে এর ঊর্ধ্বগতি রোধ হলেও নিুআয়ের মানুষ বোধহয় বেঁচে যাবে। সরকারও বলতে পারবে-দাম তো আর বাড়েনি!

চালের দামটা এদেশে কেবল খাদ্য নিরাপত্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ নয়; এটা রাজনীতিরও বিষয়। গমের দামও গুরুত্বপূর্ণ; যে কারণে সরকার কিছু গমও নিজের হাতে রাখে সংকট মোকাবিলায়। অনেকে আলুও সরকারিভাবে সংরক্ষণের ওপর জোর দিচ্ছেন। তাতে উত্তোলন মৌসুমে কৃষকেরও কিছুটা বেশি দাম পাওয়ার আশা। খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিতে কখনো কখনো চালের সঙ্গে আলু জোগাতে দেখা যাচ্ছে সরকারকে। ৪০ লাখ পোশাক শ্রমিকের মধ্যে ন্যায্যমূল্যে চাল, ডাল ও ভোজ্যতেল জোগানোর কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে সম্প্রতি। ভোজ্যতেল, সেটা পামঅয়েল হলেও সর্বস্তরে এর সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করা জরুরি। সঙ্গে পেঁয়াজ আর কাঁচামরিচের দামও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। হালে কাঁচা মরিচ আমদানি করে এর বাজার শান্ত রাখাটাও জরুরি ছিল। তবে এ মুহূর্তে চাল আমদানি নিশ্চয়ই অগ্রাধিকার পাবে। মাঝে ডলার সংকটে কোনো কিছুর আমদানিই সহজ ছিল না। অতটা সংকট আর নেই। এ অবস্থায় অন্য কোনো জটিলতায় চাল আমদানি যেন ব্যাহত না হয়, সেটা দেখতে হবে। আমন উত্তোলন এবং এরপর বোরোর উৎপাদন যেন কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সামনে জরুরি ইস্যু হবে সেচ এবং এজন্য ডিজেলের সরবরাহ। আর নিশ্চিত করতে হবে সার। সার সরবরাহ নিশ্চিতের ওপর অনেকখানি নির্ভর করছে বোরোর সাফল্য। মোট ধান-চালের অর্ধেকেরও বেশি আমরা পাই বোরো থেকে। চলতি অর্থবছরের শেষভাগে এটা আসবে হাতে। তার আগে মূলত আউশ, আমন এবং আমদানিকৃত চাল দিয়ে আমাদের চলতে হবে। সরকারের হাতে এর মজুত পরিস্থিতি জেনেও সবাই আশ্বস্ত থাকতে চাইবে এখন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কথা তো বলা যায় না। বর্ষা প্রলম্বিত আর সাইক্লোন ইত্যাদির শঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। চালের ‘প্রকৃত চাহিদা’র হিসাবও বোধহয় নতুনভাবে করতে হবে। এর ‘নন-হিউম্যান কনজাম্পশন’ও তো বাড়ছে। বিভিন্নভাবে চালের অপচয় কমানোর কথাও মাঝে অনেক বলা হয়েছিল।

হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম