Logo
Logo
×

বাতায়ন

শ্রমবাজার সম্প্রসারণের এখনই সময়

Icon

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শ্রমবাজার সম্প্রসারণের এখনই সময়

ফাইল ছবি

জুলাই ২০২৪-এর যুগান্তকারী গণ-অভ্যুত্থান নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের সুযোগ তৈরি করেছে। ছাত্র-জনতার সফল আন্দোলনের ফলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিগত কয়েক দশকে দারিদ্র্যমুক্তির লক্ষ্যে উদ্ভাবনী পদযাত্রায় ক্ষুদ্র অর্থায়নের প্রবক্তা হিসাবে তিনি নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছেন। নারীর ক্ষমতায়ন, নারী উন্নয়ন এবং অপেক্ষাকৃত অবহেলিত নারীশক্তির স্বরূপ উন্মোচনে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। তার শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য কার্বন নিঃসরণ প্রত্যয়ের অনুপ্রেরণায় বিশ্বের তরুণ প্রজন্ম উজ্জীবিত।

ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার গঠনের পরপরই দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়তে শুরু করেছে। চলতি মাসের ৮ তারিখ পর্যন্ত বিপিএম ৬ অনুযায়ী, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ৮২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং মোট রিজার্ভ পৌঁছেছে ২৪ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলারে। রেমিট্যান্সযোদ্ধারা অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে অবৈধ হুন্ডি প্রথা অবজ্ঞা করে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ বিভিন্ন বৈধ চ্যানেলে সরাসরি দেশে প্রেরণ করছেন। বিগত সরকার পতনের পূর্ব মাস অর্থাৎ জুলাই মাসে রেমিট্যান্স আসে মাত্র ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর আগস্ট মাসে রেমিট্যান্স আসে ২২২ কোটি ৪১ লাখ ৫০ হাজার এবং সেপ্টেম্বরে ২৪০ কোটি ৪৭ লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার। চলতি অক্টোবর মাসের ১৯ দিনে বৈধ পথে আসা ১৫৩ কোটি ২৬ লাখ ৬০ হাজার ডলারের রেমিট্যান্স আশাব্যঞ্জক।

বিগত সরকারের আমলে, বিশেষ করে চলতি বছরের শুরুর দিকে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে মালয়েশিয়া, মালদ্বীপসহ কিছু দেশ বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দেয়। মূলত আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের ব্যর্থতার মূলে ছিল তৎকালীন অর্থলোভী-মানুষরূপী দানবের আবরণে কতিপয় জনশক্তি রপ্তানিকারক ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিকদের দুষ্টচক্র। পতিত সরকারের পক্ষ থেকে এদের নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। বরং এমপি-মন্ত্রীদের সংশ্লিষ্টতা, কদর্য পৃষ্ঠপোষকতায় তারা সীমাহীন দুর্নীতিতে লিপ্ত ছিল। ইতোমধ্যে বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে বিদায়ি ক্ষমতাচ্যুত সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন সংসদ সদস্যের কারসাজি ধরা পড়েছে। তারা মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নামে সরকার নির্ধারিত ফি’র বাইরে অতিরিক্ত প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। ওই সময়ে বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোর অসহযোগিতা-অভিযোগের অন্ত ছিল না। দালালের দৌরাত্ম্য, পাসপোর্ট জটিলতাসহ নানান ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসারে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স প্রেরণকারী মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকরা দেশে অধিকতর নিগৃহীত হয়েছেন। বিমানবন্দরে নেমেই তারা অরাজক আচরণ-ভোগান্তিতে নিপতিত হয়। অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (বামারু) প্রতিবেদনেও প্রবাসী কর্মীদের নানা দুর্দশার চিত্র উঠে এসেছে। এছাড়াও বিপুলসংখ্যক প্রবাসীর সর্বস্ব হারিয়ে পুলিশের হাতে আটক হয়ে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে দেশে ফেরার দৃষ্টান্তও রয়েছে। ডব্লিউইডব্লিউবির পরিসংখ্যান মতে, ২০২৩ সালে শূন্য হাতে দেশে ফিরে আসা প্রবাসীর সংখ্যা ৮৬ হাজার ৬২১। তন্মধ্যে পুরুষ ৮৩ হাজার ৭১৯ এবং নারী ২ হাজার ৯০২ জন। তবে সংস্থাটির কাছে পাসপোর্ট নিয়ে দেশে ফেরা প্রবাসীর কোনো হিসাব নেই। অভিবাসন খাতসংশ্লিষ্টদের অভিমত, নিষ্ফল অভিবাসনের প্রকৃত চিত্র আরও নাজুক। বছরে এ সংখ্যা হতে পারে লাখের বেশি। দেশে ফিরে আসা ২১৮ প্রবাসীর ওপর বামারু কর্তৃক পরিচালিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশে গিয়ে কোনো কাজ পাননি এমন কর্মীর সংখ্যা ১৫ শতাংশ এবং চুক্তি অনুসারে কাজ পাননি ২০ শতাংশ।

নিকট অতীতে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানির তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে থাকা মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি নিয়ে বেশ জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। বিভিন্ন সময় দফায় দফায় বন্ধ হয় সেখানকার বাংলাদেশের শ্রমবাজার। সর্বশেষ সরকারিভাবে যারা মালয়েশিয়ায় ওয়ার্কার ভিসা (কর্মী ভিসা) পেয়েছেন, তাদের গত ৩১ মের মধ্যে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের বাধ্যবাধকতা আরোপ করে দেশটির সরকার। ফলে ভিসা ও ছাড়পত্র পেয়েও শুধু বিমান টিকিট সংকটে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার স্বপ্নভঙ্গ হয় কয়েক হাজার বাংলাদেশি কর্মীর। গণমাধ্যমে প্রকাশিত জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমটি) পরিসংখ্যান অনুসারে, সেদিন পর্যন্ত ৫ লাখ ২৬ হাজার ৬৭৩ কর্মীর চাহিদাপত্রের বিপরীতে ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪২ জনকে ছাড়পত্র দিয়েছিল। তাদের মধ্যে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৬৭২ জন যেতে সক্ষম হয়েছেন। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেও ৭ হাজার জন উড়োজাহাজের টিকিট ও ৯ হাজার ৯৭০ জন নিয়োগকর্তা থেকে প্রয়োজনীয় নথি নিতে না পারায় মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি। ওই কর্মীদের পাঠাতে বিগত সরকার নিয়োগের সময়সীমা বৃদ্ধিতে একাধিকবার অনুরোধ করলেও মালয়েশিয়া সরকার তা বারবারই অগ্রাহ্য করেছে।

আশাজাগানিয়া বিষয় হচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার স্বল্প সময়ের মধ্যেই মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের শ্রমবাজারে বিরাজিত সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে আরব আমিরাতে সাজাপ্রাপ্ত শ্রমিকদের মুক্তি, ভিসা জটিলতায় মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা শ্রমিকদের আবারও পাঠানো, বিগত দুই বছর ধরে ইতালির ভিসার জন্য পাসপোর্ট জমাদানকারীদের দ্রুত ভিসা দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ এবং প্রবাসী শ্রমিকদের ভিআইপি মর্যাদা দেওয়ার পদক্ষেপ বিশেষভাবে উচ্চকিত। তাছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার মধ্যপ্রাচ্যগামী কর্মীদের জন্য ঢাকার বিমানবন্দরে বিশেষ লাউঞ্জ করার সিদ্ধান্ত অতি তাৎপর্যপূর্ণ। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সম্মানিত উপদেষ্টার মতে, ‘লাউঞ্জ হলে প্রবাসী শ্রমিক ভাইবোনদের যন্ত্রণা অনেক লাঘব হবে। এর পাশাপাশি অন্যান্য যে ভিআইপি সুবিধা, সেগুলোও থাকবে। বিমানবন্দরে প্রবেশের মুহূর্ত থেকে প্লেনে ওঠার আগ পর্যন্ত যে লাউঞ্জ থাকে, সেই পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে সহায়তার জন্য তাদের সঙ্গে একজন লোক থাকবে।’

বিজ্ঞজনদের মতানুসারে, এতসব সাফল্যের মূলে রয়েছে প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক সুখ্যাতি। অনেকেই এটিকে অন্তর্বর্তী সরকারের অসাধারণ কূটনৈতিক সাফল্য হিসাবেও দেখছেন। সম্প্রতি ঢাকা সফরে আসা মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ অনুরোধে সরকারকে আশ্বস্ত করেছেন, বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে যেতে না পারা প্রায় ১৮ হাজার কর্মীর দেশটিতে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি মারফত আরও জানা যায়, অনিষ্পন্ন ভিসার আবেদন দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকাস্থ ইতালীয় দূতাবাস। আগামী দুই মাসের মধ্যে ২০ হাজার ভিসা আবেদনের সিদ্ধান্ত গ্রহণপূর্বক পাসপোর্ট ফেরত দেবে দূতাবাসটি। দূতাবাসে বর্তমানে প্রায় ৪০ হাজারের বেশি ভিসা আবেদন বিবেচনাধীন রয়েছে।

দেশের জনশক্তি রপ্তানির ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক রপ্তানি শুরু করে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমটি) তথ্য অনুযায়ী, ওই সময় থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে শ্রমিক গেছে ১ কোটি ৬০ লাখেরও বেশি। তন্মধ্যে মাত্র শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ ইতালি ও শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশ্য যুক্তরাজ্যে। সবচেয়ে বেশি জনশক্তি গিয়েছে সৌদি আরবে। এর সংখ্যা প্রায় ৫৮ লাখ; যা মোট জনশক্তি রপ্তানির প্রায় ৩৬ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ২৬ লাখের বেশি মানুষ যায় এ দেশে। প্রায় ১৯ লাখ মানুষের শ্রমবাজার নিয়ে ওমান রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে। এর পরে রয়েছে মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়ায় এ পর্যন্ত শ্রমিক গিয়েছে সাড়ে ১৪ লাখেরও বেশি। দেশটিতে রয়েছে বাংলাদেশের ৯ শতাংশের বেশি শ্রমবাজার। মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ার পর বাংলাদেশের বড় শ্রমবাজার পূর্ব ইউরোপের দেশ রোমানিয়া। যদিও সরকারি নথিতে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের তালিকায় ১৬৮ দেশের নাম রয়েছে। তালিকায় থাকা দেশের মধ্যে ৩১টি দেশে বিগত ৫ বছরে কোনো কর্মী যায়নি।

তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে এটি স্পষ্ট, সিন্ডিকেট বাণিজ্যের আড়ালে পতিত সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের সরাসরি সংযোগ ছিল। আকাশচুম্বী অর্থলোভ শ্রমবাজারকে করেছে কলুষিত। দেশ বঞ্চিত হয়েছে অধিকসংখ্যক বিদেশ গমনেচ্ছু শ্রমিকের কর্মসংস্থান জোগানে। বৈদেশিক মুদ্রা আনয়নে প্রতিবন্ধকতা নানামুখী বাণিজ্য সংকট তৈরি করেছে। আমদানিনির্ভর সব নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হলে মূল্যস্ফীতি চরম আকার ধারণ করে। দেশজুড়ে দেখা দেয় জনদুর্ভোগ ও হাহাকার। স্বল্প সময়ের মধ্যেই প্রধান উপদেষ্টার অতি উঁচুমার্গের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি শ্রমবাজারের সামগ্রিক সংকট উত্তরণে নতুন পথ দেখাবে, আশা করা যায়। প্রত্যাশা করছি, অচিরেই বাংলাদেশ শ্রম রপ্তানিতে নতুন মাত্রিকতায় আবির্ভূত হবে।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম